কোথায় বাঁধা অবৈধ বাজি কারখানার টিকি! রাজ্যে যে ভাবে রমরমিয়ে চলে বারুদ-ব্যবসা...
Duttapukur Blast: দত্তপুকুর বাজি কারখানা বিস্ফোরণের ঘটনায় মিলেছে মুর্শিদাবাদ-যোগ। মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা জেরাত আলিই নাকি এই কারবারের মোট সিন্ডিকেটটি চালাচ্ছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ভয়ানক শব্দে কানে তালা ধরেছিল গ্রামবাসীদের। কী ঘটল ব্যপারখানা বুঝে ওঠার আগেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল ঘরের জিনিসপত্র, ভাঙল জানলার কাচ, কারওর বা উড়ল বাড়ির চাল। ভীত সন্ত্রস্ত মহিলার পাশে উড়ে এসে পড়ল একটা আধপোড়া কাটা হাত, রক্তাক্ত। বারুদের গন্ধে টেকা দায়। তার সঙ্গে মিশেছে রক্ত আর মাংসপোড়া গন্ধ। এ ঘটনা যেন প্রত্যাশিত। উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরের কাছে নীলগঞ্জ মোচপোলের বাসিন্দারা যেন জানতেন, এ আজ নয় কাল হবেই। পাড়ার মধ্যে ফেঁদে বসা কারখানা যে যে কোনও দিন বারুদগন্ধে ফেটে যাবে তা জানতেন আশপাশের মানুষ। প্রতিবাদ করেছেন, সই সংগ্রহ করেছেন ঢের। তবে যা হওয়ার তাই ঘটেছে। কথায় আছে, 'উল্টা চোর কোতোয়ালকো ডাটে'। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। সই সংগ্রহ করে বেআইনি বাজি কারখানা বন্ধের দাবি তুলে থানায় যাওয়ার পরিণাম হয়েছে উল্টো। পুলিশ উল্টে গ্রেফতার করে প্রতিবাদকারীদেরই।
আরও পড়ুন: লাইভ বোমাবাজি, অভাব-লোভের মশলা মাখা পঞ্চায়েত নির্বাচন এবার কতটা ‘হিট’?
পুলিশ পাশে, প্রশাসন পাশে। স্থানীয় রাজনৈতিক দলের হাত মাথায়! এ ক্ষেত্রে একটু একটু করে দুর্ঘটনার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকতে পারে গ্রামবাসীদের। রবিবার ভোরে দত্তপুকুরের অবৈধ বাজি কারখানার বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। বিস্ফোরণের তীব্রতায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে শরীর ক'টা। উড়ে গিয়ে পড়েছে পাশের বাড়ির ছাদে। বাড়ির বাসনকোসন বেঁকে গিয়েছে। ভেঙে গিয়েছে চেয়ার-টেবিল, আলমারি। উড়ে গিয়েছে জানলার কাচ। রবিবার সকালের ওই বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল কেঁপে উঠেছিল ৬ কিলোমিটার দূরের বারাসত শহরও।
বাজির কাজ কী! মানবসভ্যতার কোন কল্যাণকর কাজে লাগে এই দ্রব্যটি? আনন্দ-উৎসবে আকাশে রশনাই মানুষকে ফুর্তি দেয়। কিন্তু পরিবেশের উপর রেখে যায় গভীর ক্ষত। পরিবেশ দূষণ আটকাতে বাজি বিষয়ে অনেক লক্ষ্মণরেখা, অনেক গন্ডিই কেটেছে সরকার। রয়েছে কড়াকড়িও। কিন্তু আইন থাকলে তার ফাঁকও থাকে। ফলে সেই ফোকর গলেই ফুলে ফেঁপে ওঠে অবৈধ ব্যবসা। দত্তপুকুরও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রশাসনের বজ্র আঁটুনির মধ্যেই ফসকা গেরোর মতোই দত্তপুকুরে মস্ত বেআইনি বাজির কারখানা খুলে বসেছিল কেরামত আলি, আজিবর রহমানের মতো মাথারা। বড় বড় সংগঠন, রাজনৈতিক দলের হাত তাঁদের মাথায়। ফলে পুলিশ-প্রশাসন গোঁজা ট্যাঁকে। তাই সাধারণ মানুষের ওজর-আপত্তি তেমন জায়গা পায় না সেখানে। তাছাড়া ভোটের মরসুমে এই সব অবৈধ বাজি কারখানাগুলিই তো হয়ে ওঠে রাজনৈতিক দলগুলির মিত্রশক্তি। যাদের ঘাড়ে ভর রেখেই দেদার ভয় পাওয়ানো যায় বিরোধী এবং আমজনতাকে। ফলে সবাই সবটাই জানে। কিন্তু টুঁ শব্দ করে না।
না, শুধু দত্তপুকুর নয়। একের পর এক বেআইনি বাজি কারখানার খবর কানে আসে। কানে আসে বিস্ফোরণের ঘটনাও। প্রাণ যায় পেটের দায়ে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের। মালিকদেরও কমবেশি ক্ষতি হয়। তবু অবৈধ বাজি কারখানা চলে পুরোদমে। কারণ 'সওয়াল পাপী পেট কা'। দত্তপুকুরের ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগেই বজবজের একটি অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়। ঘটনায় তিন জনের মৃত্যু ঘটেছিল। চলতি বছর মে মাসে মেদিনীপুরের এগরায় বেআইনি বাজি কারখানার বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল ১২ কর্মীর। ঘটনার পরে কিছুদিন চলে প্রশাসনের তৎপরতা। তারপর, তারপর আইনের ফাঁক গলে আবার তড়তড়িয়ে চলতে থাকে সেইসব কারখানাগুলি। মার্চ মাসে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা একটি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়। মৃত্যু হয়েছিল মালিকের স্ত্রী, ছেলে-সহ বেশ কয়েকজনের। ২০১৫ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় বাজি কারখানা বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল ১৩ জনের। যার মধ্যে ছিল দশজনেরও বেশি শিশুশ্রমিক। এই সব পরিসংখ্যান একটাই কথা চিৎকার করে বলে, বেনিয়ম চলছে, চলবে।
দত্তপুকুরের ঘটনা ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক কোন্দল। কেউ বলেছেন, মাথায় শাসকদলের হাত ছিল, তো কেউ বলছেন আইএসএফের মদতেই এই বাড়বাড়ন্ত। চার জনের বিরুদ্ধে দায়ের অভিযোগ। এদিকে আইএসএফের এক ব্লক স্তরের নেতা নাকি পলাতক। এদিকে রাজ্যপাল ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছেন, এদিকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে কেন যেতে পারেননি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সে নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছেন ডিজিকে। চলেছে বৈঠক। আলোচনা হয়েছে পরবর্তী কর্তব্য নিয়ে। যেমনটা হয়ে থাকে।
এদিকে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, যে কেরামত আলির বিরুদ্ধে এই বাজি কারখানা চালানোর অভিযোগ, তিনি কার্যত নির্ভিক লোক। গ্রামবাসীদের আপত্তি, প্রতিবাদ, প্রশাসনের চোখরাঙানি এমনকী জেলের ভাতকেও বিশেষ পরোয়া করেন না তিনি। ধরা পড়লে জেল খাটেন, বাড়ি ফিরে আবার মন দেন বাজি বানানোয়। সেই তাঁর পেশা এবং নেশা। রবিবারের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন কেরামতের ছেলে। নিজের হাতে গড়ে তোলা বারুদের সাম্রাজ্য প্রাণ কাড়ল কুলপ্রদীপটির। এখনও কি একই রকম নিরুত্তাপ, নির্বিকার কেরামত? বড় জানতে ইচ্ছা করে। সন্তানহারা বাজি কারখানার মাথাকে তৃণমূল ঠেলেছে আইএসএফের দিকে, আইএসএফ শাসকদলের দিতে। ঠেলাঠেলি চলছে অনর্গল। তবে স্থানীয় পুলিশের দাবি, কেরামতের কেরামতি সাঙ্গ হয়েছে এদিনের বিস্ফোরণেই। কেরামতের পাশাপাশি মৃত্যু হয়েছে সামসুল হকেরও। তারই জমির উপর গড়ে উঠেছিল ওই অবৈধ বাজির কারখানা। এদিকে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী তুলে এনেছেন আর এক অভিযুক্তের নাম। বলাই বাহুল্য, তিনি আইএসএফ-ঘনিষ্ঠ। সেই রমজান আলি ছাড়া এসেছে আজিবর রহমান নামে আরেক ব্যাক্তির নামও। যার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রচুর নিষিদ্ধ বাজি। এলাকাবাসীর অভিযোগ, তিনি আবার তৃণমূল নেতা। ঘটনার পর থেকে তিনি আবার ফেরারও।
দত্তপুকুর বাজি কারখানা বিস্ফোরণের ঘটনায় মিলেছে মুর্শিদাবাদ-যোগ। মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা জেরাত আলিই নাকি এই কারবারের মোট সিন্ডিকেটটি চালাচ্ছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। জেরাতের দাপটে এলাকায় বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। দত্তপুকুরের বাজি বিস্ফোরণে নিহতদের মধ্যে ৬ কারখানাকর্মীই মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। অনুমান করা যায়, বাজি কারখানার কাজ দিয়ে তাঁদের দত্তপুকুরে পাঠায় জেরাতই। মুর্শিদাবাদে অবশ্য কাপড়ের ব্যবসায়ী পরিচয় বাঁচিয়ে রেখেছে ,সে। পসার না-হওয়া ছোট্ট দোকানের আড়ালেই চলে বোমার মশলা ও বোমা বানানো শ্রমিক বানানোর সিন্ডিকেট। অনেকেই দেখেছেন, ভোর হতে না হতেই ছোট ছোট পিকআপ ভ্যানে করে কাপড়ে গাঁটরির আড়ালে আড়ালে বোমার মশলা পড়শি রাজ্য থেকে এসে ঢুকত জেরাতের ডেরায়। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই গোডাউন ঘিরে ধরত দশ চাকা, ষোলো চাকার ইয়াব্বড় বড় সহ ট্রাক। যার মাধ্যমে সকালের কাঁচামাল সরবরাহ হয়ে যেত দত্তপুকুরের মতোই রাজ্যের একাধিক বেআইনি বাজি কারখানায়। নিমেষে ফাঁকা হয়ে যেত জেরাতের গুদোম। এই যে দত্তপুকুরে বিরাট ব্যবসা, তা সুদূর মুর্শিদাবাদে বসে গোটাটাই নিয়ন্ত্রণ করত জেরাত। বেশি রোজগারের আশা দিয়ে গ্রামের গরিবগুর্বো ছেলেগুলিকে নিয়ে আসত এই বিপজ্জনক কাজে। না, সহজ নয় ঠাঁই। ভিনগাঁ থেকে কাজ করতে আসা এই শ্রমিকদের পরিবারেরা সোজাসুজি যোগাযোগ করতে পারতেন না তাঁদের সঙ্গে। যোগাযোগের মাধ্যম ছিল জেরাতই। সাধারণ শব্দবাজির মশলা তো তৈরি হতই এই কারখানায়, তবে আসল অর্থকরী ছিল বড় বিস্ফোপণের ক্ষমতাযুক্ত বোমার মশলা। আর সেই বোমা যে কী কাজে লাগে, তা কে না জানে! দিন কয়েক আগেই মুর্শিদাবাদের একটি বিস্ফোরণ মামলায় পুলিশ পাকড়াও করে জেরাতকে। মাস কয়েকের মধ্যেই মেলে জামিন। আবার রমরমিয়ে চলে ব্যবসা। জেল, গ্রেফতারি এসব যে রেয়াতকে চার দেওয়ালে আটকে রাখতে পারবে না, তা ভালোই জানে জেরাত। ফলে কাউকেই রেয়াত করে না সে! কীসের জোরে জেরাতের এত বাড়বাড়ন্ত, প্রশ্ন থেকেই যায়।
আরও পড়ুন: সবুজ রঙের বাজি মানেই কি পরিবেশবান্ধব? জানুন গ্রিন ক্র্যাকারের আসল সত্য
দত্তপুকুরের বিস্ফোরণের ঘটনা এখনও টাটকা। তার ক্ষত, রক্ত, ভাঙা ঘরবাড়ির মতোই স্পষ্ট। ফলে তা নিয়ে সরকার, প্রশাসন বা বিরোধীদের তৎপরতার শেষ নেই। ইতিমধ্যেই ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বটে। সাসপেন্ড করা হয়েছে দত্তপুকুরের আইসি শুভব্রত ঘোষ ও নীলগঞ্জ ফাঁড়ির ওসি হিমাদ্রি ডোগরাকে। ব্যবস্থা নেওয়ার এর থেকে সহজ সরল ব্যবস্থা আর কী-ই বা আছে! তবে এ সবের রেশ মাত্র দিন কয়েক। দিন কয়েকের মধ্যেই পলি জমবে দত্তপুকুরের কারখানায়। অন্য কোথাও প্রশাসনের চোখের ফাঁক গলে চলবে বেআইনি বাজি কারখানা। কোনও একদিন সে-ও ভীষণ বারুদগন্ধে ফেটে যাবে। উড়ে যাবে হাত, শ্রমিকদের দেহ ছিটকে পড়ে থাকবে এদিকে সেদিকে। তারপর ফের হইচই হইচই শোরগোল। অতঃপর দামামা বাজিয়ে রাজ্যে এসে পড়বে ভোট। গণতন্ত্রের উৎসবে রাজ্যের নেতামন্ত্রীর পোষা গুন্ডারা তখন আবার খুঁজবে কেয়ামত কিংবা জেরাতদের। কারণ নিরঙ্কুষ জয়ের ফর্মুলা যে কোন বাজি কারখানা, বারুদের কোন পরীক্ষাগারে রাখা আছে, তা বুদ্ধিমান মাত্রেই জানেন! অতএব বড় বড় দেশে এমন ছোট ছোট ঘটনা ঘটে, আখছাড়ই ঘটে। ফলে পাতা উল্টে যাওয়াই বোধহয় সমীচিন!