২৯৫ টাকা থেকে শুরু করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা, কোন রহস্য লুকিয়ে ব্রিটানিয়ার সাফল্যে
Britannia : বিস্কুট, কেক থেকে শুরু করে হাল আমলের ডায়েট কুকিজ সবেতেই রংচঙে প্যাকেট নিয়ে হাজির ব্রিটানিয়া
এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট, সকাল শুরু এমন মোক্ষম বন্ধু আর কে আছে! আজকাল চায়ের সঙ্গে ‘টা’ হিসেবে কুকিজ অথবা নিমকির চল হয়েছে ঠিকই তবে বিস্কুটের চিরাচরিত জার্নি তাতে ফিকে হয়না একরত্তিও। যুগ বদলেছে, আধুনিকতা গেঁড়ে বসেছে বিস্কুটের সাম্রাজ্যেও। খাস্তা নোনতা নানা কিছুর সঙ্গে জায়গা দখলের একটা অবিরাম লড়াই চালাতে চালাতে বিস্কুট কবেই হয়ে গিয়েছে ট্রেন্ডি। মানুষ এখন বিস্কুট না বলে কায়দা করে ‘বিস্কিট’ বলাকেই দস্তুর ভেবে নিয়েছেন। কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না সকালে ঘুম ভেঙে হাতড়ে খোঁজা কৌটোটার। ঢাকনা খুললেই শান্তি। হালকা খিদে অথবা রোজকার অভ্যাস বিস্কুট কামড় দিয়েই সুখ।
আর বিস্কুট বলতেই বাঙালির যে নামটা সবার প্রথমে আসে তা হল ব্রিটানিয়া। মারি বিস্কুট থেকে শুরু করে হাল আমলের ডায়েট বিস্কুট সবেতেই রংচঙে প্যাকেট নিয়ে হাজির ব্রিটানিয়া। বিস্কুট নিয়েই জনপ্রিয়তা শুরু এই কোম্পানির তবে কেক, পাউরুটি, টোস্ট সবেতেই সে পিছনে ফেলেছে বহু সংস্থাকে। কলকাতা বলে নয় এ দেশের যে কোনও প্রান্তের মানুষের পছন্দের তালিকায় ব্রিটানিয়া কোম্পানির কোনও না কোনও দ্রব্য উঠে এসেছে কখনও না কখনও।
এ দেশের প্রথম বিস্কুটের কোম্পানি হল ব্রিটানিয়া। ১৮৯২ সালে কলকাতায় একদল ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর হাত ধরে পথ চলা শুরু করে ব্রিটানিয়া। সেই ব্যবসায়ীদের হাতে তখন সম্বল বলতে ছিল মাত্র ২৯৫ টাকা। তাই নিয়েই যাত্রা শুরু। প্রথমদিকে কলকাতার দমদম এলাকায় একটি বাড়িতে এক চিলতে ঘরেই তৈরি হত বিস্কুট। এর কিছুদিন পর এই সংস্থাটি কিনে নেয় গুপ্ত ব্রাদার্স। নলিন চন্দ্র গুপ্ত ছিলেন তখন সংস্থার প্রধান। তিনিই ভিএস ব্রাদার্স হিসাবে উদ্যোগটি পরিচালনা শুরু করেন সেই সময়ে। তাঁরই আমলে ১৯১০ সালে প্রথম ইলেকট্রিক মেশিনে বিস্কুট উৎপাদন শুরু করে কোম্পানিটি। যদিও তারপর শতাব্দী প্রাচীন যাত্রায় বারবার সংস্থার অংশীদারিত্ব, মালিকানা এবং শেয়ারহোল্ডিং দফায় দফায় পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯১৮ সালের মধ্যেই বদল আসে ব্যবসায়। গুপ্ত ব্রাদার্স-এর হাত ধরেই ইংরেজ ব্যবসায়ী সুয়শ চার্লস আসেন ব্যবসায়। তাঁর নেট্রেতেস্থা তুলে দাঁড়ায় কোম্পানি। এরপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি সংস্থাকে। ওই বছরই কলকাতায় বসবাসকারী অন্য একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী সিএইচ হোমস এতে অংশীদার হিসেবে যোগ দেন। এই সময় থেকেই চালু হয় ব্রিটানিয়া বিস্কুট কোম্পানি লিমিটেড । পরে অবশ্য গুপ্ত ব্রাদার্সের হাত ধরেই আবার পিক ফ্রেন এবং এবিআইএল কোম্পানির কাছে চলে যায় ব্রিটানিয়া।
আরও পড়ুন - কয়েক লক্ষ মানুষের টিফিন মানে আজও বাপুজী, ৫০ ছুঁইছুঁই বেকারির যাত্রাপথকে সেলাম
ক্রমেই তখন জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে ব্রিটানিয়া। ঘরে ঘরে ঘুম ভাঙছে ব্রিটানিয়ার কামড়ে। তাই ১৯২১ সালে আরও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল গ্যাস ওভেন আমদানি শুরু করে কোম্পানি। জনপ্রিয়তা আরও বাড়লে ১৯২৪ সালে মুম্বই শহরে স্থাপিত হয় কোম্পানির পরবর্তী শাখা।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটানিয়া কোম্পানির বিস্কুট আরও বেশি চাহিদা তৈরি করতে শুরু করে মানুষের মধ্যে। এই সময় ভারতের মিত্র শক্তির দেশগুলি থেকে বিপুল হারে অর্ডার পায় ব্রিটানিয়া, যা সার্বিকভাবে ব্যবসার গ্রাফে বড় পরিবর্তন আনে। শুধু তাই নয়, এই সময় কোম্পানির বার্ষিক বিক্রির হার ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১.৩৬ কোটি টাকা ছুঁয়ে ফেলে।
এরপর সময় যত এগিয়েছে, বদলানো চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এসেছে নয়া পণ্য। ১৯৫৪ সালে ভারতে প্রথম উচ্চ মানের স্লাইসড এবং মোড়ানো রুটি নিয়ে আসে এই কোম্পানিই। এর ঠিক পরের বছর বাজারে আসে ব্রিটানিয়া কোম্পানির চিনি লাগানো বারবন বিস্কুট। যা আজও আট থেকে আশি সকলেরই পছন্দের তালিকায় জাঁকিয়ে বসে আছে। এর প্রায় নয় বছর পর ১৯৬৩ সালে ব্রিটানিয়া কোম্পানির হাত ধরে বাজারে আসে কেক। পকেট কেক অথবা টিফিন কেকের ব্যবসায় দারুণ সাফল্য পায় এঁরা।
এরপর ১৯৭৯ সালের ৩ অক্টোবর কোম্পানির নাম ব্রিটানিয়া বিস্কুট কোম্পানি লিমিটেড থেকে বদলে করা হয় ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। নাম বদলের ঠিক তিন বছরের মধ্যেই আবার হাত বদল হয় ব্যবসার। ১৯৮২ সালে একটি আমেরিকান কোম্পানি, Nebisco Brands Inc. পিক ফ্রান্সিসের কাছ থেকে একটি অংশ কিনে নেয়। শুধু তাই নয়, ব্রিটানিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারহোল্ডারও চলে যায় নতুন সংস্থার দখলে। এই বদল অবশ্য ব্যবসায় প্রভাব ফেলতে পারেনি। ১৯৮৩ সালেই কোম্পানিটি বিক্রয় ১০০ কোটি ছুঁয়ে ফেলে। এরপর ১৯৮৬ সালে , ব্রিটানিয়া নিয়ে আসে জনপ্রিয় ‘গুড ডে’ ব্র্যান্ড। তারপর ব্যবসার সুবিধার জন্য ৩ বছরের মাথায় কার্যনির্বাহী কার্যালয় ব্যাঙ্গালোরে স্থানান্তরিত করে ব্রিটানিয়া।
এরপর একে একে বাজারে আসে লিটল হার্টস, 50-50 বিস্কুট এবং দুগ্ধজাত পণ্য। নতুন প্রোডাক্টের হাত ধরে রীতিমত লাফিয়ে বাড়তে থাকে ব্যবসা।এরপর ২০০০ সালে, ফোর্বস গ্লোবালের তিনশোটি ছোট কোম্পানির তালিকায় জায়গা করে নেয় ব্রিটানিয়া। ২০০৪ সালে সুপারব্র্যান্ডের মর্যাদা পায় কোম্পানি। ২০১২ সালে পায় এশিয়া প্যাসিফিক কোয়ালিটি অর্গানাইজেশন থেকে গ্লোবাল পারফরম্যান্স এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। হাল আমলের চাহিদা মাথায় রেখে ২০১৪ সালে, ব্রিটানিয়া একটি সুপার প্রিমিয়াম চকোলেট চিপ কুকি গুড ডে চাঙ্কিজ চালু করে। একে বাজারে আনার জন্য, Amazon-এর সঙ্গে একচেটিয়া চুক্তি করে ব্রিটানিয়া। এর তিন বছর পর গ্রীক কোম্পানি Chipita SA এর সঙ্গেও একটি যৌথ উদ্যোগ শুরু ব্রিটানিয়া।
আরও পড়ুন - বঙ্গভঙ্গ থেকে নকশাল আন্দোলন, ১২০ পেরিয়েও কলকাতার সেরা কেক ঠিকানা নাহুমস
বর্তমানে এই কোম্পানির চেয়ারম্যান হলেন নুসলি ওয়াদিয়া এবং এমডি বরুণ বেরি। এছাড়াও প্রাক্তন RBI গভর্নর উর্জিত প্যাটেলও যুক্ত রয়েছেন ব্রিটানিয়ার সঙ্গে। উত্তর আমেরিকা , ইউরোপ , আফ্রিকা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ৬০টিরও বেশি দেশে এখন জাঁকিয়ে ব্যবসা করছে এককালে কলকাতায় শুরু হওয়া ব্রিটানিয়া। এই মুহূর্তে ভারতে ১৩ টি কারখানা রয়েছে ব্রিটানিয়ার রয়েছে পঞ্চাশ লাখেরও বেশি খুচরো আউটলেট।
এত বড় একটি সংস্থা যখন তখন তা নিয়ে বিতর্ক যে কিছু থাকবে এ তো স্বাভাবিক। ব্রিটানিয়াও ব্যতিক্রম নয়। ১৯৯০ নাগাদ ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত বিতর্কের যেতে খবরের শিরোনামে উঠে আসে ব্রিটানিয়া। এই বিতর্ক গড়ায় আদালত পর্যন্ত। ২০০৯ সালে নুসলি ওয়াদিয়া এবং আরেকটি বিদেশি কোম্পানির মধ্যে অংশীদারিত্ব নিয়ে বোর্ডরুম সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে অবশ্য ওয়াদিয়া পরিবারই অধিগ্রহণ করে ব্রিটানিয়া কোম্পানি।
যুগ বদলেছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলেছে মানুষের চাহিদাও। সবই রীতিমত ঘাড়ে নিয়েই এগিয়েছে ব্রিটানিয়া। একশ বছরের পথচলায় নানা কিছু দেখেছে সে। এমনকী বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটেও জানান দিয়েছে সক্রিয় অস্তিত্ব। এতগুলো বছর, এতগুলো মালিকানা বদল কোনও কিছুই আঁচ লাগতে দেয়নি সার্বিক ব্যবসায়। তাই এতো বদলের মধ্যেও বদলায়নি কেবল চিরন্তন ব্র্যান্ড নামটি। ‘ব্রিটানিয়া’ নামেই যে ব্যবসার আসল ইউ.এস.পি, তা হয়তো সকলেই বুঝতে পেরেছিলেন।