গোপাল পাঁঠা 'হিন্দু বীর' বা 'বিপ্লবী' কোনোটাই ছিলেন না
Gopal Patha: গোপাল পাঁঠা প্রথমে পাড়ার মস্তান ছিলেন পরবর্তী সময় দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি এবং তার সঙ্গীরা সাত মাইল দূর থেকে কখনও হিন্দু মহাসভার কাছাকাছি ছিলেন না, তারা মূলত ছিলেন দক্ষিণপন্থী।
১৯৪৬-এর দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই একে অপরকে বাঁচিয়ে ছিলেন, যে ইতিহাস 'দ্য বেঙ্গল ফাইলস' কখনও বলবে না। গোপাল পাঁঠা দাঙ্গাবাজ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু 'হিন্দু বীর' ছিলেন না। পাড়ার মানুষদের হামলা থেকে বাঁচতে অস্ত্র ধরেছিলেন তিনি। গোপাল পাঁঠা নির্দিষ্ট ভাবে 'মুসলমানদের কাটব' বলেই দাঙ্গা করেননি। তিনি ছিলেন চরম দক্ষিণপন্থী এবং অ্যান্টি কমিউনিস্ট। পরবর্তীতে বামপন্থীদের সঙ্গে এই সব মস্তানরদের ঝামেলা বাধে এবং নকশাল আমলে এদের কফিনে শেষ পেরেকটা পোঁতা হয়। সেই সময়ই এরা মার খেয়ে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। এটাও ইতিহাস।
গোপাল পাঁঠাকে দু-ভাবে দেখে মানুষ। যাঁরা বামপন্থী তাঁরা গোপাল পাঁঠাকে দাঙ্গাবাজ বলেন। অন্যদিকে, আমরা দেখতেই পাচ্ছি বর্তমানে গোপাল পাঁঠাকে 'হিন্দু বীর' এমনকি বিপ্লবীও বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু তার চরিত্র আসলে বহুমাত্রিক। একটা মহল থেকে বলা হয়, হিন্দু মহাসভা এবং তার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কলকাতা শহরকে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন এবং হিন্দুদের রক্ষাকর্তা ছিলেন। কিন্তু সে সময় হিন্দু মহাসভার কলকাতায় তেমন কোনো প্রভাবই ছিল না।
গোপাল পাঁঠা প্রথমে পাড়ার মস্তান ছিলেন পরবর্তী সময় দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি এবং তার সঙ্গীরা সাত মাইল দূর থেকে কখনও হিন্দু মহাসভার কাছাকাছি ছিলেন না, তারা মূলত ছিলেন দক্ষিণপন্থী। তখন পাড়ায় পাড়ায় ছেলেদের বাহুবলী তৈরি করা হত। এঁরা পাড়ায় মাশাল ফুলিয়ে ঘুরতেন। এই সব মস্তানরা মেয়েদের অত্যন্ত সম্মান করত। গোপাল পাঁঠার দলে এও বলা ছিল মহিলাদের কখনই অসম্মান করা যাবে না।
আরও পড়ুন- কেউ বলেন ‘হিরো’, কেউ ’রাস্তার গুন্ডা’! আসলে কে এই বিতর্কিত গোপাল পাঁঠা?
একটা ইতিহাস বলি। কিছুদিন আগেই অতিবাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এক নেতার মৃত্যু হল, তাঁর নাম আমি উল্লেখ করতে চাই না। তাঁর স্ত্রী, বৌবাজার পাড়ারই মেয়ে ছিলেন। খুব বড় বাড়ির মেয়ে। তাঁরই গল্প। গোপাল পাঁঠারা রকে বসে আড্ডা দিতেন সেই সময়ই তাঁরা কোচিং থেকে পড়ে ফিরতেনা। গোপাল পাঁঠা খোঁজ নিতেন, কেউ তাঁদের বিরক্ত করেছে কিনা? মেয়েরা জবাব দিতেন, 'না'। অতপর গোপাল পাঁঠা বলতেন, 'তাহলে বাড়ি যাও মা'। পাড়ার স্বঘোষিত অভিভাবক ছিলেন তাঁরা।
এরপর যখন ৪৬-এর দাঙ্গা লাগল গোপাল পাঁঠারাও দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়লেন। এটা একদম ভুল কথা যে প্রথম দিকে এক তরফা 'হিন্দু জেনসাইড' হয়ে গিয়েছিল। আসল তথ্যটা হল, সে সময় দাঙ্গায় দু-পক্ষেরই প্রচুর মানুষ মারা গিয়েছিলেন। কলকাতার তৎকালীন কংগ্রেস নেতা বিজয় সিং নাহার বলেছিলেন, হিন্দুরাও পাড়ায় পাড়ায় প্রস্তুত ছিলেন। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালের রিপোর্ট অনুযায়ী, আহত হয়ে আসা বা নিহতদের মধ্যে প্রথম দিন মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি ছিল। এই নিয়ে সম্প্রতি র্যাডিক্যাল ইমপ্রেশন থেকে 'ফিরে দেখা ইতিহাস' নামে একটি বইও বেরিয়েছে।
৪৬-এর দাঙ্গায় গোপালবাবুর নেতৃত্বে আশেপাশের এলাকার প্রচুর বাহুবলীরাও দাঙ্গায় জড়িয়ে পরে ছিল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ভানু বোস, বুলু, সত্যেন, চিত্ত, জগা বোস, রাম চ্যাটার্জি প্রমুখ। একজন ছিল নেপালি ('চাইনিজ ডন' বলা হত)। প্রচুর পাঞ্জাবি ছেলেপুলেও গোপাল পাঁঠার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় দল আরও বড় হয়ে যায়। উল্টোদিকে গোপাল পাঁঠাদের বিরুদ্ধেও পাঠান ও বিহারী মুসলমানদের একটা বড় দল ছিল। এঁরা একদিকে এবং আর গোপাল পাঁঠারা আরেকদিকে ছিল।
আরও পড়ুন- গোপাল পাঁঠা : হিন্দুত্বের তাস না কি কলকাতা কাঁপানো মস্তান?
গোপালের সঙ্গে বিপ্লবী তকমাটা জুড়ে দেওয়ার বিষয়টা আসে ওঁর কাকার থেকে। গোপাল পাঁঠার কাকা ছিলেন অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি রডা কোম্পানির অস্ত্র লুণ্ঠনের অন্যতম নায়ক। ভূপেন্দ্র কিশোর রক্ষিত রায়ের লেখা 'ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব' এবং 'সবার অলক্ষ্যে' বইগুলি থেকে জানা যায়, অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সুরেশ চন্দ্র মজুমদার, সুপতি গুহ-র মতো বিপ্লবীরা না থাকলে বিনয়, বাদল, দীনেশ কখনও ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছতেই পারতেন না। এঁরাই মূল পরিকল্পনাকারী। রয়টার্স বিল্ডিংয়ে ঢোকার পরিকল্পনাও তাঁদেরই ছিল। গুরুত্বপূর্ণ হল, নিজেদের গোপনে রেখে তাঁরা এমনভাবে কাজ করতেন যে কোনোদিন ধরাই পরেননি। অনুকূলবাবু সে সময় বৌবাজারে একটি পাঁঠার মাংসের দোকান খোলেন। দোকানটিতে সাইন বোডে লেখা থাকত 'বাঙালির পাঁঠার মাংসের দোকান'। দোকানের পেছনে একটা গোপন ঘর ছিল সেখানেই বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়া হত। বিভিন্ন সভাও সেই ঘরেই হত। সেই দোকানের মালিকানা ছিল অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নামে। তাঁর মৃত্যুর পর দোকানের মালিকানা পান গোপালবাবু। এরপরেই ৪৬-এর দাঙ্গা। তার পর থেকেই ধীরে ধীরে গোপাল নামের সঙ্গে 'পাঁঠা' শব্দবন্ধ জুড়ে যায়।
একটা ঘটনার কথা বলি, রাজাবাজার অঞ্চলের ভিক্টোরিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ-এ হিন্দু মেয়েরাই বেশি পড়তেন। মীনা পেশোয়ারি, হাদি খান-সহ আরও অনেকে মিলে পরিকল্পনা করেছিল ওই মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ এবং খুন করা হবে। এই কলেজের উল্টোদিকে ছিল রাজাবাজার ট্রাম ডিপো। সেখানে ৭০ শতাংশই ছিল মুসলমান শ্রমিক। সে সময় তাঁরা সকলেই বেরিয়ে এসে কলেজ ঘিরে ফেলেন। দু-দিন ধরে দু-পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। ট্রাম ডিপোর ওই সব শ্রমিকরা গুন্ডাদের কলেজে ঢুকতে তো দেনইনি বরং তাঁদের খেদিয়ে দিয়েছিলেন। সেই দৃশ্যের কথা কল্পনা করলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়- পুরনো কলকাতা আর ওই কলেজ চত্বরে রাতের বেলা আগুন জ্বলছে, মুসলমান শ্রমিকরা হিন্দু মেয়েদের বাঁচাচ্ছেন। দু-দিন বাদে এক ব্রিটিশ পুলিস সার্জেন্ট সৈন্যবাহিনী নিয়ে সেখানে আসেন। ওই সার্জেন্ট শ্রমিকদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কিসনে বাচায়া লারকি লোগোঁকো? কওন খাড়া থা? তার জবাবে শ্রমিকরা ট্রাম কোম্পানির ইউনিয়ন রুমের মাথায় উড়তে থাকা লাল পতাকার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন, 'হাম নাহি সাব, উও লাল ঝাণ্ডা খাড়া থা'। আজ 'দ্য বেঙ্গল ফাইলস' তৈরি করে এই ইতিহাসগুলো ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন)
Whatsapp
