অন্ধত্বর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অবসাদ, কেমন আছেন ভারতের দৃষ্টিহীন মানুষরা?
ভারতে দৃষ্টিহীনের সংখ্যা গত ২২ বছরে ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। এ-সম্পর্কিত গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ২০০০ সালের ভারতে দৃষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা ছিল বর্তমানের তুলনায় অনেকটাই কম।
অন্ধত্বকে অভিশাপ বলা হয়ে থাকে। আর আবিশ্ব ৪ কোটি ৯০ লক্ষের বেশি মানুষ দৃষ্টিশক্তিহীন। এঁদের ভেতর ৯০ শতাংশ মানুষই পৃথিবীর নিম্ন আয় কিংবা মধ্য আয়ের দেশগুলির বাসিন্দা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুসারে, দুনিয়ায় যে লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্ধত্বের অভিশাপের শিকার, এঁদের মধ্যে ৫১ শতাংশ মানুষের অন্ধত্বের সূত্রপাত চোখে ছানি পড়ার কারণে। অথচ যথাসময় চোখের পরিচর্যা করালে দৃষ্টিশক্তি হারানোর বিপদ থেকে মুক্ত হওয়া যেতে পারত। যদিও তা সম্ভব হচ্ছে না চোখের অসুখে আক্রান্ত মানুষজনের মধ্যে অধিকাংশেরই পয়সা খরচ করে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ক্ষমতা না থাকায়।
'প্রাইসওয়াটার হাউস কুপার্স'-এর তরফে জানানো হয়েছে, নিম্ন আয় কিংবা মধ্য আয়ের দেশগুলিতে চোখের অসুখে আক্রান্ত নাগরিক-পিছু সরকার বছরে ২ দশমিক ২০ মার্কিন ডলার বরাদ্দ করলেই অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে মানুষের রেহাই মিলতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। সেই হিসেবে অন্ধত্ব এবং দারিদ্র সহাবস্থানই করছে।
অন্ধত্বের ফলে চোখের আলো যে চিরতরে নিভে যায়, তাই নয়, আক্রান্ত মানুষজন একই সঙ্গে মানসিক রোগব্যাধিতেও আক্রান্ত হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, আক্রান্ত মানুষটির দৈনন্দিন জীবনেও প্রভাব পড়ে অন্ধত্বের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবসাদ কিংবা উদ্বেগজনিত নানা মানসিক সমস্যার শিকার হন ওঁরা।
আরও পড়ুন: জরায়ু বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন ভারতীয় মহিলাদের একাংশ, যে ভয়াবহ পরিণাম হতে পারে
এই সম্পর্কেও পৃথকভাবে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। 'মিশন ফর ভিশন' নামে একটি সংস্থা চোখে ছানি পড়া আট শতাধিক মানুষের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছে। ওই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, চোখে ছানি পড়ার ফলে প্রথম দফায় যে সমস্ত মানুষের অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁদের মধ্যে ৮৭ শতাংশের বেশি মানসিক অবসাদের শিকার। আর উদ্বেগজনিত সমস্যার শিকার ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। এঁদের মধ্যে রয়েছে নারী-পুরুষ উভয়পক্ষই।
আবিশ্ব যত মানুষ অন্ধত্ব কিংবা দৃষ্টিশক্তিজনিত সমস্যার শিকার এঁদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের বসবাস ভারতে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পেশ করা তথ্যানুসারে, ৪৮ লক্ষ ভারতীয় নাগরিক অন্ধত্বের শিকার। তবে স্বেচ্ছাসেবীদের মতে, এই সংখ্যাটা আরও অনেকটা বেশি। এছাড়া কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পেশ করা তথ্যের সঙ্গে মিলছে না অন্য সমীক্ষাগুলির তথ্য। স্বেচ্ছাসেবীদের পেশ করা তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ভারতে দৃষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লক্ষের চেয়ে বেশি। সেই হিসেবে ভারতেই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিহীন মানুষের বসবাস।
ভারতের নাগরিক দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষজনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যকই পরিকাঠামোগত সমস্যার কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। 'ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ দ্য ব্লাইন্ড অফ ইন্ডিয়া'-র প্রেসিডেন্ট কুসুমতলা মালিকের অভিমত, জাতীয় শিক্ষানীতিতে দৃষ্টিহীন নারী-পুরুষের জন্য পৃথক একটি মডেল অন্তর্গত করা প্রয়োজন, যাতে ওঁরা প্রথাগত শিক্ষালাভ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন। জরুরি এই উদ্যোগ এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। দৃষ্টিহীনদের লেখাপড়া চালানোর জন্যে ব্রেইল পদ্ধতিতে পঠনপাঠন চালানোর জন্যে প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাবও অন্যতম গুরুত্বপূ্র্ণ সমস্যা।
এই ব্যাপারে 'ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ অ্যাকসেসিবিলিটি প্রফেশনাল' নামে একটি সংস্থার কর্মকর্তা শ্রীনিবাস চক্রাভারথুলা জানিয়েছেন, দৃষ্টিশক্তিহীনদের শিক্ষালাভের ব্যবস্থা করতে ওদের প্রযুক্তিগত সহায়তা করাটা অত্যন্ত জরুরি কাজ। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সেই কাজ সম্পন্ন হয়নি। ফলে দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষের জীবনযাপন করাও এখন কার্যত চ্যালেঞ্জের। দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষের কাছে এখনও অন্যতম চ্যালেঞ্জের কাজ হলো চেনা পরিধি অথবা ঘরের বাইরে চলাফেরা করাও।
ভারতে ৪৮ লক্ষর বেশি মানুষ অন্ধত্বের শিকার। এদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকার পাশাপাশি এখনও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই। দৃষ্টিহীনদের জন্যে সরকারি প্রকল্পগুলির সুবিধা থেকেও বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যক দৃষ্টিহীন মানুষ।
'ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন রিসার্চ'-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, সারা ভারতে যত সংখ্যক দৃষ্টিহীন মানুষ রয়েছেন, তাদের মধ্যে মোট ২৯ দশমিক ১৬ শতাংশ দৃষ্টিহীন লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছেন। এদের ভিতর অর্ধেক সংখ্যক আবার চাকরি-বাকরি পাচ্ছেন। বাকিরা আধুনিক ভারতেও মান্ধাতার আমলের মতো নিজের অন্ধত্বকে অভিশপ্ত বলেই মনে করেন। অথচ এই পরিস্থিতি স্বাধীন দেশের সমাজে কাম্য ছিল না। অন্যদিকে, প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ ক্ষেত্রে। এদিকে সমান তালে বাড়ছে প্রতিযোগিতা।
ভারতের নাগরিক দৃষ্টিহীনদের উচ্চশিক্ষা লাভ করাটা তো দূরের কথা, স্কুলশিক্ষা থেকেও ব্যাপক হারে বঞ্চিত ওরা। বিভিন্ন সমীক্ষায় এও দেখা গিয়েছে, ভারতে মোট ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ স্কুলে দৃষ্টিহীনদের পঠনপাঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো রয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবীদের নানা সমীক্ষায় ধরা পড়েছে উদ্বেগজনক আরও তথ্য। 'ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্লাইন্ড' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, দৃষ্টিশক্তিহীন পুরুষের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দৃষ্টিহীন মেয়েরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিভাবকরা দায় ঝেড়ে ফেলতে পরিবারের দৃষ্টিহীন মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। এর জেরে দৃষ্টিহীন ছাত্রীদের স্কুল ড্রপ আউটের সংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবীজুড়ে মোট যত সংখ্যক দৃষ্টিহীন রয়েছে এদের মধ্যে ৫৫ শতাংশই মহিলা। আর এদের মধ্যে বেশিরভাগই লিঙ্গবৈষম্যের শিকার।
ভারতের বাসিন্দা শিশুদের একাংশ দৃষ্টিজনিত প্রতিবন্ধকতার শিকার অথবা দৃষ্টিহীন। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, এই সংখ্যাটা অন্তত ২ লক্ষ। তবে বেসরকারি সংস্থার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, নানা ধরনের জটিল চক্ষুরোগ কিংবা দৃষ্টিহীনতার শিকার সব মিলিয়ে ১০ লক্ষেরও বেশি শিশু।
এদিকে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো ভারতের স্কুলগুলোতে দৃষ্টিহীনদের জন্য পঠনপাঠনের পরিকাঠামো রয়েছে, এমন স্কুলগুলোতে পড়ছে মোটে ১৫ হাজার দৃষ্টিহীন পড়ুয়া। আর এদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। স্বেচ্ছাসেবীদের মতে, চক্ষুরোগে ভুগছে এমন শিশুদের চিকিৎসার জন্যে ভারতে প্রয়োজন ১০০ টি চিলড্রেন্স আই সেন্টার্স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই নির্দেশিকা জারি করলেও ভারতে এই পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি সেই একই। যদিও আবিশ্ব মোট দৃষ্টিহীনের ভেতর ২০ শতাংশই ভারতের বাসিন্দা।
এদিকে ভারতে দৃষ্টিহীনের সংখ্যা গত ২২ বছরে ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। এ-সম্পর্কিত গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ২০০০ সালের ভারতে দৃষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা ছিল বর্তমানের তুলনায় অনেকটাই কম। ২০০০ সালে ভারতে দৃষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪০ লক্ষের চেয়ে কিছুটা বেশি। যা বর্তমানে ৩ কোটি ৯০ লক্ষেরও বেশি। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, গত ১২ বছরে দৃষ্টিহীনতা রোধের ফলাফল ইতিবাচক। দৃষ্টিহীনতা মানুষের সংখ্যা পরিসংখ্যানের নিরিখে ৪৭ শতাংশ কমেছে।