গুজরাত দাঙ্গার লজ্জার অতীত ভুলিয়ে দিতেই ছাড়া পেল ধর্ষকরা? প্রশ্নে দু'ভাগ দেশ
বিলকিস বানোকে ধর্ষণই নয়, তাঁর দুই বছরের শিশুকন্যা-সহ পরিবারের ১৪ জনকে সেদিন খুন করেছিল হিন্দু গুন্ডারা। এই নৃশংস হত্যায় কীভাবে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মুক্তির সিদ্ধান্ত নিল গুজরাত সরকার, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
স্বাধীনতার ৭৫ বছরে গুজরাত দাঙ্গার সময় বিলকিস বানোর গণধর্ষণে অভিযুক্ত ১১ বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় গুজরাত সরকার। গোধরা জেলের বাইরে মিষ্টিমুখ করিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয় ১১ অভিযুক্তকে। কেবল বিলকিস বানোকে ধর্ষণই নয়, তাঁর দুই বছরের শিশুকন্যা-সহ পরিবারের ১৪ জনকে সেদিন খুন করেছিল হিন্দু গুন্ডারা। এই নৃশংস হত্যায় কীভাবে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মুক্তির সিদ্ধান্ত নিল গুজরাত সরকার, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কী হয়েছিল বিলকিস বানোর সঙ্গে?
২০০২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি। গুজরাতে শুরু হয়েছে ভয়াবহ দাঙ্গা। সবরমতী এক্সপ্রেসে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে কয়েকশো করসেবকের। এই পরিস্থিতিতে গুজরাতের রাধিকাপুরের বিলকিস বানো অশান্তির ভয়ে গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় পালানোর চেষ্টা করছিলেন। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিসের সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই বছরের শিশুকন্যা এবং পরিবারের মোট ১৫ জন সদস্য।
তার ঠিক দুই দিন বাদে ৩ মার্চ ছাপ্পারবাদ জেলায় প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বিলকিস ও তাঁর পরিবার। এখানেই ২০ থেকে ৩০ জনের একটি সশস্ত্র দল তাঁদের লাঠি, তলোয়ার নিয়ে আক্রমণ করে। আক্রমণের ফলে বিলকিসের শিশুকন্যা-সহ পরিবারের ১৪ জন মারা যায়। বিলকিস নির্মমভাবে গণধর্ষণের শিকার হন। দীর্ঘ সময় ওই অবস্থায় পড়ে থাকার পর যখন বিলকিসের জ্ঞান ফেরে, তিনি সাহায্যের জন্য এক আদিবাসী মহিলার কাছ থেকে পোশাক ধার করে লিমখেদা থানায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। থানায় উপস্থিত পুলিশ অফিসাররা বিলকিসের প্রাণনাশের হুমকির কথা স্মরণ করিয়ে অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। এরপরে শুরু হয় বিচারের আশায় বিলকিস বানোর লড়াই। প্রথমে ভারতের মানবাধিকার কমিশন ও পরে ভারতের শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হন বিলকিস। বিলকিসের আবেদনে সাড়া দিয়ে গোটা ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
আরও পড়ুন: মুক্তি পেয়ে যায় ধর্ষকরা, হিংসা-পাচারের অন্ধকারে কেমন আছে ভারতীয় মেয়েরা?
ক্ষমতাশীল অপরাধী ও বিচারের ১৫ বছর
বিলকিস বানো গণধর্ষণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রত্যেকেই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের অংশ ছিল এবং তার সক্রিয় সদস্য হিসেবেই বিধর্মী বিলকিসের ওপর তারা নামিয়ে এনেছিল এই নৃশংস অত্যাচার। সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিলেও বিজেপিশাসিত গুজরাতে ধর্মে ‘মুসলিম’ বানোকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। তদন্ত চলাকালীন প্রাণনাশের হুমকির মুখে পড়ে দুই বছরে প্রায় ২০ বার বাড়ি বদলাতে বাধ্য হয়েছিলেন বিলকিস ও তাঁর স্বামী। এরপরেই সুপ্রিম কোর্টের কাছে মামলা গুজরাত থেকে দেশের অন্য আদালতে সরিয়ে দেওয়ার আর্জি জানান বিলকিস। ২০০৪ সালের অগাস্টে বিলকিসের আবেদন মেনে নিয়ে কেস গুজরাত থেকে মুম্বই হাই কোর্টে সরিয়ে দেয় শীর্ষ আদালত।
২০০৮ সালের জানুয়ারিতে মোট ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয় সিবিআই। তার মধ্যে ছিলেন ছ'জন পুলিশ অফিসার এবং একজন সরকারি ডাক্তার। শুনানি চলাকালীন বিলকিস আদালতে জানান, তিনি সকল অভিযুক্তকেই ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। প্রায় ১০ বছর ধরে বিচার চলার পরে ২০১৭ সালের মে মাসে বিলকিস বানোকে গণধর্ষণে অভিযুক্ত ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় বম্বে হাই কোর্ট। ২০১৯ সালে আদালত বিলকিস বানোকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয় গুজরাত সরকারকে।
দোষী কারা?
যশবন্ত নাই, গোবিন্দভাই নাই এবং নরেশকুমার মরধিয়া বিলকিসকে ধর্ষণ করে। অন্য আরেক অভিযুক্ত শৈলেশ ভাট খুন করে বিলকিসের দুই বছরের শিশুকন্যাকে। ধর্ষণ ও খুনে সহায়তা করেছিলেন রাধেশ্যাম শাহ, বিপিনচন্দ্র যোশী, কেশরভাই বোহানিয়া, প্রদীপ বোহানিয়া, বাকাভাই বোহানিয়া, রাজুভাই সোনি, নীতেশ ভাট, রমেশচন্দ্র এবং লিমখেদা পুলিশ স্টেশনের হেড কনস্টেবল সোমাভাই গরি।
কেন মুক্তি পেল অপরাধীরা?
বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের মধ্যে অন্যতম অভিযুক্ত রাধেশ্যাম শাহ কারামুক্তির আশায় গুজরাত হাই কোর্টে আবেদন করেন। রাধেশ্যামের আবেদন খারিজ করে কোর্ট জানায়, এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে মহারাষ্ট্র সরকার। এরপরে সুপ্রিম কোর্টে লিখিত আবেদন করে শাহ জানায়, সে ১৫ বছর ৪ মাস ধরে জেল খাটছে। যেন তার মুক্তির আবেদন বিবেচনা করে শীর্ষ আদালত। ১৩ মে সুপ্রিম কোর্ট মামলার রায় দিতে গিয়ে জানায় যেহেতু গুজরাতে ঘটনাটি ঘটেছিল, তাই গুজরাত সরকারই বিবেচনা করবে দোষীদের মুক্তির ব্যাপারে। সেই সঙ্গে শীর্ষ আদালত জানায়, গুজরাত সরকার যেন ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে তাদের ১৯৯২ সালের পুরনো বন্দিমুক্তি নীতি মেনে চলে।
২০২২ সালের জুন মাসে স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উদযাপন ও ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ উপলক্ষে বন্দিমুক্তির বিষয়ে নতুন নিয়ম চালু করে কেন্দ্রীয় সরকার। সেখানে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রের অভিযুক্তদের মুক্তি না দেওয়ার উল্লেখ করে কেন্দ্র। তার মধ্যে অন্যতমভাবে বলা হয়েছে ‘যেসব বন্দি ধর্ষণ, পাচার ও পকসো আইনে অভিযুক্ত, তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ মুক্তির ব্যবস্থা করা যাবে না।'
কিন্তু ১৫ অগাস্ট গুজরাত সরকারের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব রাজকুমার এই ১১ জন দোষীর মুক্তি প্রসঙ্গে বলেন, "১১ জন অভিযুক্ত ইতিমধ্যেই ১৪ বছর জেল খেটেছে। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী, যাবজ্জীবন মানে ১৪ বছরের জেল খাটাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। এরপরেই একজন বন্দি সরকারকে নিজের মুক্তির ব্যাপারে আবেদন জানাতে পারেন। তারপর সেই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।"
গুজরাত সরকারের এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই সতর্ক হওয়ার জায়গা থেকে দেখছেন। এখনও অবধি গুজরাত দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত বহু মানুষ বিচারের অপেক্ষা করছেন। কিছুদিন আগেই আমেদাবাদের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গুজরাত দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের উসকানি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে মানবাধিকার কর্মী তিস্তা শীতলাবাদকে। তারপরেই গুজরাত দাঙ্গায় দোষী আরও ১১ জনের মুক্তি বুঝিয়ে দিচ্ছে গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চায় না সরকার, পাছে ‘সরষের মধ্যে থেকে ভূত’ বেরিয়ে পড়ে।