বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার! দুর্ঘটনাগ্রস্থ বিমানটি আদৌ যাত্রী পরিবহণের যোগ্য ছিল?
Air India : বোয়িংয়ের অন্যান্য বিমান, যেমন ৭৩৭ ম্যাক্স, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দুটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে সব মিলে ৩৪৬ জন মারা যান। এই ঘটনাগুলো বোয়িংয়ের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আহমেদাবাদের সরদার বল্লভভাই পটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ২৩ থেকে উড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়ে ফ্লাইট এআই১৭১, ঘড়ির কাটায় তখন দুপুর ১টা ৩৮ মিনিট। উড়ানের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে পাইলট এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে মেডে কল দেন। অর্থাৎ বুঝিয়ে দেন, অবস্থা বিপজ্জনক। বিমানটি মাত্র ৬২৫ ফুট উচ্চতায় পৌঁছে এবং তারপর দ্রুত নিচে নেমে আসে। মেঘানীনগরের একটি আবাসিক এলাকায় এবং বিজে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলে ধাক্কা মারে বিমানটি। সে সময় বিমানটিতে ১ লাখ ২৫ হাজার লিটার জ্বালানি ছিল। সেখান থেকেই বিস্ফোরণের ফলে বড় ধরনের আগুন ধরায়। ঘটনাস্থল কালো ধোঁয়ায় ভরে যায়। বিমানে ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ, ৭ জন পর্তুগিজ এবং ১ জন কানাডিয়ান নাগরিক ছিলেন। মৃতদের মধ্যে গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানি এবং হস্টেলে থাকা চারজন মেডিক্যাল ছাত্রও ছিলেন। এই ঘটনায় গোটা দেশে শোকের আবহ। আর এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বোয়িং বিমানের হাল হকিকত নিয়ে।
বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার একটি আধুনিক, লম্বা দূরত্বের বিমান। ২০১১ সালে প্রথম বাণিজ্যিক উড়ান শুরু করে এই বিমানটি। এর তিনটি সংস্করণ রয়েছে, যথা- ৭৮৭-৮, ৭৮৭-৯ এবং ৭৮৭-১০। দুর্ঘটনায় পড়া বিমানটি ছিল ৭৮৭-৮, যা অন্তত ২৪৮ জন যাত্রী বহন করতে পারে এবং ১৩,৫৩০ কিলোমিটার দূরত্ব উড়তে পারে। বিমানটি ৫৭ মিটার লম্বা। বিমানের ডানার প্রস্থ ৬০ মিটার। এতে জিইএনএক্স-১বি বা ট্রেন্ট ১০০০ ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়।
বোয়িংয়ের মতে, এই বিমানটি তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয়। এর কেবিন প্রশস্ত, জানালা বড়। পাইলটদের জন্য ককপিট আরামদায়ক। এটি পুরনো বিমানের তুলনায় কম জ্বালানি খরচ করে এবং বিমানের ভেতর আর্দ্রতা ধরে রাখে। যাত্রীদের জন্য পরিবেশ আরামদায়ক হয়। বিমানটির শরীর অ্যালুমিনিয়ামের বদলে হালকা অথচ শক্ত উপাদানে তৈরি। বিমানের অংশগুলোর সমস্যা ধরার জন্য হেলথ চেক আপ ব্যবস্থা রয়েছে। বোয়িং এখন পর্যন্ত ১,২০০টির বেশি ড্রিমলাইনার সরবরাহ করেছে,সব মিলে ড্রিমলাইনার ১০০ কোটির বেশি যাত্রী বহন করেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, এই দুর্ঘটনার আগে কোনো বোয়িং ৭৮৭ মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েনি। তবে নিরাপত্তাজনিত কিছু প্রশ্ন উঠেছে বারবার। ২০১৩ সালে, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির সমস্যার কারণে সব ড্রিমলাইনারকে কিছুদিনের জন্য উড়ান বন্ধ রাখতে হয়। তবে এতে কোনো আঘাত বা মৃত্যু হয়নি। ২০২১-২২ সালে, বিমানে বেশ কিছু গর্ত ধরা পড়ায় এবং টাইটানিয়ামের ভুল অংশ ব্যবহারের কারণে সরবরাহ এক বছরের জন্য বন্ধ ছিল। বোয়িং যদিও বলেছে, এই সমস্যাগুলো তত বড় ছিল না। তবে বোয়িংয়ের কথা পুরোপুরি মেনে না নেওয়ার যথেষ্ট কার্যকারণ রয়েছে।
২০২৪ সালে, বোয়িংয়ের প্রকৌশলী স্যাম সালেহপুর দাবি করেন, ৭৮৭-এর অংশবিশেষ ঠিকঠাক ভাবে সংযুক্ত করা হয়নি। স্যামের ভয় ছিল, এই অযত্ন বেশ কিছুদিন উড়ানের পর বিমানে ফাটল সৃষ্টি করতে পারে। বোয়িং এই দাবি অস্বীকার করে এবং বলে, তারা বিমানটির পরীক্ষা করেছে। এটি নিরাপদে ৪০-৫০ বছর নিরাপদে উড়তে পারে। ২০১৯ সালে, বোয়িংয়ের দক্ষিণ ক্যারোলিনার কারখানার কর্মীরা বলেছিলেন, তাদের তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে হয়। নিরাপত্তার বেশ কিছু দিক উপেক্ষা করা হয়। মার্কিন ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) এই অভিযোগগুলো তদন্ত করছে।
বোয়িংয়ের অন্যান্য বিমান, যেমন ৭৩৭ ম্যাক্স, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দুটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে সব মিলে ৩৪৬ জন মারা যান। এই ঘটনাগুলো বোয়িংয়ের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে। এয়ার ইন্ডিয়ার এই দুর্ঘটনার পর বোয়িংয়ের শেয়ার ৮ শতাংশ কমে যায়। কিন্তু ৭৮৭ মডেলটিও যে এতবড় দুর্ঘটনার মুখে পড়়বে,তা ক্ষুণাক্ষরেও টের পাননি সংশ্লিষ্ট বিমানকর্মীরা।
বলাই বাহুল্য এই ঘটনার কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। তবে কিছু সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাখির ধাক্কা, ইঞ্জিনের সমস্যা, জ্বালানির ত্রুটি বা পাইলটের ভুল থেকে দুর্ঘটনা হতে পারে। ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার ওঠানো হয়নি এবং ডানার ফ্ল্যাপ সঠিকভাবে সেট করা ছিল না। এই ঘটনা পাইলটদের ভুল বা আকস্মিক সমস্যার কারণে ঘটে থাকতে পারে। আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে পাখির উপদ্রব একটি পরিচিত সমস্যা। সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে গুজরাটে ৪৬২টি পাখির ধাক্কার ঘটনা ঘটেছে, যার বেশিরভাগ এই বিমানবন্দরে।
ইতোমধ্যে বিমানটির ব্ল্যাকবক্স পাওয়া গিয়েছে। ব্ল্যাকবক্স ফ্লাইট ডেটা এবং ককপিটের কথোপকথন রেকর্ড করে। এখান থেকে দিন কয়েকে জানা যাবে মূল ঘটনাটি। ভারতের বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরো (এএআইবি) তদন্ত শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড (এনটিএসবি), ইউকে-র এয়ার অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চ, বোয়িং এবং ইঞ্জিন নির্মাতা জিই এরোস্পেস তদন্তে সাহায্য করছে। প্রাথমিক প্রতিবেদন ৩-৬ মাসের মধ্যে এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন ১-২ বছরের মধ্যে প্রকাশিত হতে পারে। এয়ার ইন্ডিয়ার মালিকপক্ষ টাটাগ্রুপ জানিয়েছে, তারা প্রত্যেক মৃতের পরিবারকে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে এবং আহতদের চিকিৎসার খরচ দেবে। ভারতের বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রক সংস্থা (ডিজিসিএ) এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭ ফ্লিটের অতিরিক্ত নিরাপত্তা পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে। বোয়িং বলেছে, তারা এয়ার ইন্ডিয়াকে সব ধরনের সাহায্য করবে। এয়ার ইন্ডিয়ার শেষ বড় দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২০২০ সালে। সেবার কেরালায় একটি বিমান রানওয়ে থেকে ছিটকে যায়। ২১ জন মারা যান। ২০২২ সালে টাটা গ্রুপ এয়ার ইন্ডিয়া কিনে নেয়। এই ঘটনা গোটা বিশ্বকেই বিমান নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। তদন্তে আসল কারণ বেরিয়ে এলেই ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে।
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, গার্ডিয়ান