সবুজ রঙের বাজি মানেই কি পরিবেশবান্ধব? জানুন গ্রিন ক্র্যাকারের আসল সত্য

Green Crackers: সাধারণত, পথের ধারে যারা বাজির স্টল দিয়ে থাকেন তাঁদের কাছে এই ধরনের গ্রিন ক্র্যাকার থাকে না। তাই তাঁদের কাছ থেকে সবুজ বাজির আশা না করাই ভালো।

এক বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আবারও হাজির বাঙালির আলোর উৎসব দীপাবলি। আর কালীপুজো-দীপাবলি বলতেই সবার আগেই মনে পড়ে আতসবাজির খেলা। যদিও এবার কালীপুজোয় পোড়ানো যাবে শুধুমাত্র পরিবেশবান্ধব বাজি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ২০১৮ থেকেই জারি হয়েছে এই নতুন নিয়ম। দূষণের কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। আর এই নির্দেশের পরেই দোকানে দোকানে বাড়ছে সবুজ বাজি, অর্থাৎ গ্রিন ক্র্যাকার্স কেনার হিড়িক। গত বছর থেকেই কলকাতার বিভিন্ন বড় বাজিবাজারে হিট হয়ে উঠেছে এই সবুজ বাজি।

এমনিতেই, বায়ু দূষণের ইনডেক্স অনুযায়ী, কলকাতা এই মুহূর্তে ভারতের সব থেকে দূষিত কয়েকটি শহরের মধ্যে একটি। ২০১৭ থেকেই কলকাতার বায়ু দূষিত হতে শুরু করেছিল। আর কালীপুজোর সময় কলকাতার এই দূষণমাত্রা থাকে সর্বাধিক। সেই লক্ষ্যেই কলকাতায় শুরু হয়েছিল এই সবুজ বাজির বিক্রি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, এই সবুজ বাজি তৈরির প্রথম দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সিএসআইআরের অন্তর্গত ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নিরি)-কে। তাদের ফর্মুলাতে সফলভাবে পরিবেশবান্ধব বাজি বাজারে নিয়ে আসাও হয়েছিল। তবে, সবুজ বাজি বলে দিলেই যে কোনও বাজি সবুজ বাজি হয়ে যায় না; বা রং সবুজ হলেও কোন বাজি হয়ে যায় না গ্রিন ক্র্যাকার।

সাধারণ আতসবাজি এবং গ্রিন ক্র্যাকারের মধ্যে তফাত কী?

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে কথা বলার সময় পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রবীন্দ্র খাইওয়াল এবং ড. সুমন মোরের বক্তব্য অনুযায়ী, সবুজ বাজি এবং সাধারণ আতসবাজির মধ্যে এটাই প্রধান তফাত যে, সবুজ বাজিতে পরিবেশ বা মানুষের ক্ষতি হয় এরকম পদার্থ কম উৎপন্ন হয়। সাধারণ আতসবাজি পোড়ালে যত পরিমাণ দূষক পদার্থ তৈরি হয়, তার ৩০ শতাংশ কম দূষক পদার্থ তৈরি হয় সবুজ বাজি পোড়ালে। ড. খাইওয়াল বলছেন, "গ্রিন ক্র্যাকার সাধারণত কম ধোঁয়া তৈরি করে এবং পরিবেশের ধুলো কিছুটা হলেও শুষে নেয়। এই ধরনের বাজিতে বেরিয়াম নাইট্রেটের মতো কোনও ক্ষতিকারক পদার্থ থাকে না। এছাড়াও, এই ধরনের বাজিতে কোনও ক্ষতিকারক ধাতু থাকেনা। অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকারক ধাতু এবং রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে এই বাজি তৈরি করা হয়।"

অর্থাৎ সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এই ধরনের বাজি পরিবেশের পক্ষে অনেকটাই ভালো এবং তুলনায় অনেক কম পরিমাণ কার্বন ফুটপ্রিন্ট তৈরি করে। সবুজ বাজি এমনিতে সাধারণ আতসবাজির মতোই। শুধু ফারাকটা এই জায়গায় যে, এই ধরনের বাজি মাল্টিফাংশনাল অ্যাডিটিভ, যারা ধোঁয়া কম তৈরি করে।"

আরও পড়ুন- বাবার মৃত্যু থেকে অধিনায়কত্ব বিতর্ক, সব পেরিয়ে যেভাবে প্রত্যাবর্তন বিরাটের

শুধু তাই নয়, এক একটি শব্দবাজিতে শব্দ দূষণও হয়ে থাকে। প্রায় ১৬০ ডেসিবেল আওয়াজ হয় এক একটি বাজি ফাটলে। যেখানে সবুজ বাজিতে আওয়াজ হতে পারে সর্বাধিক ১১০ ডেসিবেল। ফলে শব্দ দূষণের সম্ভাবনাও অনেকটাই কম থাকে এই সবুজ বাজির ক্ষেত্রে।

কারা তৈরি করেন এই গ্রিন ক্র্যাকার?

নিরির ফর্মুলা অনুযায়ী যদি কেউ সঠিকভাবে গ্রিন ক্র্যাকার তৈরি করতে পারে, তাহলেই আদতে সেটি পরিবেশবান্ধব বাজি হয়ে উঠবে। যেকোনও ধাতু দিয়ে এই ধরনের পরিবেশবান্ধব বাজি তৈরি করা যায় না। তবে নিরি যে ফর্মুলা তৈরি করেছে, তা কিন্তু প্রত্যেক বাজি নির্মাতা ব্যবহার করতে পারেন না। শুধুমাত্র যারা এই বাজি তৈরির লাইসেন্স গ্রহণ করেছে তারাই এই ফর্মুলায় বাজি তৈরি করতে পারেন।

ভারতের সব থেকে বড় বাজি নির্মাতা কোম্পানি সিভাকাসির ১,০০০ জন নির্মাতা এই নিরি অনুমোদিত ফর্মুলা অনুযায়ী বাজি তৈরি করতে পারেন। সাধারণ আতসবাজিতে রংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় নানা ধরনের ক্ষতিকারক ধাতু। সাদা রঙের জন্য ব্যবহার হয় অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং টাইটানিয়াম। কমলা রঙের জন্য ব্যবহার করা হয় কার্বন এবং আয়রন। হলুদ রঙের জন্য ব্যবহার করা হয় সোডিয়ামের ধাতু, নীল রঙের জন্য ব্যবহার করা হয় কপারের কোনও যৌগ এবং লাল রঙের জন্য ব্যবহার করা হয় শরীরের পক্ষে সবথেকে ক্ষতিকারক স্ট্রনশিয়াম ধাতুর কিছু যৌগ। এছাড়াও, সবুজ রঙের জন্য ব্যবহার করা হয় বেরিয়াম মনোক্লোরাইড লবণ, বেরিয়াম নাইট্রেট অথবা বেরিয়াম ক্লোরেট লবণ। এই বেরিয়াম ধাতুটি জ্বালানো হলে ঘন ধোঁয়া তৈরি করে, ফলে পরিবেশ ব্যাপকভাবে দূষিত হয়। তবে সবুজ বাজিতে এইরকম কোনও ধাতু ব্যবহার করা হয় না। ফলে পরিবেশের পাশাপাশি শরীরের পক্ষেও সবুজ বাজি অনেকটাই ভালো।

সবুজ বাজির সমস্যা

গ্রিন ক্র্যাকার বা সবুজ বাজির প্রধান সমস্যা হলো, এই ধরনের বাজি খুব একটা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। যেহেতু এই ধরনের বাজিতে অপেক্ষাকৃত নরম ধাতু ব্যবহার করা হয়, তাই এই ধাতুগুলির স্থায়িত্ব কম থাকে। এই কারণে যারা বাজি বিক্রেতা রয়েছেন, তাদের জন্য এই ধরনের গ্রিন ক্র্যাকার খুব একটা লাভজনক নয়। এই বছর যদি তাঁরা তাঁদের সমস্ত বাজি বিক্রি করতে না পারেন, তাহলে পরের বছর পর্যন্ত সেই বাজি স্থায়ী হবে না। ফলে ব্যবসার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তামিলনাড়ু ফায়ারওয়ার্ক্স ট্রেডার্স ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ভি রাজা চন্দ্রশেখরন বলছেন, "সিএসআইআর এবং নিরি এই ধরনের বাজিতে অবশ্যই কিছু স্থায়িত্ব বৃদ্ধিকারী পদার্থ ব্যবহার করেছে। তবে সেই ধাতুগুলির নিজস্ব স্থায়িত্ব যদি বেশি না হয়, তাহলে কখনই বাইরে থেকে কোনও পদার্থ যোগ করে স্থায়িত্ব বেশিদিন বৃদ্ধি করা যায় না। এর ফলে যারা বাজি বিক্রি করছেন এবং যারা কিনছেন, দু'জনই ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন।

সবুজ রং মানেই সবুজ বাজি নয়

ডক্টর খাইওয়াল এবং প্রফেসর মোর জানিয়েছেন, গ্রিন ক্র্যাকারস ভারতে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করলেও অনেকেই এমন আছেন যারা সবুজ রঙের সাধারণ আতসবাজিকে পরিবেশবান্ধব বাজি হিসেবে বিক্রি করে থাকেন। গ্রিন ক্র্যাকার্সের মধ্যে মূলত তিনটি শ্রেণি রয়েছে - SWAS, SAFAL ও STAR।

SWAS শ্রেণির বাজির পুরো নাম - Safe Water Releaser। অর্থাৎ এই ধরনের বাজিতে একটি ওয়াটার পকেট থাকে, যা বাজি ফাটার সময়ে ফেটে যায় এবং বাষ্প তৈরি করে। ধোঁয়া তৈরি করার জন্য পরিবেশের আশেপাশের ধুলোকে ব্যবহার করে এ ধরনের বাজি, যারা বাষ্পের সঙ্গে মিশে যায়। এর ফলে ধোঁয়া তৈরি করার জন্য পটাশিয়াম নাইট্রেট অথবা গন্ধকের মতো পদার্থ ব্যবহার করতে হয় না। পাশাপাশি বাজি পোড়ানোর আনন্দটাও মাটি হয় না।

আরও পড়ুন- মৃত্যুর চারশো বছর পরও কবর জোটেনি! রানিকে দেখতে এসে পর্যটকরা কেন খাবলে নিতেন হাড়?

একইভাবে, STAR হল Safe Thermite Cracker, যারা অপেক্ষাকৃত কম ধোঁয়া তৈরি করে এবং উৎপন্ন শব্দের মাত্রাও অনেকটা কম থাকে। এছাড়া, SAFAL হলো Safe Minimal Aluminium। এই শ্রেণিটি সাধারণত তুবড়ি এবং রং মশাল তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের বাজিতে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার থাকে অত্যন্ত কম, এবং তার পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় ম্যাগনেসিয়াম। ফলে শব্দের পাশাপাশি অ্যালুমিনিয়ামের ক্ষতিকারক দূষক পদার্থের উৎপত্তিও কম হয়।

তবে, যেকোনও সবুজ রঙের বাজি মানেই কিন্তু গ্রিন ক্র্যাকার নয়। সাধারণত, পথের ধারে যারা বাজির স্টল দিয়ে থাকেন তাঁদের কাছে এই ধরনের গ্রিন ক্র্যাকার থাকে না। তাই তাঁদের কাছ থেকে সবুজ বাজির আশা না করাই ভালো। তাঁরা যে ধরনের বাজিকে সবুজ বাজি বলে বিক্রি করে থাকেন, সেগুলি রঙে সবুজ। অর্থাৎ সেই বাজিতে অতিরিক্ত পরিমাণ বেরিয়াম লবণ ব্যবহার করা হয়েছে। সেই বাজি পরিবেশের পক্ষে ভালো তো একেবারেই নয়, বরং বলতে গেলে সাধারণ বাজির থেকেও বেশি খারাপ।

লাইসেন্সিং

এই ধরনের গ্রিন ক্র্যাকার সবাই বিক্রি করতে পারে না। কোনও লাইসেন্স প্রাপ্ত দোকান ছাড়া এই ধরনের বাজি পাওয়া যায় না। পাশাপাশি, প্রথম দিকে যখন এই ধরনের ক্র্যাকার বাজারে আসতে শুরু করেছিল সেই সময়ে ১০০০টি কারখানা এই বাজি বানাতো। কিন্তু এখন মাত্র ১৬০টি কারখানা বেঁচে রয়েছে। বাকি সব কারখানাই নিজেদের লাইসেন্স হারিয়েছে নিষিদ্ধ রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে। তাই যদি আপনার সত্যিই গ্রিন ক্র্যাকার কেনার পরিকল্পনা থাকে, তাহলে কোনও এমন দোকান থেকে এই ধরনের বাজি কিনুন যার কাছে গ্রিন ক্র্যাকার লাইসেন্স রয়েছে। এই ধরনের সবুজ বাজিতে কোথাও না কোথাও CSIR-NEERI-র লোগো এবং ব্র্যান্ডিং থাকবে। সেই ব্র্যান্ডিংয়ে সত্যতা যাচাই করার পরেই গ্রিন ক্র্যাকার কিনুন।

More Articles