শব্দের থেকেও তিনগুণ জোরে ছুটবে মিসাইল, ব্রাক্ষ্মস জুড়েছে ভারত-রাশিয়াকে!
Our scientific power has outrun our spiritual power, we have guided missiles and misguided men.
--Martin Luther King, Jr.
২৮ জানুয়ারি, ২০২২, ফিলিপিন্স ৩৭৮.৯৬ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করল ব্রাহ্মস এরোস্পেসের সাথে। ব্রাহ্মস তাদের যোগান দেবে জাহাজ ধ্বংসকারী সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল। এই রফতানির চুক্তি ব্রাহ্মসের ক্ষেত্রে প্রথম, এবং দেশের এখনও পর্যন্ত সবথেকে বড় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তি লাভ। এতদিন পর্যন্ত ভারত বেশিরভাগ অস্ত্র শুধু আমদানিই করত। ফিলিপিন্সের এই এত বড় অঙ্কের ক্রয় তা পাল্টে দিল। এখানে একটা ছোট্ট তথ্য এখনও পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এই ব্রাহ্মস কিন্তু ভারতের একার উদ্যোগ নয়, এটি একটি যৌথ উদ্যোগে বানানো সংস্থা। ভারতের এই উদ্যোগে মালিকানা সত্তর শতাংশ।জানেন সেই যৌথ উদ্যোগের বাকি তিরিশ শতাংশের ভাগীদার কে? রাশিয়া।
ভারত আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সফল ভাবে পরীক্ষা করল নতুন ব্রাহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলের। এই মিসাইল দেশের পৃষ্ঠ থেকে শত্রু দেশের পৃষ্ঠে শব্দের থেকে দ্রুতগতিতে আঘাত হানতে সক্ষম। এর আগে ব্রাহ্মসের পাল্লা ছিল ২৯০ কিমি। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০০ কিলোমিটার। দেশের সেনার সব বিভাগই এই মিসাইলকে গ্রহণ করেছে, এবং জানা যাচ্ছে, জল, স্থল এবং বায়ু, সব জায়গা থেকেই বিশ্বের দ্রুততম এই মিসাইলকে নিক্ষেপ করা সম্ভব।
সেনার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে মিসাইল একেবারে নিখুঁত ভাবে লক্ষভেদ করেছে। বায়ু সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে আইনমন্ত্রী কিরণ রিজিজু সবাই শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাচ্ছেন, সরকারের অন্দরে এখন তীব্র খুশির হাওয়া। কিরণ রিজজু মিসাইল উৎক্ষেপণের ভিডিও টুইট করে লিখেছেন, "ডিআরডিও ইন্ডিয়ার সমস্ত বিজ্ঞানী ও সদস্যদের আমি শুভেচ্ছা জানাই। এটি দেশের জন্যে একটি গর্বের মুহূর্ত।"
ব্রাহ্মসের ব্যপারে বিশদে জানা যাক।
শুরুতেই জানিয়েছি ব্রাহ্মস ইন্দো-রুশ যৌথ প্রকল্পের ফসল। ভারতের ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (DRDO), এবং রাশিয়ার এনপিও মাশিনোস্ত্রোয়েনিয়া মিলে এই মিসাইল তৈরি করে। ব্রাহ্মসের নামকরণ হয় ভারতের ব্রহ্মপুত্র ও রাশিয়ার মস্কভা নদীর নাম অনুসারে। এই মিসাইল সংস্থার মালিকানার সত্তর শতাংশ ভারতের হাতে থাকলেও প্রযুক্তি রাশিয়ার।
প্রথমে শুধু মাত্র জাহাজ ধ্বংস করার জন্যেই এই মিসাইল তৈরি করা হচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই মিসাইলের ক্ষমতা বাড়ানো হয়, অনেক ধরণের প্রযুক্তি যোগ করে এখন এতটাই সক্ষম এই মিসাইল যে এটি যেকোনো জায়গা থেকে ব্যবহার করা সম্ভব এবং শুধু জাহাজ নয়, অন্যান্য লক্ষবস্তুকেও এটি আঘাত করতে পারে। এমনকি ডুবোজাহাজ থেকেও এই মিসাইলকে নিক্ষেপ করা সম্ভব। ভারতীয় সেনার কাছে এই মিসাইল এখন এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে যে অরুণাচল প্রদেশেও দেশের সীমান্তে এই মিসাইলকে রাখা হয়েছে।
শুরুতে এই মিসাইলের পাল্লা ছিল ২৯০ কিমি। এই মুহূর্তে ৪০০-৪৫০ কিলোমিটার করার চেষ্টা চলছে, এবং অদূর ভবিষ্যতে এর পাল্লা ৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে দুই দেশের।
ভারত ব্রাহ্মসকে সামনে রেখে শুধু নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করতে চাইছে তা নয়। অস্ত্র প্রস্তুতকারক হিসেবেও বিশ্বের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে চাইছে। শুধু ফিলিপিন্সই নয়, থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়াও ভারতের থেকে ব্রাহ্মস কিনতে আগ্রহী বলে জানা যাচ্ছে। গত বছর ডিসেম্বরেই লখ্নোতে এই ব্রাহ্মসের একটি কারখানার উদ্বোধন করেন দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনি সেই অনুষ্ঠানে জানান, এই মিসাইল ভারতের আগ্রাসন নয়, বরং শক্তির পরিচয় দেবে এবং সেই সঙ্গে গোটা বিশ্বকে এই বার্তাও দেন, যদি দেশের সার্বভৌমত্বে কোনো আঘাত আসে তাহলে সবার জানা উচিত ভারতের হাতেও জবাব দেবার অস্ত্র রয়েছে।
খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা, এবং এই অনুষ্ঠানের ঠিক দু মাস পরেই ইউক্রেনে আঘাত হানে রাশিয়া। যে বিষয়টি বোঝার, সেটি হল এই মিসাইল পরীক্ষার সময়। বিশ্বে এই মুহূর্তে একটি ঠান্ডা যুদ্ধের আবহ তৈরি হয়েছে, ইউক্রেনে আগ্রাসন দেখিয়ে ঘরে বাইরে রাশিয়া এই মুহূর্তে ভয়াবহ চাপে। ভারত যতোই মুখে বলুক তারা এই যুদ্ধ যাতে দ্রুত বন্ধ হয় তার পক্ষপাতী, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনোভাবেই ভোট দেয়নি তারা। ঠিক এই সময়েতেই ব্রাহ্মসের এই পরীক্ষা কি রাশিয়ার পাশে আরও দৃঢ় ভাবে থাকার প্রচ্ছন্ন বার্তা?
তাছাড়া আরো একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার। ভারত এই টালমাটাল সময়ে নিজেকে অস্ত্র প্রস্তুতকারক হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। চাইছে এশিয়ার বাজার ধরতে। কারণ রাশিয়ার এই আগ্রাসন আগামী কয়েক দশকের জন্যে পাকাপাকি ভাবে বিশ্বশান্তির সমস্ত আশা ঘুচিয়ে দিয়েছে। সব দেশেই এখন তাদের প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বৃদ্ধি করছে এবং ভারতও সেই তালিকায় আছে। একই সাথে পশ্চিম এশিয়ার বাজারে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা কোনো ভাবেই হাতছাড়া করতে রাজি নয় তারা। মনে রাখা দরকার, অস্ত্র বিক্রয়ে শুধু অর্থ উপার্জন হয়না, সেই দেশে প্রভাব ও বিস্তার করা যায়। যে কারণে ভারত কোনোভাবেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দান করতে পারবেনা। চিন যেভাবে নিজের আগ্রাসন দেখিয়ে ভারতকে ঘিরে ফেলতে চাইছে, তাতে ভারতকে পাল্টা নিজের প্রভাব এই মহাদেশে বৃদ্ধি করতেই হবে।
এতো গেল কঠিন সব অঙ্কের কথা। কিন্তু মানুষের কী হবে? বিশ্ব শান্তির, মানবতার কী হবে? শান্তির বার্তা দেওয়া দেশ ভারতও আজ অস্ত্র প্রস্তুতকারী দেশ হয়ে উঠেছে। বাজারের সহজ নিয়ম যদি দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে যে এত অস্ত্র বানালে তা বিক্রি তো করতে হবে, যুদ্ধ ছাড়া এই সব পণ্যের ব্যবহার কোথায়? শান্তি রক্ষার জন্যে একটি জাতি আরো বেশি বেশি অর্থ খরচ করে শুধু অস্ত্র কেনা বেচা করবে? এ কেমন সভ্যতা তৈরি হল আমাদের? খবর আসছে, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াও সব পাল্লা দিয়ে মিসাইল পরীক্ষা করছে। রাশিয়া রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করছে ইউক্রেনের ওপর। ইয়েমেনে আবারো যুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছে। ইমরান খান সব ইসলামিক দেশকে বার্তা দিচ্ছেন একজোট হওয়ার। চিন আমেরিকার কথা বাদই দিলাম।
তাহলে? আমরা বরং নীরব দর্শক হয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা উপভোগ করি। আজ তেল গ্যাসের দাম বাড়ছে, কাল সময় খারাপ হলে মিসাইলের মুখোমুখি হতে হবে।