আপই কি নয়া 'কংগ্রেস'? গুজরাত নির্বাচন যে প্রশ্ন তুলে ধরছে বারবার

Arvind Kejriwal AAP: 'দিল্লির লাড্ডু' পৌঁছে দিয়েছেন গুজরাতের কোটি কোটি জনতার মধ্যে। প্রথমবারের লড়াইয়ে রাজ্যজুড়ে প্রায় ১২.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন আম আদমি দলের প্রার্থীরা।

মমতা, রাহুল নাকি নীতিশ! কে হবেন মোদি-বিরোধী মুখ! আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগের 'সেমিফাইনালে'র ফলাফলের গতিবিধি ফের প্রশ্ন তুলে দিয়েছে একাধিক। 'কংগ্রেস মুক্ত ভারতে'র স্লোগানের সঠিক পথ প্রশস্ত হলেও মোদির বিপক্ষে কে? এই প্রশ্নেই ফের উঠে এসেছে আম আদমি দলের নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের (Arvind Kejriwal) নাম।

'কংগ্রেস মুক্ত ভারত' এবং কংগ্রেসের বিকল্প আপ! এই জল্পনায় উসকে দিয়েছেন দিল্লির এই 'মাফলার ম্যান'! দিল্লির রাজপথে-পুরসভার অলিন্দে ১৫ বছর পর ইতিহাস গড়ার পরের দিনই মোদির রাজ্য গুজরাতেও রুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি। প্রথমবার ভোট-ময়দানে নেমেই ছিনিয়ে নিয়েছেন ৫টি আসনে জয়। অনেকেই বলছেন, কংগ্রেসের ভোট কেটে সাহায্য করেছেন বিজেপি-কে! আবার কেউ কেউ বলছেন, নরেন্দ্র মোদির সামনে কড়া চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন কেজরিওয়াল। যাঁকে ঘিরে বিজেপি-র গুজরাত নির্বাচনের নেপথ্য-নায়ক অমিত শাহের (Amit Shah) ভবিষ্যতবাণী ছিল, ''গুজরাতে খাতা খুলতে পারবে না আপ (AAP)!''

তিনি পেরেছেন। খাতা খুলেছেন। গুজরাতে প্রথম লড়াইয়েই পাঁচ আসনে জিতেছে কেজরিওয়ালের দল। 'দিল্লির লাড্ডু' পৌঁছে দিয়েছেন গুজরাতের কোটি কোটি জনতার মধ্যে। প্রথমবারের লড়াইয়ে রাজ্যজুড়ে প্রায় ১২.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন আম আদমি দলের প্রার্থীরা।

আরও পড়ুন : জয় করে তবু ভয়! বিজেপির ঘোড়া কেনাবেচার কাছে ফের হারবে হিমাচলের কংগ্রেস?

আর এখানেই উঠে আসছে একদা জাতীয় দল কংগ্রেসের (Congress Rahul Gandhi) বিকল্প হিসেবে আপ -এর নাম। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দিকে দিকে কংগ্রেসের নির্বাচনী বিপর্যয় এবং নুইয়ে পড়া সংগঠনের ফাঁকে জায়গা করে নিচ্ছে আম আদমি দল। যারা নয়া কৌশলে দিল্লি ছাড়িয়ে ঘা দিচ্ছে একের পর এক বিজেপি-প্রিয় রাজ্যে। হার অথবা জয় নয়, মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতেও সক্ষম হচ্ছে আপ।

আর এখানেই আরও ব্যর্থ হচ্ছে কংগ্রেস। নেতৃত্ব-সংকট, দলীয়-কোন্দলের আবহেই রাহুল গান্ধীর দলের কঙ্কালসার চেহারা প্রকাশিত হচ্ছে বারবার।

'ভারত জোড়ো যাত্রা'

বিরাট জাঁকজমক এবং আড়ম্বর নিয়ে তামিলনাড়ু থেকে শুরু হয় কংগ্রেসের 'ভারত জোড়ো যাত্রা'। বিশাল আয়োজন আর লোক-লস্কর নিয়ে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ হাঁটা শুরু করেন রাহুল। এখনও চলছে যা।

কিন্তু ফলাফল? হিমাচলপ্রদেশে খানিকটা লড়াই বজায় থাকলেও গুজরাতে নাস্তানাবুদ হয়েছে কংগ্রেস। একপ্রকার ধূলিসাৎ হয়েছেন জিগনেশ মেভানিরা। ১৮২ আসনের বিধানসভায় মাত্র ১৪ আসনে সন্তোষ্ট থাকতে হয়েছে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীর দলকে। আর এর পরেই উঠেছে প্রশ্ন।ফের রাহুল গান্ধীর ভারত জুড়ে প্রচার নিয়েও সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছে কংগ্রেস। তাহলে কি লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে এগোনোর চেষ্টা করলেও আদৌ ফল পাচ্ছে না কংগ্রেস! আবারও কি মুখ হিসেবে ব্যর্থ রাহুল!

একাধিক প্রশ্ন আর জল্পনার মধ্যেই দেশজুড়ে ফের মাথাচাড়া দিচ্ছি আঞ্চলিক শক্তি। এক একটি অঞ্চলে তৈরি হচ্ছে মোদি-বিরোধী আবহ। ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের মধ্যেই আসলে তৈরি হচ্ছে কংগ্রেস আবহ! মোদির বিরুদ্ধে লড়বে কে? এই প্রশ্নেই জায়গা বাড়িয়ে নিচ্ছে আঞ্চলিক দল। কখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) , কখনও নীতিশ কুমার অথবা দক্ষিণ ভারতের এমকে স্ট্যালিন। কেন্দ্রের বিরোধী মুখ হিসেবে উঠে আসছে একাধিক নাম। কিন্তু এগিয়ে কে?

কংগ্রেসের বিকল্প কেজরিওয়াল?

অনেকেই বলছেন, একাধিক নাম বিরোধী-মুখ হিসেবে উঠে আসলেও। একাধিক রাজনৈতিক দলের উত্থান দিল্লির অলিন্দে আলোচিত হলেও আদতে এগিয়ে দিল্লির বাসিন্দা অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তাঁর দল আম আদমি দল। কেন?

আরও পড়ুন : ভরসার নাম জিগনেশ! বিজেপির দূর্গে যেভাবে একা জিতে দেখিয়ে দিলেন দলিত-কংগ্রেস নেতা

একাধিক রাজ্যে আপ-র সম্প্রসারণ

প্রথমে পাঞ্জাবে প্রচার। দল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অল্প অল্প করে বিস্তার। একটা সময় মাত্র এক লোকসভা আসনে জয়। সেখান থেকেই ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতা দখল। ভগবৎ মানের নেতৃত্বে সরকারে বসল আপ।দল তৈরির এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যেই দুই রাজ্যে পাকাপাকি ক্ষমতা দখল করে নিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা। শুধু পাঞ্জাব বা দিল্লি নয়, উত্তরাখণ্ড থেকে হিমাচল প্রদেশের রাজনীতি। এর সঙ্গেই হরিয়ানার মতো রাজ্যেও প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে আম আদমি দল। মনীশ শিশোদিয়াদের কৌশলে একের পর রাজ্যে নিজেদের অস্তিত্ব বাড়াতে শুরু করেন কেজরিওয়াল। এমনকি দক্ষিণ ভারতেও সংগঠনের বিস্তারে সচেষ্ট তাঁরা।

গুজরাতে কিস্তিমাত

আপের লক্ষ্যে উঠে আসে গুজরাত। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহেদের বেকায়দায় ফেলার প্রথম ধাক্কা দেওয়ার কৌশল নিয়েছিল আম আদমি দল। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের লাগাতার প্রচার আর ভোট কৌশলে গুজরাতের মানুষের সামনে নয়া বিকল্প রাখে এই দল। দিল্লি ছাড়িয়েও যে একই উন্নয়ন গুজরাতের মানুষের জন্যেও সম্ভব একথা এখানেও জোর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা।

গোয়ার মতো এই রাজ্যেও প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হন তাঁরা। হিমাচল খুব একটা সুবিধা না দিলেও গুজরাতে প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে আম আদমি দল। আর এখানেই শুরু হয়েছে জল্পনা। প্রথম বার মাঠে নেমেই ছক্কা হাঁকাতে না পারলেও চার মেরে দিয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। মোদি-শাহের গড় রক্ষায় কাঁটা হিসেবে উঠে এসেছেন তিনি। অনেকেই বলছেন সেখানেই খানিকটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বিজেপি-র অন্দরে। কংগ্রেসের বাগে আনার চেষ্টায় জল না ঢাললেও নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরিতে রণকৌশল পরিবর্তনের পথে এগিয়েছে বিজেপি। আর অন্যদিকে সমস্ত বিরোধীদের ছাপিয়ে মোদি বিরোধিতায়, বিজেপির হার নিশ্চিত করার পথে এগিয়ে থাকার দাবিদার হয়ে উঠছে আম আদমি দল।

মমতা না কেজরিওয়াল?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও গোয়া, অসম, ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত সহ একাধিক রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের বিস্তারে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছিলেন। আঞ্চলিক দলকে রাজনৈতিকভাবে জাতীয় করতে চেয়েছেন বারবার। কিন্তু এখনও ওই পথে সেভাবে এগিয়ে যেতে পারেননি মমতা। ত্রিপুরায় লড়াই বজায় থাকলেও গোয়ায় একাধিক চেষ্টার পরেও খাতাও খুলতে পারেনি তাঁর দল। এমনকী বিভিন্ন রাজ্যেও ব্যর্থ হয়েছে তৃণমূল। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে বিপুল শক্তিশালী তৃণমূল কংগ্রেস এই রাজ্য ছাড়িয়ে অন্য রাজ্যে এখনও পর্যন্ত দাগ কাটতে পারেনি। আর এখানেই রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেষ্টা করলেও দলকে 'জাতীয়' বানাতে পারছেন না! কিন্তু ইতিমধ্যেই কেজরিওয়াল তাঁর দলকে ক্ষমতায় এনেছেন দিল্লির বাইরে। এছাড়াও একাধিক রাজ্যে জনপ্রতিনিধি হিসেবে উঠে এসেছেন তাঁর দলের সদস্যরা। এখানেই জাতীয় মুখ হিসেবে, কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে তৃতীয় শক্তির আধার রূপে এগিয়ে গিয়েছেন কেজরিওয়াল।

আরও পড়ুন : মোদি ম্যাজিক না কি শাহি-শ্রম? কোন মন্ত্রে গুজরাতে ফের পদ্ম-হাতছানি

লোকসভায় বাজিমাত?

গুজরাত নির্বাচনের আবহের প্রভাব কি লোকসভায়? অনেকেই বলছেন, ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের আগের বছরে রাজস্থান-সহ একাধিক রাজ্যের নির্বাচনের মুখোমুখি হবে বিজেপি। পরীক্ষায় বসবেন মোদি-শাহরা। ঠিক এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আবার সেই সমস্ত রাজ্যে টক্কর দিতে নামবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল। সেখানেও খুব একটা খারাপ ফলের সম্ভাবনা নেই বলেই দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে ত্রিপুরার নির্বাচনকে পাখির চোখ করেছে তৃণমূল। সেখানে বিজেপিকে টক্কর দিতে এগিয়ে কে? বাম, কংগ্রেস না তৃণমূল, তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে এখন থেকে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে মমতার জাতীয় গ্রহণযোগ্যতা এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জাতীয় প্রভাব, এই দুইয়ের বিচারেই আরও অস্তমিত হতে পারে কংগ্রেস। আর সেই সুযোগেই ফের বিরোধী নাগাল ধরতে পারেন কেজরিওয়াল। কিন্তু ঐক্য?

কেজরিওয়ালে ঐক্য-কাঁটা!

মোদিকে রুখতে পারবেন কে? কাকে মুখ করে অকংগ্রেস জোট গড়বে বিরোধীরা? এই প্রশ্নে কোন্দল শুরু হয়েছে এখন থেকেই। নীতিশ কুমার না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নাকি মহারাষ্ট্রের প্রবীণ নেতা শরদ পওয়ার। কে হবেন বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী? নাকি শেষমেশ রাহুল গান্ধীর হাত ধরেই লড়বেন তাঁরা? এই প্রশ্নের আবহ এবং বিতর্কের মধ্যে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নাম খানিকটা এগিয়ে থাকলেও তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। অনেকেই বলছেন, নিজেদের মধ্যে পদ নিয়ে সমস্যা এবং একযোগে লড়াইয়ের অনীহার মধ্যে বিবর্তিত হয়েছে বিরোধীদের কোন্দল। আর এখানেই ক্রমশ দুর্বল হতে থাকা কংগ্রেস তাদের রাজনৈতিক ইগো সরিয়ে আসতে নারাজ। আবার একাধিক বিরোধীদের একজনকে না মেনে নেওয়ার তাগিদ আখেরেই সুবিধা করে দিয়েছে বিজেপি-কে। যা পক্ষান্তরে এখন থেকেই খানিকটা এগিয়ে রেখেছে নরেন্দ্র মোদিকে!

যদিও সমস্ত জল্পনা আর কোন্দলের মধ্যেও ফের কংগ্রেসের বিকল্প এবং বিরোধী মুখ হিসেবে সাড়া জাগাচ্ছেন কেজরিওয়াল। অরবিন্দের স্পর্শে একের পর এক রাজ্যে খানিকটা চাপ বাড়ছে বিজেপি-র। শূন্যের পথে এগিয়ে যাওয়া কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে ওঠে আসছে আম আদমি দল, যা দিল্লি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশের কোণায় কোণায়। আর এই সম্প্রসারণের সঙ্গেই তুলে দিচ্ছে একাধিক প্রশ্ন এবং জল্পনার আবহ।

More Articles