খেটে খাওয়া মানুষের কবি, এই অসময়ে বাঙালির দরকার ছিল একজন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
Birendra Chattopadhyay: তাঁর কবিতা সময়ের বাঁকে দাঁড়িয়ে হয়ে উঠেছে সমাজের প্রতিচ্ছবি। প্রান্তিক মানুষ, শ্রমজীবী, কৃষিজীবী, মেহনতি মানুষের কথা এসেছে তাঁর লেখনীতে। খেটে খাওয়া মানুষের বোধের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন কবিতাকে।
'গাঙুরের জলে ভাসে বেহুলার ভেলা
দেখি তাই, শূন্য বুকে সারারাত জেগে থাকি---
আমার স্বদেশ করে কাগজের নৌকা নিয়ে খেলা।'
আজও তাঁর কবিতার পঙক্তি মুখে মুখে ঘোরে মানুষের। কবিকে কোনও নির্দিষ্ট সময় সীমাতে বেঁধে ফেলা যায়। তিনি রয়ে যান প্রতিটি যুগের প্রজন্মের কাছে ।কাঁধে ঝোলা, পাঞ্জাবি, মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরা ছিল তাঁর সিগনেচার স্টাইল। সাদামাটা এই পোশাকেই কাটিয়েছেন আজীবন। কলমে শব্দ বোনার নেশার পাশাপাশি ছিল আরও কিছু অভ্যেস, ভালোবাসতেন বিড়ি, সিগারেট চা। ভালোবাসতেন মুড়ি ও জিলিপি। বাংলার এপার-ওপারে ভাগ হলেও তিনি মনে প্রাণে বাংলাকে এক হিসেবেই বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি কথোপকথন করতেন বাঙাল ভাষাতেই। চশমা, চটি, কলম, ছাতা হারাতেন প্রায়ই। কবিতা মাথায় এলে হাতের কাছে যা পেতেন-- সিগারেটের প্যাকেট বা বাসের টিকিট--- লিখে রাখতেন তাতেই। তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। জীবন যাপনে, নিজের আদর্শ, স্বাধীনতা ও সততার প্রতি দায়বদ্ধতায় অন্য কারও সঙ্গে যাঁর মেলে না। তাই তাঁর ১০৩তম জন্মদিনে এসে স্মরণ করি তাঁকে। তাঁর কবিতা সময়ের বাঁকে দাঁড়িয়ে হয়ে উঠেছে সমাজের প্রতিচ্ছবি। প্রান্তিক মানুষ, শ্রমজীবী, কৃষিজীবী, মেহনতি মানুষের কথা এসেছে তাঁর লেখনীতে। খেটে খাওয়া মানুষের বোধের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন কবিতাকে।
নিজের জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে তাঁকে পেরিয়ে যেতে হয়েছে চরম প্রতিকূলতা। অভাব হয়েছে তাঁর চির সঙ্গী। দরজায়-দরজায়, মেলায়, গ্রামে ঘুরে ঘুরে নিজের বই বিক্রি করেছেন। ত্রিশ বছর ধরে এ ভাবেই কেটেছে। বইমেলাতেও দেখা যেত, নিজের বই নিজেই বিক্রি করছেন। মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচার কথা বলেছেন তিনি। অসংখ্যবআর কর্মহীন হয়েও কারও দরজায় হাত পাতেননি। বিভিন্ন সময়ে নানান কাজ করেছেন। প্রতিনিয়ত অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। তবু সরকারি বৃত্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতাকে তীব্র শ্লেষ করে এক বার লিখেছিলেন, ‘রাজা আসে যায়/ রাজা বদলায়।’ আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর। বলতেন, কবি যত শক্তিমানই হোন, তাঁকে ভালো মানুষও হতে হবে।
প্রথম যখন লিখতে শুরু করেন,তাঁকে কবিতা লেখাতে উৎসাহ দেন বিমলচন্দ্র ঘোষ এবং অরুণ মিত্র। কলেজে শিক্ষক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে। সুভাষচন্দ্র বসু তখন তাঁর জীবনের প্রেরণা। ঋত্বিক ঘটকের মতোই দেশভাগ তাঁকে আলোড়িত করেছিল। আক্ষেপ করেছিলেন, ‘আমার জন্মভূমিকে এখন আমি স্বদেশ বলতে পারি না।’ দেশভাগ হয়ে গেছে আজ ৭৫বছর হল! তবুও সেই কান্না চাপা আবেগ, বাপ-ঠাকুরদার ভিটেকে স্বদেশ বলতে না পারার ব্যথা অনুভব করেন বহু পাঠকই।
দেশভাগ থেকে শুরু করে ১৯৫৯-এর খাদ্য আন্দোলন, ’৬১-র নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল-বিরোধী আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ’৬৬-র খাদ্য আন্দোলন, ’৬৭-র মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আইন অমান্য, জেল, জরুরি অবস্থা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, নকশালবাড়ি আন্দোলন তাঁর কবিতার ভাষাকে বদলাতে শুরু করে। যার চূড়ান্ত অভিঘাত ছিল ১৯৭৭-এর বন্দিমুক্তি আন্দোলন। কবিতা থেকে মিছিলে, তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রতিবাদের কণ্ঠ স্বর।লিখেছিলেন, ‘ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে/ যদি আমি মাটিকে জানতাম!’ দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার চিহ্ন রয়েছে তাঁর কবিতার পরতে পরতে। যদিও তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন প্রেম ও স্মৃতিচারণার মাধ্যমে। ক্রমে তাঁর কবিতায় মূল বিষয় হয়ে উঠতে থাকে মানুষ আর দেশ। মুখোশ পরা মানুষ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে লিখেছিলেন, ‘আসলে মুখোশ মোটেই বাইরের নয়। বরং ভিতরে/ যাকে আমরা সত্যিকারের মুখ ভাবি/ তেমন কিছুই মানুষের নেই।’ ক্ষুধার্ত মানুষ রাতের আকাশে পায় ‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ'।
কখনও সখনও কারণ বিবেচনা করে উপস্থিত থাকতেন বামপন্থীদের রাজনৈতিক মিটিং-এ। ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। বলতেন, ‘‘নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করি। কোনও তত্ত্বই আমি কোনও দিনই তেমন বুঝিনি।’’ তিনি ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের কবি। দলীয় মতাদর্শের থেকেও তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল মাটি ঘেষা মানুষের প্রতি। তাঁর কবিতায় ছড়িয়ে আছে লোকায়ত বাংলার চিত্রকল্প। তাঁর ভাষায়, ‘আধুনিক সভ্যতার কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি, কিন্তু...আমাদের আত্মাকে হারিয়েছি। আমাদের বুকের মধ্যে প্রেম আর বাঁশির মতো, মাদলের মতো নিজে থেকে বাজে না।’ লিখে গেছেন সেই বোকা মানুষের কথা, সার্কাসের ক্লাউন বা যাত্রাদলের রাজা সাজার ক্ষমতা যার নেই। তিনি মনে করতেন প্যাশন, দেখার চোখ ও মনন থাকলে সেই কবির কবিতা পাঠকে টানবেন। সহজ শব্দে তিনি তাই আজীবন বলে গেছেন জীবনের কথা। সঙ্গে সঙ্গে মনে প্রত্যাশার প্রদীপ জ্বালিয়েছেন নতুন আরম্ভের। তাই তো লিখেছিলেন,
'তার ঘর পুড়ে গেছে
অকাল অনলে ;
তার মন ভেসে গেছে।
প্রলয়ের জলে।
তবু সে এখনাে মুখ
দেখে চমকায়,
এখনাে সে মাটি পেলে
প্রতিমা বানায় ।'
ঋণ: বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা

Whatsapp
