হাই ভোল্টেজ প্রচারও ব্যর্থ! মোদির ম্যাজিকে কেন আস্থা নেই হিমাচল প্রদেশের?

Himachal Pradesh Election Congress: গুজরাতবাসী ভূমিপুত্র মোদির সঙ্গে আবেগের টান অনুভব করলেও, হিমাচলবাসী মোদির সেই ডাকে সাড়া দেননি।

রেকর্ড সংখ্যক আসনে জয়ী হয়ে বিজেপি ফের গুজরাতে সরকার গড়ার পথে। জয়ের নেপথ্যে থাকা ‘মোদি ম্যাজিকে’রও উল্লেখ উঠে আসছে বার বার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রচার সত্ত্বেও হিমাচল প্রদেশে হার নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাতে নারাজ বিজেপি। বরং পালা করে ভিন্ন দলের ক্ষমতায় আসার নজিরকেই পরাজয়ের কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করছে তারা। কিন্তু হিমাচলে বিজেপির পরাজয়ের নেপথ্য কারণ শুধুমাত্র পালা করে শাসক বদলের রীতিই নয়। ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি, সাংগঠনিক দুর্বলতাই সেখানে পরাজিত করেছে তাদের।

হিমাচলপ্রদেশের মোট জনসংখ্যা ৬৮.৬ লক্ষ। ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী, রাজ্যের ১২টি জেলার মধ্যে ১১টিই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ, ৯৭.১৭ শতাংশ। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ১.৫০ লক্ষ মুসলিম, ২.১৮ শতাংশ। হিমাচলে শিখ জনসংখ্যা ৭৯ হাজার ৮৯৬ (১.১৬ শতাংশ), বৌদ্ধ জনসংখ্যা ৭৮ হাজার ৬৫৯ (১.১৫ শতাংশ), খ্রিস্টান জনসংখ্যা ১২ হাজার ৬৫ হাজার (০.১৮ শতাংশ) এবং জৈন জনসংখ্যা ১ হাজার ৮০৫ (০.০৩ শতাংশ)। তবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য হলেও, দলিত জনসংখ্যার হারে পঞ্জাবের পরই স্থান হিমাচলের। রাজ্যের ৬৮.৬ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে ১৭ লক্ষ ২৯ হাজার ২৫২, অর্থাৎ ২৫.১৯ শতাংশই দলিত সম্প্রদায়ের।

এ বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে হিমাচলে ধর্মান্তরণকে হাতিয়ার করে প্রচারে নামে বিজেপি। অগাস্ট মাসে হিমাচল প্রদেশ ধর্মীয় স্বাধীনতা (সংশোধনী) বিল ২০২২ পাস হয় সেখানে। কিন্তু হিমাচলে ধর্মান্তরণের যত ঘটনা সামনে এসেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছেন, তাও আবার স্বেচ্ছায়। তাঁদের দাবি, হিমাচলে সামাজিক বৈষম্যের শিকার দলিতরা। মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি নেই তাঁদের। বিলাসপুরে মার্কণ্ডেয় মন্দির চত্বরে ‘দলিত প্রবেশ নিষিদ্ধ’ ব্যানারও ঝুলতে দেখা গিয়েছে। এমনকী দলিত শিশুদের স্কুলে মিড ডে মিল দেওয়ার ক্ষেত্রেও বৈষম্য করা হয়। তাই যে ধর্মে তাঁদের সমাজে সসম্মানে বাঁচার অধিকারই নেই, সেই ধর্ম আঁকড়ে পড়ে লাভ কী, প্রশ্ন দলিতদের।

আরও পড়ুন- জয় করে তবু ভয়! বিজেপির ঘোড়া কেনাবেচার কাছে ফের হারবে হিমাচলের কংগ্রেস?

হিমাচলে বিজেপির সংগঠনের অবস্থাও তথৈবচ। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা হিমাচলের সাংসদ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর হিমাচলেরই ভূমিপুত্র। তাঁর বাবা প্রেমকুমার ধুমল দু’দফায় হিমাচলের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। এমনকী বাবার সরকারের কাজের প্রশংসা করতে গিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় চোখের জলও ফেলেন অনুরাগ। ২০১২-র নির্বাচনে প্রেমকুমারকে পরাজিত করেন কংগ্রেসের বীরভদ্র সিংহ। এবার তাই প্রেমকুমারকে টিকিটই দেয়নি বিজেপি। তাই অনুরাগের কান্নার আসল কারণ বাবার টিকিট না পাওয়া বলে ব্যাখ্যা করেন বিজেপিরই কেউ কেউ। এমনকী অনুরাগ হিমাচলের মুখ্যমন্ত্রী হতেও আগ্রহী ছিলেন বলেও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু অনুরাগের জন্মস্থান হামিরপুরের পাঁচটি আসনেই এবার পরাজিত হয়েছে বিজেপি।

নির্বাচনী প্রচারে দলবাজিরও অভিযোগ ওঠে। হিমাচল বিজেপিতে অনুরাগ, নাড্ডা এবং বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুর অনুগামীরা পৃথক প্রচার চালান। তাতে শেষ পেরেক পুঁতে দেন বিজেপিরই বিদ্রোহী বিধায়করা। কমপক্ষে ৯টি আসনে সরাসরি প্রাক্তন বিজেপি এবং অধুনা বিজেপি প্রার্থীর মধ্যে লড়াইয়ের সুফল তোলে কংগ্রেস। তাই নাড্ডা (কমপক্ষে ৫০টি জনসভা), উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ (২০টি জনসভা) এবং খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদির (৫টি জনসভা) মতো হাই প্রোফাইল নেতাদের প্রচারে নামিয়েও ধরাশায়ী হতে হয়েছে বিজেপিকে। ৬৮ আসনের বিধানসভায় গতবারের প্রাপ্ত ৪৪ আসন থেকে এবার ২৬-এ নেমে গিয়েছে তারা।

হিমাচলে সাংগঠনিক দুর্বলতা অজানা ছিল না বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। তাই প্রচারে গিয়ে মোদিকে বলতে শোনা যায়, ‘‘একটা কথা মনে রাখুন, বিজেপির প্রার্থী কে? কারও মনে রাখতে হবে না। শুধু পদ্ম সাজিয়ে রাখুন মনে। ভোট দেওয়ার সময় পদ্ম দেখে শুধু বুঝে নেবেন, সেটাই বিজেপি, সেটাই মোদি। পদ্মের বোতামে আঙুল রাখার অর্থই সরাসরি মোদির অ্যাকাউন্টে ভোট জমা করা।’’ কিন্তু গুজরাতবাসী ভূমিপুত্র মোদির সঙ্গে আবেগের টান অনুভব করলেও, হিমাচলবাসী মোদির সেই ডাকে সাড়া দেননি। তাই দলের প্রচার কৌশলের হিসেব-নিকেশে ভুল ছিল বলে মনে করছেন হিমাচলের বিজেপি কর্মীরাই।

আরও পড়ুন- আপই কি নয়া ‘কংগ্রেস’? গুজরাত নির্বাচন যে প্রশ্ন তুলে ধরছে বারবার

হিমাচলের বিজেপি কর্মীদের মতে, নির্বাচনে তাঁদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে স্থানীয় সমস্যাগুলিকে না বোঝায়। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে হিমাচলে জিতেত উদ্যত হয়েছিল দলীয় নেতৃত্ব। উল্টোদিকে, ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলকে সঙ্গে নিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী দরজায় দরজায় পৌঁছনোর উপরই বেশি জোর দিয়েছিলেন। পুরনো পেনশন প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে, সেনার ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্প নিয়ে, বেকারত্ব নিয়ে মানুষের অভাব-অভিযোগকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কা। নির্বাচনী ইস্তেহারেও তাই ক্ষমতায় ফিরলে পুরনো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয় কংগ্রেস। হিমাচলের ভোটারদের ৫ শতাংশই সরকারি কর্মী। তাই তাঁদের সমর্থন পেতে সমস্যা হয়নি কংগ্রেসের। হিমাচলে আদানি অ্যাগ্রোফ্রেশের বিরুদ্ধে আপেল চাষিদের কাছ থেকে কম টাকায় আপেল কেনার অভিযোগও রয়েছে ভূরি ভূরি। তার উপর আপেলের কার্টনের উপর জিএসটি বসিয়েছে কেন্দ্র। অথচ আপেল চাষিদের সুরাহায় এগিয়ে আসেনি রাজ্য এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তাই তাঁদের ভোটও কংগ্রেসের পক্ষে গিয়েছে বলে মত হিমাচল বিজেপির কর্মীদের।

এ যাবৎ হিমাচলে পালা করে ক্ষমতায় থেকেছে কংগ্রেস এবং বিজেপি। এবার সেখানে নির্বাচনী দৌড়ে নাম লেখায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টিও। মহিলাদের মাসিক ভাতা থেকে কর্মসংস্থান, কম প্রতিশ্রুতি দেয়নি আপ। কিন্তু একটি আসনও হিমাচলে জিততে পারেনি আপ। পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলের রীতি হিমাচল থেকে বিলুপ্ত হবে, তাদের সরকারই ফের ক্ষমতায় আসবে বলে নির্বাচনী প্রচারে বার বার আস্ফালন করতে দেখা গিয়েছিল বিজেপি নেতাদের। কিন্তু পরাজয় বা তার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি তাঁদের কাউকে। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী মাথা পেতে মানুষের রায় মেনে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। মোদি ধন্যবাদ জানিয়েছেন হিমাচলবাসীকে। আগামী দিনে মানুষের সমস্যাগুলি তুলে ধরার কথা জানিয়েছেন। গুজরাতের জয়ে হিমাচলে বিজেপির পরাজয় কার্যতই ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে।

 

More Articles