আজীবন বিনেপয়সায় রোগী দেখেছেন, বাঙালির হৃদয়ে আজও আসন পাকা বিধান রায়ের
Bidhan Chandra Roy: ভোর ছ’টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করতেন। দুপুরে বিশ্রাম নিতেন ঘন্টাখানেক। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও কলকাতায় থাকলে রোজ সকালে নিজের বাড়িতে বিনা পয়সায় ১৬ জন করে রোগী দেখতেন বিধানচন্দ্র রায়।
“আমি গণতন্ত্র, সমাজন্ত্র বুঝি না। শুধু বুঝি, সাধারণ মানুষকে কত বেশি সুবিধা দেওয়া যায়।” স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। চিকিৎসক হিসাবেও তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। অনেকেই তাঁকে ধন্বন্তরির সঙ্গে তুলনা করতেন। কথা হচ্ছে ডঃ বিধান চন্দ্র রায়কে নিয়ে। একাধারে দক্ষ চিকিৎসক, অন্যদিকে কঠোর প্রশাসক। ভোর ছ’টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করতেন। দুপুরে বিশ্রাম নিতেন ঘন্টাখানেক। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও কলকাতায় থাকলে রোজ সকালে নিজের বাড়িতে বিনা পয়সায় ১৬ জন করে রোগী দেখতেন বিধানচন্দ্র রায়।
১৮৮২ সালে ১ জুলাই বিহারের বাঁকিপুরে জন্ম। বাবা প্রকাশচন্দ্র সরকারি চাকরিতে উচ্চপদ পেয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম জীবনে অর্থাভাব ও নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তেমনই বিধানচন্দ্র রায়ও নানা ওঠা পড়া দেখেছেন তাঁর প্রাথমিক জীবনে। ১৮৯৭ সালে পাটনা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে ১৮৯৯ সালে পাটনা কলেজ থেকে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন বিধানচন্দ্র রায়। সেখান থেকেই অঙ্কে অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করে ১৯০১ সালে কলকাতায় আসেন তিনি। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর এক নতুন লড়াই।
বিধানচন্দ্র রায়ের বড়দা ছিলেন ব্যারিস্টার এবং মেজদা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। তিনিও চাইতেন কোনও পেশাদার ডিগ্রি। তাই কলকাতায় এসে একইসঙ্গে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির আবেদন করেন। ভাগ্যচক্রে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ভর্তির তালিকা আগে বের হয় এবং তিনি সেখানেই ভর্তি হন। ইতিহাস রচনার শুরু এখান থেকেই। বিধান যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তাঁর বাবা অবসর নেন। ফলে নিজের খরচ জোগাতে কখনও বেসরকারি নার্সিং হোমে পুরুষ নার্স, কখনও বড় ডাক্তারের সহায়ক-ছাত্র হিসেবে কাজ করতেন। মেডিক্যাল কলেজে বিধানচন্দ্রের আদর্শ ছিলেন অধ্যাপক কর্নেল লিউকিস। যিনি তাঁকে বলেছিলেন, “কোনো সাহেবের সামনে একটু মাথা নোয়ালে, দ্বিগুণ নত করতে চাইবেন তিনি”। অধ্যাপক লিউকিসের এই কথা মাথায় রেখে চলতেন বিধানচন্দ্র রায়। স্বদেশে এমনকি বিদেশে পড়তে গিয়েও পদে পদে ইংরেজদের দ্বারা হেনস্থা হয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন- ভুলতে পারেননি নিজের প্রথম প্রেমিকাকে, এই শহরের নামে তাঁকে অমর করে গেলেন বিধান চন্দ্র রায়
ন্যায়ের পক্ষে থাকার মাশুলও গুনতে হয়েছে বিধানচন্দ্র রায়কে। মেডিক্যাল কলেজের গেটের সামনে অধ্যাপক পিক-এর ঘোড়ার গাড়িকে ধাক্কা মারে ট্রাম। ওই সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। পরে অধ্যাপক পিক সাক্ষ্য দিতে বলেন তাঁকে। পিক চেয়েছিলেন বিধানচন্দ্র বলুন, দোষ ট্রামের। কিন্তু বিধানচন্দ্র রায় তাতে রাজি হননি। তিনি সাফ জানিয়ে দেন যে, তিনি যা দেখেছেন তাই বলবেন, দোষ ঘোড়ার গাড়ির ছিল। এতেই চটে যান অধ্যাপক পিক। এমবি-র পরীক্ষায় পাস মার্কস দেন না তাঁকে।
এরপর অধ্যাপক লিউকিসের পরামর্শে এলএমএস পরীক্ষায় বসেন বিধানচন্দ্র রায়। তারপর এমডি করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত যাওয়া। এখানেও লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। দুই শয্যার কেবিনে সাহেব সহযাত্রীর সঙ্গে ‘নেটিভ বেঙ্গলি’কে যেতে দিতে রাজি ছিল না জাহাজ সংস্থা। কিন্তু বিধানচন্দ্র রায়ও নাছোড়বান্দা। শেষমেষ ১৯০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লন্ডন রওনা হন তিনি। সেন্ট বার্থোলোমিউস কলেজে ভর্তির জন্য বিধানকে সুপরিশপত্র লিখে দিয়েছিলেন সেই কলেজের প্রাক্তনী এবং কলকাতা মেডিক্যালের অধ্যপক লিউকিস। কিন্তু সেখানকার ডিন জানিয়ে দেন যে বিধানকে সেখানে পড়তে দেওয়া হবে না। কিন্তু শেষমেষ বিধানের একগুঁয়েমির চাপে ভর্তি নেন তাঁকে। এরপর খুবই অল্প সময়ের মধ্যেই বিদেশের উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ত্ত করে নেন তিনি। মাত্র দু’বছরের মধ্যেই একইসঙ্গে এমআরসিপি (মেডিসিন) এবং এফআরসিএস (শল্য চিকিৎসা) ডিগ্রি লাভ করেন বিধানচন্দ্র রায়। এরপর ফিরে আসেন দেশে।
১৯১১ সালে কলকাতায় ফিরে হ্যারিসন রোড (বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড)-এ বাড়ি ভাড়া নেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপক হওয়ার বাসনা নিয়ে যোগাযোগ করেন তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশের সার্জন জেনারেলের সঙ্গে। কিন্তু তখন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপকের পদ শুধু ইংরেজরাই পেত। ফলে বিধানচন্দ্র রায়কে জেলায় মেডিক্যাল অফিসার নতুবা ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুলের শিক্ষক হওয়ার জন্য বলা হয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনার সুযোগ না পেলেও বাইরে চিকিৎসক হিসেবে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে বিধানচন্দ্রের। যেমন রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা, তেমনই রোগ চিহ্নিত করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। মহাত্মা গান্ধীর চিকিৎসা করতেন বিধানচন্দ্র রায়ই। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জওহরলাল নেহরু, রাজেন্দ্রপ্রসাদের মতো ব্যক্তিরাও ছিলেন তাঁর রোগীর তালিকায়।
আরও পড়ুন- বিধানচন্দ্র রায় থেকে জ্যোতি বসু, এই মডেলের ফিয়াট পছন্দ ছিল সকলেরই
চিকিৎসক হিসেবেই জনপ্রিয় হয়েছেন প্রথমে, বলতে গেলে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে ছিলেন না বিধানচন্দ্র রায়। খাতায়-কলমে রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ ১৯২৩ সালে বঙ্গীয় বিধান পরিষদের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে। ব্যারাকপুর কেন্দ্র থেকে থেকে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। তিন হাজারেরও বেশি ভোটে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়ে পা রাখেন পরিষদীয় রাজনীতিতে। এরপর ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে পরিষদীয় পদ ছেড়ে দেন বিধানচন্দ্র রায়। তবে ততদিনে তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯২৮ সাল থেকেই কংগ্রেসে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন তিনি। আইন অমান্য আন্দোলনের সময় জেলেও গিয়েছিলেন। পরের বছরই কলকাতার মেয়র পদের জন্য বিধানচন্দ্রের নাম প্রস্তাব করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, বেকারত্ব, খাদ্য সঙ্কট- এমনই এক অস্থির সময়ে বাংলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। দক্ষতার সঙ্গে পালনও করেছেন সেই দায়িত্ব। বহু জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু হয় তাঁরই আমলে। রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ থেকে কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ, হরিণঘাটা সরকারি দুগ্ধ প্রকল্প, ব্যান্ডেল ও দুর্গাপুর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি রয়েছে সেই তালিকায়। কলকাতার উপর চাপ কমাতে তিনি তৈরি করেছিলেন কল্যানী ও সল্টলেক শহর। ডিভিসি, দুর্গাপুর ব্যারেজ তৈরি বিধনাচন্দ্রের আমলেই। তাঁর উদ্যোগেই দুর্গাপুরে গড়ে উঠেছে ইস্পাত কারখানা ও শিল্প নগরী। যাদবপুরের যক্ষ্মা হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন সেবাসদন সবই তাঁর উদ্যোগেই। বেসরকারি শিল্পের প্রসারও হয়েছিল তাঁর আমলে। হিন্দুস্থান মোটরস থেকে গ্লুকোনেট বহু কোম্পানি রয়েছে সেই তালিকায়। তাঁরই ভাবনার ফসল হলদিয়া শোধনাগার।
১৯৬১ সালে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া হয় তাঁকে। তখন তিনি অসুস্থ। কিন্তু কাজ থামাননি। ১৯৬২ সালে জন্মদিনের দিন দুপুর ১২টায় ওয়েলিংটন স্ট্রিটের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিধানচন্দ্র রায়। জন্মদিনের শুভেচ্ছাপ্রাপ্ত ফুলেই বিদায় সংবর্ধনা পান। তাঁর স্মরণে ১ জুলাই পালিত হয় জাতীয় চিকিৎসক দিবস।