সিনেমায় বিকৃত ১৯৪৬, ইতিহাসের নামে চলছে যে রাজনীতির খেলা

The Great Calcutta Killings: ৭০ বছর পর এই ঘটনাটা নিয়ে সিনেমা করার পিছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? বিবেক অগ্নিহোত্রীদের লক্ষ্য হলো, হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে তাদের মধ্যে ঘৃণার সৃষ্টি করা।

SB

১৯৪৬-এর শুরু কলকাতাতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন দিয়ে। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে ১৯৪৬ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই বছরটাই ভারতের আগামী সময়ের দিকনির্দেশ করে দিয়েছিল। ওই বছর মার্চ মাসে নির্বাচন হয়, যদিও অবাধ নির্বাচন ছিল না। নির্বাচকমণ্ডলীও পৃথক ছিল। সর্বসাধারণের জন্য আলাদা, আর মুসলিমদের জন্য আলাদা। মুসলিম নির্বাচকমণ্ডলীতে একমাত্র মুসলিম প্রার্থী দাঁড়াতে পারত এবং ভোট দিতে পারত কেবল মুসলিম ভোটদাতারা। এই সময় মুসলিম লীগ ব্যাপক প্রচার চালায় যে, এই নির্বাচন ভবিষ্যতের পাকিস্তান ঠিক করে দেবে।

নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় বাংলায় প্রায় ১১২টা আসন জিতেছে মুসলিম লীগ। সাধারণ আসনে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, দু’টি আসনে জয়লাভ করে হিন্দু মহাসভা। যার থেকেই বোঝা যায়, সেই সময় ‘বাঙালি হিন্দু ভোটার’ হিন্দু মহাসভাকে নির্বাচিত করেনি। বর্তমানে প্রচার করা হয়, হিন্দু বাঙালি হোমল্যান্ড শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্যই হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন, হিন্দু বাঙালির কাছে শ্যামাপ্রসাদ বা তাঁর দল যদি এতটাই গ্রহণযোগ্য হত, তাহলে তখন একটি বা দুটি আসন কেন পেয়েছিল?

এরপর যখন ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন জওহরলাল নেহরু মন্তব্য করেন যে, আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সঙ্গে যুক্ত হব কিন্তু পরবর্তীকালে কংগ্রেস নিজস্ব মত অনুযায়ী কাজ করবে। এর থেকে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মনে করেন, কংগ্রেস পরবর্তীকালে নিজের মত পরিবর্তন করতে পারে। এর ফলে মুসলিম লীগ ঠিক করে, আর সংবিধানসম্মতভাবে কাজ করলে চলবে না এবং 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন'-এর ডাক দেয়। ১৯৪৬ সালের ১৬ অগাস্ট সারা দেশজুড়ে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ হবে বলে ঘোষণা করা হয়। তার আগে দু’পক্ষই ব্যাপকভাবে প্রচার চালায়। বাংলার মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দি ১৬ অগাস্ট ছুটি ঘোষণা করেন। এরপর কলকাতা শহরে ভয়ঙ্কর গুজব ছড়িয়ে পড়ে, সেদিন কিছু একটা হতে চলেছে। 

আরও পড়ুন- বিনোদনের রাজনীতি || শুধু ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নয়, প্রোপাগান্ডা ছবিতে উপচে পড়ছে বলিউড

এখানে কে দাঙ্গা শুরু করল, কে প্রথমে মারল গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, হিন্দুত্ববাদীরা যে ন্যারেটিভ তৈরি করেছিল এবং অনেকদিন ধরে প্রচার করা হয় যে হিন্দুরা মুসলিমদের মতো ঐক্যবদ্ধ নয়। মুসলিমরা ধর্মের নামে ঐক্যবদ্ধ, একবার ডাক দিলেই সবাই রাস্তায় নেমে পড়বে। বর্তমানে যে হিন্দি সিনেমা নিয়ে এত বিতর্ক হচ্ছে, সিনেমাটিরও একই বক্তব্য যে হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ ছিল না, তাই মার খেয়েছে। তারপর গোপাল পাঁঠা নামে একজন ‘কসাই’ (বিবেক অগ্নিহোত্রীর কথায়) হিন্দুদের সংঘবদ্ধ করে এবং হিন্দুরা তারপর পাল্টা মারতে থাকে। ট্রেলার দেখে যা বুঝেছি, পরিচালক সিনেমায় দেখাতে চেয়েছেন, তখনকার অবস্থা আর এখনকার অবস্থা পরিবর্তন হয়নি। এখনও মুসলিমরা আক্রমণাত্মকভাবে বেড়ে চলেছে। হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ নয়। আবার একটা গোপাল পাঁঠা দরকার, নাহলে আবার একটা কলকাতা গণহত্যা হবে, নোয়াখালি হবে ট্রেলার দেখে বোঝা যাচ্ছে এটাই সিনেমার গল্প।

সিনেমার ফাঁকিগুলো হলো, হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ ছিল না বলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা কিন্তু নয়। প্রচুর দলিল-দস্তাবেজ রয়েছে, যেখানে দেখা যায়, দু’পক্ষই একটা আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। অতএব, একেবারেই হঠাৎ করে হিন্দুরা মার খেয়েছে এমনটা নয়। পার্থক্য বলতে, যারা দাঙ্গা ঘটিয়েছিল, তারা ছিল উর্দুভাষী মুসলিম। যারা মূলত কলকাতা এবং কলকাতা-সংলগ্ন হাওড়া, হুগলিতে কাজের সূত্রে ভিন রাজ্য থেকে এসেছিল। দেখা গেছে ওইসব এলাকাগুলোতেই (উত্তর-মধ্য কলকাতা) বেশি আক্রমণ হয়েছিল। এর আগে ১৯২৬ সালেও উত্তর ও মধ্য কলকাতার অঞ্চলগুলোতেই ভয়ঙ্কর দাঙ্গা হয়েছিল। সে’সময় লড়াইটা হয়েছিল মূলত মধ্যদেশীয় হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে। বাঙালি হিন্দুদের এতে খুব একটা অংশগ্রহণ ছিল না। কিন্তু '৪৬-এ বাঙালি হিন্দু ভয়ঙ্করভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। পাড়ায়-পাড়ায় কিছু লোক উঠে আসে, যাঁরা রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠেন। এঁরা কিন্তু গুণ্ডা নয়। যেমন, গোপাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন, আত্মোন্নতি সমিতির সদস্য। আত্মোন্নতি সমিতি হলো, কলকাতার সবথেকে পুরোনো বিপ্লবী সমিতি। এবং সেই সমিতির নেতা ছিলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি।

আরও পড়ুন- বাঙালি শহিদদের রক্তে রাঙা সেলুলার জেল, সিনেমা হার মানবে অত‍্যাচারের সেই গল্পের কাছে

গোপাল মুখোপাধ্যায়ের কাকা ছিলেন অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনিও ওই দলেরই লোক। গোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁদের কাছেই প্রশিক্ষিত। কাকার মাংসের দোকান ছিল। তখনকার দিনে যেহেতু বাঙালি হিন্দুরা মাংসের দোকান চালাত না, তাই মুখে-মুখে চালিত হয়ে যায় ওটা ‘বাঙালি পাঁঠার দোকান’। আর দোকানটি যেহেতু গোপাল মুখোপাধ্যায় চালাতেন, সেখান থেকেই তাঁর নাম হয়ে যায় গোপাল পাঁঠা। তাঁর মতোই আরো কয়েকজন ছিলেন, বিজয় সিং নাহার, শত ঘোষ, ভানু বোস এঁরা পাড়ায়-পাড়ায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। স্বাধীনতার পরে গুণ্ডা হিসেবে দেখা যায় গোপাল মুখোপাধ্যায়কে। বিধান রায়ের হয়ে বুথ দখল করতেন তিনি। এখানেই প্রশ্ন, তিনি যদি বিধান রায়ের সঙ্গেই আসবেন তাহলে সিনেমায় গোপাল পাঁঠার চরিত্র কেন বলছে “এই দেশটা হিন্দুর দেশ, আর হিন্দুদের নির্বীর্য করেছে গান্ধী।" তাহলে তিনি স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের সঙ্গে গেলেন কীভাবে? তাঁর তো জনসংঘে যাওয়ার কথা ছিল। 

এরকমই আরেকজন ছিলেন রাম চ্যাটার্জি। চন্দননগর, হুগলির ডাকাবুকো একজন মানুষ ছিলেন। '৪৬-এ তাঁরও গতিবিধি এই গোপাল পাঁঠাদের মতোই। তিনিই আবার পরবর্তীকালে '৭৭-এ বামফ্রন্টের ক্যাবিনেট মিনিস্টার ছিলেন। তিনি মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড দল করতেন। এই লোকগুলোই সেই সময় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৪৬ শুধু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়, রাজনৈতিক দাঙ্গাও। কারণ শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়নি। জাতীয়তাবাদী মুসলিম, যারা পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিল, তারাও মুসলিম লীগ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। ফলে হিন্দু-মুসলিম যে ন্যারেটিভ দেখানো হচ্ছে সেখানে এই বিষয়টা বাদ দেওয়ায় স্বাভাবিক। বিবেক অগ্নিহোত্রী এটা বাদ দিয়ে দেবেন যে, জাতীয়তাবাদী মুসলিমরা আক্রান্ত হয়েছিল।

সেই সময়ের সংবাদপত্র খুললে দেখা যাবে, একদিকে চরম নৃশংসতা। কলকাতার বুকে তখন আইনের রাজত্ব লোপ পেয়েছে। তিন-চারদিন ধরে ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চলেছে। পাঁচ হাজারেরও বেশি লোক মারা গেছে ওই সময়। তার পাশপাশি এই চিত্রটাও আছে, মুসলিম হিন্দুকে বাঁচিয়েছে। হিন্দু মুসলিমকে বাঁচিয়েছে। খ্রিস্টান, শিখেরা প্রতিরোধ করেছে। চরম অন্ধকারের মধ্যেও সম্পূর্ণ মানবিকতা লোপ পায়নি মানুষের মধ্যে, যেটা আমাদের অনুপ্রানিত করে। এটা কি বিবেক অগ্নিহোত্রী সিনেমায় দেখাবেন? এগুলো তো তাঁর ন্যারেটিভের সঙ্গে মিলবে না। তিনি দেখাবেন, ভয়ঙ্কর সহিংসতা। যা প্রতিষ্ঠা করবে যে মুসলিম মানেই হল দানব। দাঙ্গার মানবিক দিকটা তিনি কখনোই তুলে ধরবেন না, কারণ এতে তাঁর নিজস্ব এজেন্ডা প্রভাবিত হবে। তাছাড়া ৭০ বছর পর এই ঘটনাটা নিয়ে সিনেমা করার পিছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? একটা দাঙ্গা থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি? আমরা যেন সেই ভুলগুলো আর না করি এবং ভবিষ্যতে আমাদের রাজনীতি যেন সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত থাকে। ধর্ম ও রাজনীতিকে যেন আলাদা করতে পারি। তা নাহলে আবার এমন সাম্প্রদায়িক হিংসা ঘটতে পারে। কিন্তু বিবেক অগ্নিহোত্রীদের লক্ষ্য হলো, পুরোনো ঘটনাটাকে নতুন করে পরিবেশন করে, তথ্যবিকৃত করা। হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে তাদের মধ্যে ঘৃণার সৃষ্টি করা। যাতে হিন্দুরা একজোট হয়ে এবং শেষ পর্যন্ত বিজেপিকে ভোট দেয়। এটাই মূল উদ্দেশ্য।

More Articles