সার্থক সেই প্রচেষ্টা, একই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে সাহিত্যসম্রাট ও বিশ্বকবি

সাক্ষর সেনগুপ্ত: বাংলা সাহিত্যে এহেন নজির বোধহয় আর নেই। একই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন সাহিত্যসম্রাট ও বিশ্বকবি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ওই পত্রিকার নাম বঙ্গদর্শন। ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, রস-রচনাকার বা সাহিত্য সমালোচনার পাশাপাশি তিনি যে পত্রিকা সম্পাদনার কাজেও যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন তার উজ্জ্বল নিদর্শন এই বঙ্গদর্শন পত্রিকা। বিশিষ্ট গবেষক পরিমল ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সেই সময়কার এক অদ্বিতীয় সম্পাদক । বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত বঙ্গদর্শন উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাময়িকপত্রে একটি ‘ক্লাসিক মডেল’, এ পরিণত হয়েছিল । বাঙালির মন ও মননকে জাতীয়তাবোধ ও ঐতিহ্য চেতনায় উদ্বেলিত করে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল বঙ্গদর্শন। সেকথা মনে রেখেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর আবেগপূর্ণ ভাষায় লিখেছিলেন, ‘বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন আসিয়া বাঙালির হৃদয় একেবারে লুঠ করিয়া লইল’।

১২৭৯ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ, ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী ১২ই এপ্রিল ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদর্শন ভবানীপুর এলাকার পিপুলপাতি লেনের একটি ছাপাখানা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। সেইসময় বঙ্কিমচন্দ্র ৩৪ বছর যুবক এবং দুর্গেশনন্দিনী(১৮৬৫খ্রিঃ), কপালকুণ্ডলা(১৮৬৬ খ্রিঃ) ও মৃণালিনী (১৮৬৯ খ্রিঃ) -র মত সাড়া ফেলে দেওয়া তিনটি উপন্যাসের রচয়িতা। পরিমল ভট্টাচার্যের মত অনেকের ধারণা, বঙ্কিমচন্দ্র যখন বহরমপুরে কর্মসূত্রে ছিলেন সেখানেই গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত, রেভারেন্ড লালবিহারী দে প্রমুখ সুধী জনেদের সাহচর্যে আসেন। এই বিশিষ্ট জনেদের আলোচনায় একটি উন্নতমানের বাংলা পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। সেই আলোচনা ফলপ্রসূও হয় কিছুদিনের মধ্যে। প্রকাশিত হয় ওই পত্রিকা। মুদ্রক ও প্রকাশক ব্রজমাধব বসু।

সার্থক সেই প্রচেষ্টা, একই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে সাহিত্যসম্রাট ও বিশ্বকবি

ছবি সৌজন্যে: Google

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে বঙ্কিমচন্দ্র হঠাৎ কেন বঙ্গদর্শন পত্রিকা সম্পাদনা করতে গেলেন? আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমজাদ হোসেনের মতামত, আসলে বঙ্কিমের উপর সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্তের প্রভাব ছিল অনেকটাই বেশি। বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত ‘বঙ্গভূমি শস্যশালিনী বলিয়া কি বাঙলীর দুর্ভাগ্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন “ সমাজকে বন্ধন করিবার রজ্জু সংবাদপত্র । কিন্তু সেরূপ সংবাদপত্র বাংলায় বড় অধিক দেখা যায় না । ……সংবাদপত্র সম্পাদকের কার্য অতি গুরুতর, সকলের দ্বারা তাহার সম্পাদনা সম্ভব না। সংবাদপত্র লেখক রাজার মন্ত্রী, প্রজার বন্ধু, এবং সমাজের শিক্ষক । এই কার্য সম্পাদন করিতে গেলে অসাধারণ বিদ্যা, বুদ্ধি, বিজ্ঞতা, গাম্ভীর্য, বহুদর্শিতা সকলের সহিত সহৃদয়তা আবশ্যক………।”

দেশ ও জাতির উন্নতির জন্যই যে তিনি বঙ্গদর্শনের প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলেন তারও ব্যাখ্যা দেন সাহিত্যসম্রাট। বঙ্গদর্শন প্রকাশের তিনটি উদ্দেশ্য নিজেই ব্যক্ত করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। প্রথমত- তিনি উল্লেখ করেন ‘আমরা এই পত্রকে সুশিক্ষিত বাঙালির পাঠোপযোগী করিতে যত্ন করিব……।’ দ্বিতীয়ত- ‘এই পত্র আমরা কৃতবিদ্য সম্প্রদায়ের হস্তে আরও এই কামনায় সমর্পণ করিলাম যে তাহাদিগের বিদ্যা, কল্পনা, লিপি, কৌশল এবং চিত্তোৎকর্ষের পরিচয় দিক………।’ তৃতীয়ত- যাহাতে নব্য সম্প্রদায়ের সহিত আপামর সাধারণের সহৃদয়তা সম্পর্কিত হয়, আমারা তাহার সাধ্যানুসারে অনুমোদন করিব ..।

পাশাপাশি এই প্রকাশনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষার উন্নতি। বঙ্গদর্শনের প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় ‘পত্রসূচনা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলা ভাষা চর্চার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছিলেন কৃষ্ণকান্তের উইল-এর রচয়িতা। উল্লেখ্য সেটিই ছিল বঙ্কিমের বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম প্রবন্ধ। বঙ্গদর্শনের ভাষা ছিল খুব উন্নত মানের সাধু বাংলা। সাহিত্য, সমাজ, বিজ্ঞান, রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কিত মূল্যবান প্রবন্ধ এবং উপন্যাস এতে প্রকাশিত হত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৮৭৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এর সম্পাদক ও প্রধান লেখক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র বাস্তবিকই একটি গুরু দায়িত্ব পালন করেন। আমজাদ হোসেন-এর কথায়, বঙ্গদর্শনকে তখন শিক্ষিত বাঙালি সমাজের প্রথম মুখপত্র বলা হত, কেননা বাঙালি জাতির আধুনিক চিন্তা ও মনন এই পত্রিকার মাধ্যমেই প্রথম প্রকাশ লাভ করে। বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্ম ও সাম্য বিষয়ক চিন্তা এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়। বঙ্গদর্শনের প্রধান লেখক বঙ্কিমচন্দ্র হলেও গঙ্গাচরণ, রামদাস সেন, অক্ষয় সরকার, চন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বিদগ্ধজনেরাও এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘বন্দে মাতরম্’ প্রথম মুদ্রিত হয় এই পত্রিকায়ই। বঙ্গদর্শনের একটি লেখক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল যেমন দীনবন্ধু মিত্র, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, চন্দ্রনাথ বসু, প্রমুখ। চারবছরে বঙ্কিমের সম্পাদনায় নানা বিষয়ে প্রবন্ধ ও নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল । সাহিত্যের পাশাপাশি রাষ্ট্রনীতি,দর্শন,অর্থনীতি,বিজ্ঞান,ধর্মশাস্ত্র, ইত্যাদি নানা বিষয়ে লেখা প্রকাশিত হত। বঙ্গিমচন্দ্রের ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত হয়েছিল বঙ্গদর্শনের পাতায়। প্রথম সংখ্যার প্রথম প্রবন্ধ ছিল ইতিহাস বিষয়ক । বঙ্কিমচন্দ্র দুঃখ করে লিখেছিলেন ‘সাহেবরা যদি পাখি মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, বাংলার ইতিহাস নাই।……’দ্বিতীয় বর্ষ থেকে বঙ্গদর্শনের বুক রিভিউ বা পুস্তক সমালোচনা শুরু হয় । বঙ্কিমচন্দ্র নিজে হাতে পত্রিকার সব লেখকের লেখা সংশোধন ও সম্পাদনা করতেন।

তাঁর চার বছরে সম্পাদনার সময় বঙ্গদর্শনের পাতায় বহু লেখা লিখলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের নাম ছাপেননি। ‘বিষবৃক্ষ’, ‘ইন্দিরা’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘যুগলাঙ্গরীয়’, ‘রজনী’, ‘রাধারানী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ প্রভৃতি উপন্যাস এবং ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ‘লোকরহস্য’, ‘বিজ্ঞান রহস্য’ প্রভৃতি রচনা প্রকাশিত হয়েছিল এই বঙ্গদর্শনেই। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস এবং বন্দেমাতরম স্তোত্র এখানে প্রকাশিত হয়েছিল। একদিকে বঙ্কিম ‘কমলাকান্তের মুখ দিয়ে বাবু সমাজকে ব্যাঙ্গ করেছেন অন্য দিকে ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ নিবন্ধে গ্রামীণ সমাজে নিঃস্ব কৃষকদের দুর্দশার কথা ব্যক্ত করেছেন। ভারত কলঙ্ক’, ’বাঙালির বাহুবল’ ইত্যাদি রচনায় পরাধীনতার কারণ ও তার প্রতিকারের পথও উল্লেখ করেন।

এর পরে বঙ্কিমচন্দ্র পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব ছাড়লে ১২৮৪ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ইংরেজি ১৮৭৭ সাল থেকে তিনটি পর্বে বঙ্গদর্শনের সম্পাদক হিসাবে পত্রিকাটি প্রকাশের চেষ্টা চালিয়েছিলেন তাঁর ভাই সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তী পর্বে ১৮৮৩ সাল নাগাদ সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন শ্রীশচন্দ্র মজুমদার।কিন্তু এইসময় পত্রিকার মানে অবনমন ঘটার অভিযোগ ওঠে। চন্দ্রনাথ বসু রচিত ‘পশুপতি সংবাদ’ নামে একটি বিরূপাত্মক আখ্যায়িকা প্রকাশিত হলে বঙ্কিম বিরক্ত হয়ে পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দেন । বেশ কয়েকবছর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং নবপর্যায়ে বঙ্গদর্শন প্রকাশের দায়িত্ব নেন। ১৯০১ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বঙ্গদর্শনের সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। বন্ধ হওয়া পত্রিকাটিকে আবার নবকলেবরে প্রকাশের দায়িত্ব কেন নিতে চেয়েছিলেন কবিগুরু ? তার ব্যাখ্যাও তিনিি নিজেই দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-“যে নামকে বঙ্কিমচন্দ্র গৌরবান্বিত করিয়া গিয়াছেন, সে নামের মধ্যে সেই স্বর্গীয় প্রতিভার একটি শক্তি বহিয়া গিয়াছে। সেই শক্তি এখনও বঙ্গদেশে ও বঙ্গ সাহিত্যের ব্যবহারে লাগিবে, সেই শক্তিকে আমরা বিনাশ হইতে দিতে পারি না।” সাহিত্যসম্রাটের প্রচেষ্টাকে এই ভাষাতেই শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন বিশ্বকবি।

তথ্যসূত্র:

  • বঙ্গদর্শন পরম্পরা - ভবতোষ দত্ত বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য - মৃদুলকান্তি বসু
  • বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য প্রতিবেদকের নেওয়া

More Articles