বাদল সরকারের ‘প্রবাসের হিজিবিজি’-তেই ধরা আছে তাঁর তাবৎ কাজের নানা সূত্র
Reading List : যদি জানতাম কোনোদিন আর দেখা হবে না, আমরা পরস্পরের মুখোমুখি বসব না তবে শুধু চিঠি দিয়ে যোগসূত্র রেখে যেতে পারতাম কি? লিখনে কি সব কথা বলা যায়?
Nowadays, national literature doesn’t mean much: the age of world literature is beginning, and everybody should contribute to hasten its advent.
- গ্যোয়েটে
‘প্রবাসের হিজিবিজি’ বইটা তখন ছাপাখানায়। এই বইতে প্রকাশের তারিখ রয়েছে ডিসেম্বর ২০০৬। তবে বইটা ছেপে আসতে লেগেছিল আরও কয়েকটা মাস। এমনই এক সময় বাদল সরকারের ছাদ-লাগোয়া ঘরে কথা হচ্ছে তাঁর সঙ্গে। বইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে থেমে-থেমে কিছুটা পড়ছেন।বাদলদা তখন লন্ডনে। ১৯৫৭-'৫৮ সালের কথা সব। নিজের লেখা পড়তেন সবসময়ই একটু নিচু গলায়। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ যখন পাঠ করেছিলেন ক্যামেরার সামনে, একবার থামিয়ে বলতে হয়েছিল, সামান্য জোরে যদি পড়েন।
এক শুক্রবারের কথা বলছেন বাদলদা। ডিসেম্বর মাস। লন্ডনে বেজায় শীত। সেই শুক্রবারে বাতাসে কিছু পাগলামি ছিল বোধহয়। সেদিন তাঁর নেমন্তন্ন। টিনের খাদ্য সহযোগে আপ্যায়ন। আধ বোতল শেরি কিনে ঘরে ঢুকেছেন— তাঁর বন্ধুরা এলেন। রোজমেরির পোশাক ভদ্র, অর্থাৎ স্কার্ট। আরও রয়েছেন স্টুয়ার্ট এবং এলা। স্টুয়ার্টের পিয়ানোতে রোজমেরি বাজিয়ে চলেছেন একটার পর একটা পিস। এলা চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন কার্পেটে। ঝরনার জলের কুলকুল শব্দ মিশে গেছে রোজমেরির আঙুলে, সাদাকালো চাবির সারিতে। বাদল সরকার লিখছেন— আমার বয়স হয়েছে। নিরঙ্কুশ হল্লার অভ্যাসও বেশ কিছু দিন ধরে নেই। বুঝতে পারছি না কোথা থেকে কোথায় স্রোত বইছে।
আরও পড়ুন-
স্লোভেনিয়ায় ‘সোনার তরী’, নতুন পাওয়া বইবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ
বাদলদার জন্ম ১৯২৫-এ। ১৯৫৮-তে তাঁর বয়স ৩৩। তখনই নিজেকে ভাবেন বয়স্ক মানুষ। এর বছর কয়েক পর থেকেই নিজেকে বৃদ্ধ ভাবতে ভালো লাগত তাঁর। রাত দশটা বেজে গিয়েছে। ফিঞ্চলে রোড ওয়েস্ট এন্ড নয়, ফলে রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। মধ্য রাত্তের নিস্তব্ধতা ভেঙে চারটি প্রাণীর চিৎকার-হাসাহাসি, ফুটপাত বাজিয়ে ছুটোছুটি। হঠাৎই সামনের ভারতীয় রেস্তোরাঁ থেকে এক বাঙালি ছাত্র বেরিয়ে এলো। স্ল্যাকস্ পরা তরুণী মেয়েদের সঙ্গে রাত দশটায় ফিঞ্চলে রোডে হল্লা করার কথা তো নয় এই বৃদ্ধের। বাঙালি ছেলেটির ঝুলে পড়ল চোয়াল। ফলে ‘কী খবর, ভালো তো?’ আর বলা হয়নি। এবার নিচু-ছাদ এক বেসমেন্ট-এ জড়ো হলেন সবাই। ঘরে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক-যুবতীরাও রয়েছেন। তখনও লন্ডনে এঁদের খুব সহজেই ‘নিগ্রো’ বলা হত। এঁরা নিজেরাও নিজেদের পরিচয় দিতেন ‘নিগ্রো’ বলে। ছেলে-মেয়েরা দেওয়াল ঘেঁষে বসে। কোথাও জোড়ায়-জোড়ায়, কোথাও-বা দল বেঁধে। অনেকে আবার চুম্বনরত। রোজমেরিকে বললেন, চুপ করে বসে আছ যে? রোজমেরির প্রশ্ন, কী করব। বাদল সরকার বলছেন— ভেবেছিলাম নাচবে। এইসব খানিকক্ষণ। শেষে স্থির হল, বাড়ি গিয়ে কফি খাওয়া হবে। এলা, স্টুয়ার্ট বাড়ি চলে গেলো। রোজমেরি এলো। কফির পেয়ালায় রম্যাঁ রোলাঁ-র ‘Jean-Christophe’ নিয়ে আলোচনা, রম্যাঁ রোলাঁ-র ‘বিটোফেন’ নিয়েও কথাবার্তা। গানের কোন ধারা ষোড়শ শতাব্দী থেকে কোন পথ বেয়ে নেমে এসেছে, কোথায় কখন কী রূপান্তর হয়েছে, স্কেল-টোন্যালিটি, বেসিক নোটের বাধ্যবাধকতা, আধুনিক যুগে কে কতটা স্বীকার-অস্বীকার করেছে, চুপিচুপি বলে যায়। গান নিয়ে কথা বলার সময় রোজমেরি বলে চলে, দেওয়ালের দিকে দৃষ্টি রেখে। বাগেশ্রী, পুরবী, খাম্বাজের চলনও তার অজানা নয়।

প্রবাসের হিজিবিজি
এই সব কথা বিবিধ বিন্যাসে বলতে-বলতে এসে যায় মনুর কথা। বাদলদা লেখেন— মনু, তুমি আমার জীবনে আজ বহুদিন ধরে আছো। আমাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়েনি এত দূরে এসেও, কারণ জানি আবার কাছে যাব। এই জানার দাম কতটা আগে তা বুঝিনি। যদি জানতাম কোনোদিন আর দেখা হবে না, আমরা পরস্পরের মুখোমুখি বসব না তবে শুধু চিঠি দিয়ে যোগসূত্র রেখে যেতে পারতাম কি? লিখনে কি সব কথা বলা যায়? বছরের পর বছর? অতীতের অনেক যোগাযোগ চেনা-বোঝা ভবিষ্যৎও লাগে। ভবিষ্যৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে বর্তমানও থাকে না।

মার্গারিট রাওলিংস
প্রিয়জনের মৃত্যুশোক, বিচ্ছেদব্যথা এত কঠিন তাহলে হত কি? ভবিষ্যৎ, বর্তমান অপস্রিয়মাণ হলে অতীতও দিনে দিনে মিলিয়ে যায়। এভাবেই বোধহয় মানুষের সঙ্গে আরেকজনের সংলগ্নতা। এলার সঙ্গে আমার ভাবের কোনও পাকা বুনিয়াদ নেই। এত দূরে, নিঃসঙ্গ জীবন। প্রেম হতেই পারতো। কেন জানি না তা হল না। এমনই কত সব ব্যাখ্যাতীত প্রশ্ন নিয়ে আমাদের কাজ-কারবার। এই যে শীত-রাতে বসন্তের আবির্ভাব, এ কি আদৌ প্রত্যাশিত ছিল? পিয়ানোর শব্দ, কৃষ্ণাঙ্গদের সম্মিলিত গান, ফুটপাতের নাচ, সব মিলিয়ে কত পুরোনো কথা বোঝার চেষ্টা। এখন প্যারাফিন বার্নারটার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে তোমাকে চিঠি লিখছি। এতদূর পড়ার পর বাদলদা ছোট করে কাটা আধ-খাওয়া সিগারেট ধরিয়েছেন। আমার সিগারেটের বাড়তি ধোঁয়া সরিয়ে নিতে আমি পাশের ছাদে দাঁড়ালাম। বাড়ির পাশে বাড়ি। উত্তর কলকাতা। রাত্রি তখন আটটা মতো বাজে। আকাশে জ্বলজ্বল করছে শুক্লপক্ষের চাঁদ। দিক-দিগন্তর থেকে তখন সন্ধ্যা সংগীতের আয়োজন। বিটোফেনের নাম কিংবা খাম্বাজের অনুষঙ্গে মনে আসছে দু-একটা গান। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক অতীতকথা যার মধ্যে মিশে আছে অনেকগুলি কবিতার লাইন:
অন্ধ যখন বৃষ্টি আসে আলোয়
স্মরণ-অতীত সাঁঝবেলারা সব
এগিয়ে দিতে এল নদীর ধারে—
নদীর ধারে বসন্ত উৎসবঅন্ধ যখন বৃষ্টি আসে আলোয়
পথ চললাম দূর্বাদলের পথে
আমার হাতে চিরঅতীত কাল
রৌদ্র পড়ে সুদূর ভবিষ্যতে...
বাদলদা অতীত-ভবিষ্যতের স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন প্যারাফিন বার্নারের আলোয় এক উদ্দাম রাত্রিতে। জয় গোস্বামী বসন্ত উৎসবকে উদ্ভাসিত করলেন বাংলা-দেশের নদীর জলধারায়। ‘ঘরের পরে আকাশ— ধনুক-বাঁকা/ আগুন রঙের সাঁকো!/ স্মরণ-অতীত সময় এপার ওপার—/ কবি কখন কোন সময় থাকো...’।

অঞ্জলি বসু
দার্শনিক কিয়ের্কেগার্দ বলেছিলেন, যে যেখানে থাকে সে কি সেখানে আদৌ থাকে? অঞ্জলি বসুকে (মনু) লেখা চিঠিগুলো থেকে বাদল সরকারের হদিশ জানা যায় ব্রিটিশ রাজধানীতে। এর পর ইংল্যান্ডে বড়দিন এগিয়ে আসছে। শীতের প্রাবল্যও বেড়েছে। শুক্রবারের বসন্ত উৎসব এখন অলীক। বাদলবাবুর মনে পড়ছে কলকাতার কথা। এই শহর তাঁর অনেক কিছু জানে। তিনি নিজেই বলতেন, কলকাতার সঙ্গে তাঁর love-and-hate relationship। এই নিয়ে তাঁর কথা হয়েছে অভিনেত্রী তথা চিত্রনির্মাতা অপর্ণা সেনের সঙ্গে। এখানে বসেই তিনি ‘নীল দিগন্তের নক্ষত্র’, ‘সিন্ধুর লেখা’, ‘ভেরকর’, ‘সমুদ্রের মৌন’ পড়েছেন। লন্ডনের শীত বড় স্যাঁতস্যাঁতে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি, তুষারপাত— সব মিলিয়ে আলো-অন্ধকারে মিশে এক-একটা দিন। রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালের প্রতীক্ষা নিয়ে দিনান্ত। এরই মধ্যে উত্তাল বাতাস হাড় পর্যন্ত বিদ্ধ করে। ফায়ার প্লেস-এ আগুন নেই। একের পর এক বিষণ্ণ সন্ধ্যা যেন ন্যস্ত হয়ে পড়ে আছে শহরের রাজপথে। রাতে তুষারপাতে জোয়ার লাগে। শীতের হাওয়া যেন বিদ্ধ করছে তাঁর চোখের মণিকেও। রাত বাড়ে, বৃষটিও বেড়ে চলে। শীতের পোশাক অপর্যাপ্ত। স্ট্র্যাটফর্ড অ্যাভন যাওয়ার আগে কিনে নিয়েছিলেন ‘Shakespeare Complete Works’। এর জন্য শাস্তি, প্রায় দেড় দিনের অনাহার। তখন নিমজ্জিত শেক্সপিয়রে। অতএব ক্ষুধা-তৃষ্ণার বালাই নেই। পড়তে-পড়তে মুখস্ত হয়ে যাচ্ছে ম্যাকবেথের এক-একটা অংশ—
Tomorrow, and tomorrow, and tomorrow
Creeps in this petty pace from day to day
To the last syllable of recorded time;
And all our yesterdays have lighted fools
The way to dusty death. Out, out, brief candle!
Life’s but a walking shadow, a poor player
That struts and frets his hour upon the stage
And then is heard no more. It is a tale
Told by an idiot, full of sound and fury,
Signifying nothing.
ওই শীত ভুলতে পড়ছেন ইউজিন ও’নিল, অন্দ্রে জিদ, টমাস মান প্রভৃতি। সকলে শীতের ছুটিতে বাড়ি গেছে। একদা নিঃসঙ্গতা তাঁকে কষ্ট দিত। প্রায় শারীরিক কষ্ট। এই সময়ের নিঃসঙ্গতাকে স্বাগত করে নিচ্ছেন। পথে বেরোনোর চেয়ে ঘরে থাকাই ভালো। আবার একলা ঘরে শুয়ে থাকলে কারও মুখই মনে পড়ে না। ইতোমধ্যে বছর কাবার হল। নতুন বছরে স্কটল্যান্ডে উৎসব। লন্ডনে ছেলে-ছোকরারা ইংরেজ স্কচ মানে না। ট্রাফালগার স্কোয়্যারে ৩১ ডিসেম্বর রাত বারোটাকে অভিনন্দন জানাতে বিশাল ভিড় হয়। আসল উল্লাস রাত বারোটার পরে। সাংঘাতিক হইচই, নাচ-গান। ছেলেরা রীতিমতো তাড়া করে মেয়েদের চুমু খাচ্ছে। আকাশে বাতাসে ঝাঁঝালো মিষ্টি মদের গন্ধ। এর পরেই, ২ জানুয়ারি, চিঠিতে লিখছেন— দুঃখ, বিরক্তি, নিপীড়ন, হতাশা, সমস্ত কল্পনা-আশা এইসব মিলিয়ে কি আজকের দিন? কলকাতায় এখন ঝলমলে রোদ। বাজারে কপি, পালং শাঁক ইত্যাদির হাজারো পসরা। কলকাতার আলো যেন চেনাই যায় না। শীতের দিনে কলকাতার রাস্তাঘাট চিনতে পারাই মুশকিল। গরমের দিনগুলোতে যারা চোয়াল শক্ত করে হাঁটে তারাও হাসিমুখে থলে ভরে বাজার করছে। প্রকৃতির প্রসন্নতা স্পর্শ করেছে মানুষের ত্বক। ফুলের দোকানেও নানারকম ফুলের সম্ভার— সব মিলিয়ে আবার নতুন ছবি।
স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল
অন্য দেশ অন্য কোনো রাজার,
তোমার গ্রামে রেল ব্রিজের তলে
ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার...
(উৎপলকুমার বসু)
এই ছবি যেন বাদল সরকারও লিখে রাখতে চাইছেন তাঁর ডায়রিতে কিংবা অঞ্জলি বসুকে লেখা চিঠিতে। এর পর সেই ‘জুলিয়াস সিজার’ ‘ম্যাকবেথ’ দেখার পালা। এসবের মধ্যেই লেখা হয়ে যাচ্ছে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এর কবিতাগুলো— ‘নাগরদোলার আবর্ত-ছাঁদে গড়া/ আমি এলোমেলো আকাশে এনেছি নেশা/ অজ্ঞ বাতাস চেতনার বিষে মেশা,/ না জানা ছন্দে ভাঙাচোরা বোঝাপড়া...’ কিংবা ‘আমি বিভক্ত, আমি অণুখণ্ডিত,/ গুঁড়ো দিয়ে গাঁথা জটিল ঐক্যতান।/ বুড়ো শতাব্দী আজো পেতে আছে কান,/ চূর্ণ পৃথিবী এখনো অপরাজিত।’ গদ্যে লেখা চিঠিগুলো আকার নিচ্ছে কবিতার। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বা গানের অংশ প্রবেশ করছে গদ্যশরীরে। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এর সেই যে অংশ, যেখানে অমল, বিমল, কমল এবং ইন্দ্রজিৎ-এর ইন্টার্ভিউ, সেই দৃশ্য শুরু হওয়ার আগেই লেখক সরাসরি দর্শকদের বলে ওঠে— না না এক মিনিট এক মিনিট। ভুলে গিয়েছিলাম। এর আগে একটুখানি আছে। ও চেয়ারগুলো এখানে নেই। বেঞ্চিটা ভুলে যান। এখানে সবুজ ঘাস। ওইগুলো গাছ। আর ওই, ওই দিকে গাছগুলোর ঝাঁকড়া মাথার ফাঁকে রোজ যে সূর্যটা ওঠে সেটা আজকেও উঠেছিল। এখন অস্ত যাচ্ছে। ওইখানে, ওইদিকে ওই ঝাঁকড়া ডালপালার ফাঁকে এক রাশ সিঁদুরে রঙ। ইন্দ্রজিৎ মানসীকে বই দেয়। মানসী বলে— তুমি পাশ করেছো আমারই তো বই দেওয়ার কথা। ইন্দ্রজিৎ জানায়, নিয়ম মেনে সবকিছু করা তার মোটেও পছন্দ নয়।
আরও পড়ুন-
বাদলদাকে প্রশ্ন করেছিলাম এই দৃশ্যায়নে ইন্দ্রজিৎ কী বই দেয় মানসীকে। বাদলদা নিচু গলায় বলেছিলেন— কবিতার বই। ‘প্রবাসের হিজিবিজি’ বই থেকেই জানা যাচ্ছে, ‘Theatre in the Round’ বা Arena Theatre-এ বাদল সরকার দেখেছিলেন Jean Racine-এর ‘Phedre’। অভিনয় করেছিলেন মার্গারেট রলিংস। এই অভিনেত্রী অভিনয় করছেন গত শতকের তিনের দশক থেকে। ‘Trojan Woman’-এ হেলেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, Theatre Royal Haymarket-এ ‘Pygmalion’, চারের দশকে ‘The Importance of being Earnest’ হয়ে পৌঁছেছেন লেডি ম্যাকবেথের চরিত্রে। ক্রিস্টোফার ফ্রাইয়ের নাটকে পিটার ব্রুকের নির্দেশনায় কাজ করে ১৯৫৭-এ Jean Racine-এর ‘Phedre’। মার্গারেট রলিংস-এর অভিনয় দেখে তিনি প্রায় বাকরুদ্ধ। তখনও জানেন না মার্গারেট রলিংস-এর অভিনয়-জীবনের কথা। অকপটে লিখেছেনও সে-কথা ‘প্রবাসের হিজিবিজি’-তে। এক সমালোচক এই নিয়ে নিন্দার তীরে বিদ্ধও করেছেন— বাদলদা অবিচল। উনি নিজেই বলতেন, আমি নাটক দেখেছি কম, পড়েছি অনেক বেশি, শুনেছিও বিস্তর। ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে ‘fiction’ হলে বই দেয় তিনটে, non-fiction ছ’টা। নাটককে non-fiction বিভাগেই রেখেছেন কর্তৃপক্ষ। বাদলদা ছ’টা করে নাটকের বই নিয়ে এসেছেন। খাওয়ার খরচ বাঁচিয়ে বই কিনেছেন। পথে-ঘাটে বিক্রি হওয়া পুরোনো পোশাক সামান্য দামে কিনে শীতের মোকাবিলায় প্রস্তুত থেকেছেন।

বাদল সরকার
‘প্রবাসের হিজিবিজি’ বই জুড়ে তাঁর নিজেকে উন্মোচন। তাঁর পারা না-পারা, অজস্র সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছেন সামান্য দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ত্যাগ করে। বরং নিজের গুণের কথা লেখেননি বললেই চলে। বইয়ের চলনও গদ্যে-পদ্যে মেশানো। বাদল সরকার— এই লেখককে জানতে গেলে ‘প্রবাসের হিজিবিজি’-র গুরুত্ব অপরিসীম। অঞ্জলি বসু এক বিরাট প্রকাশকের কন্যা। ‘বাংলা চরিতাবিধান’-এর অন্যতম প্রধান কারিগর। কারো-কারো মনে পড়বে, ১৯৬৩ থেকে ’৬৮ এই কালপর্বকে বাদলবাবু বলতেন তাঁর ‘ভুতে পাওয়া’ বছর। এই বছরগুলিতেই লেখা হয়েছে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘যদি আরেকবার’, ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘বল্লভপুরের রূপকথা’, ‘পরে কোনোদিন’, ‘সারা রাত্তির’ এই নাটকগুলি। আজও, তাঁর শতবর্ষে মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে এই রচনাসমূহ বিবিধ বিন্যাসে, দেশে-বিদেশে।
বাদল সরকারের দীর্ঘ দিনের সঙ্গী ‘শতাব্দী’-র একজন প্রধান সদস্যা বাদলদাকে প্রশ্ন করেছিলেন— ’৭২-’৭৩-এ যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যে আপনার পাশে আমরা এসে দাঁড়ালাম সেই উত্তাল সময়ের কথা ততটা যেন পাওয়া গেল না ‘প্রবাসের হিজিবিজি’ বা ‘পুরোনো কাসুন্দি’-তে। আমাদের মনে হয়, বাদল সরকার অনেকান্ত। জীবনের বিভিন্ন পর্বে তাঁর রচনাশৈলী নতুন পথে বাঁক নিয়েছে। তাই সহযাত্রীদের তিনি বলেছিলেন— আমাকে তো এত কাছ থেকে দেখছিস। এবার তোরা লিখবি।
আরও পড়ুন-
নিজের বইয়ের ‘অন্ত্যেষ্টি সৎকার’ করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ
‘প্রবাসের হিজিবিজি’ বই প্রকাশিত হয়েছে বাদল সরকারের জীবনের উপান্ত বেলায়। ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান অধিকাংশ পুরস্কারে তিনি ততদিনে সম্বর্ধিত। তাঁর লেখা প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায়। এক-এক ভাষায় একাধিক কৃতবিদ্যজন তর্জমা করছেন তাঁর নাটক। এমন শান্ত পরিস্থিতিকে তিনি নিজেই উচাটন করলেন তাঁর প্রথম জীবনের সমস্ত স্মৃতি পাঠকের সামনে উপস্থিত করে। তিনি নিজেকে কখনও বিশেষ প্রতিভাধর বলতে চাননি। বরং বলেছেন, সকলে পারবে। প্রয়োজন চেষ্টা আর অধ্যাবসায়ের। নাটক নিয়ে তত্ত্ব-তলাশের প্রচেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু লেখার সময় ওগুলো কাজে দেয় না বরং পথরোধ করে— এমনই ভাবতেন তিনি। Biographical criticism-এর পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি কোনোদিনও। তবে মানুষের কথা বলতে হবে, এটাই তিনি ভেবেছেন, এবং সেই সুবাদে তাঁর অন্তর্জীবন এবং বহির্জীবনকে মেলে ধরেছেন অবলীলাক্রমে।
‘প্রবাসের হিজিবিজি’-তে এক এমন চুম্বক লুকিয়ে রয়েছে যাতে ধরা পড়ে বাদল সরকারের তাবৎ কাজের নানা সূত্র। ‘অলিভার টুইস্ট’ উপন্যাসে চার্লস ডিকেন্স যে লন্ডনকে দেখিয়েছিলেন, সেই অঞ্চল ঘুরে ঘুরে স্কেচ করেছিলেন বাদলদা। প্রথমাবধি তিনি শাখাপ্রশাখা বিস্তার করছেন দিগন্ত জুড়ে। বাধাও পেয়েছেন বিস্তর। কখনো প্রতিরোধ হয়েছে তাঁর ভিতর থেকে। সে-কথাও আড়াল করতে চাননি বাদলদা। হাতির দল, শিঙা-ঢাক-ঢোল প্রভৃতি ঐতিহ্যবাহী শাশ্বত স্মারক সঙ্গে নিয়ে তাঁকে যখন সম্মান জানায় কেরল সরকার, মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকেন তিনি। ‘প্রবাসের হিজিবিজি’-র যে মানুষটি বই কিনে পড়ার জন্য দেড় দিন উপবাস করেছিলেন, তিনি যে জীবনের সেই পর্বগুলিকে খাটো করতে চান না এ-কথার প্রধান সাক্ষ্য বহন করে এই বইটি। সেই জন্যেই তাঁর বাড়ির দ্বার অবারিত। সেই পথে নির্গত হয়ে তিনি পৌঁছে যান বার্মিংহাম, নিউ ইয়র্ক, থাইল্যান্ড, লাওস, লাহোর, ঢাকা ঘুরে মাডুরাই কিংবা রাঙাবেলিয়ার গ্রামে। অঞ্জলি বসু তো এক সময় বাদলদার সঙ্গে থিয়েটার করতেন। নিজেই প্রকাশ করেছেন বাদল সরকারের একের পর এক নাটক। বিদুষী এই নারী দু’কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাদলবাবুর নাটক পৌঁছে দিয়েছেন কলেজ স্ট্রিটের দোকানে দোকানে। ‘প্রবাসের হিজিবিজি’ বইটি আদতে বাদল সরকার ও অঞ্জলি বসুর সমবায়ী গরজের ইতিহাসও বটে।

Whatsapp
