মাথায় যন্ত্রণা! মলমের এক মালিশেই চাঙ্গা ব্যথা, ১০০ বছরেও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে অম্রুতাঞ্জনের

Amrutanjan Balm : মাথা ব্যথার ওষুধ - অম্রুতাঞ্জন

অম্রুতাঞ্জন – এ এক জাদুকরী মলম। একডাকে সকলেই চেনে তাকে। একসময় মাথা ব্যথা থেকে শুরু করে শরীরের যে কোনও ব্যথা-বেদনা উপশমের একমাত্র উপায় ছিল অম্রুতাঞ্জন। বর্তমানেও এর সমান কদর। ১৯৮০-৯০ এর দশকে বেড়ে ওঠা ভারতীয়দের কাছে অম্রুতাঞ্জন ছিল এক অপরিহার্য অংশ। সেই সময়ে প্রায় প্রতিটি বারীতেই মিলত এই মলম। ছোট্ট হলুদ কাঁচের বয়ামে রাখা এক জাদুকরী বাম, বয়ামের ঢাকনা খুললেই নাকে এসে লাগবে এক ঝাঁঝালো গন্ধ, এরই নাম অম্রুতাঞ্জন। বয়ামের মধ্যে আঙুল দিয়ে একটুখানি অম্রুতাঞ্জন মলম নিয়ে ব্যাথার জায়গায় লাগালেই যেন ম্যাজিক। নিমেষে উধাও সকল ব্যথা। কিন্তু যার হাত ধরে এই জাদুকরী অম্রুতাঞ্জন আজ সারা ভারতীয়দের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে, তিনি রয়েছেন নেপথ্যেই। আমরা কজনই বা চিনি সেই স্রস্টাকে?

অম্রুতাঞ্জনের জনক হলেন কাসিনাধুনি নাগেশ্বর রাও। তাঁর জন্ম ১৮৬৭ সালের ১ মে অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষ্ণা জেলার পেসারামিল্লি গ্রামে। নিজের গ্রাম থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করলেও পরে মছলিপত্তনম থেকে তিনি তাঁর বাকি শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছিলেন। এরপর ১৮৯১ সালে তিনি মাদ্রাজের খ্রিস্টান কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন। স্নাতক পাশ করার পর চাকরির সূত্রে কলকাতায় চলে আসেন কাসিনাধুনি। এই শহরে আসার পরই তিনি শিখেছিলেন কীভাবে ওষুধ প্রস্তুত করতে হয় এবং কী করেই বা তারপর তা বিক্রি করতে হয়। এই অভিজ্ঞতার ওপর ভর করেই মুম্বাইতে এক নামী বহুজাতিক ইউরোপীয় সংস্থায় তিনি কাজ করার সুযোগ পান।

স্নাতক পড়তে পড়তেই যোগ দিয়েছিলেন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে। পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস পার্টিতেও যোগদান করেছিলেন কাসিনাধুনি। প্রথম থেকেই স্বাধীনচেতা রাও চেয়েছিলেন নিজের দেশের জন্য কিছু করতে। তাই ইউরোপীয় সংস্থার কাজ ছেড়ে দিয়ে আবার ফিরে এলেন কলকাতায়। ওষুধ তৈরির কাজ আরও ভালো করে শিখে নিজের জোরে কিছু করে দেখানোর যে দৃঢ় মানসিকতা তাঁর ছিল, তার জোরেই লেগে পড়লেন কাজে। কলকাতায় ফিরে গাছ এবং রাসায়নিকের প্রাকৃতিক নির্যাস নিয়ে শুরু করলেন পরীক্ষা। এরপর নিজের জেদ আর আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে কলকাতায় কাজ করে যা যা শিখেছেন সেইসবই সারা দেশের মানুষের কাজে লাগাতে চাইলেন।

আরও পড়ুন -আজও মেলে ৫ টাকায়, ৬৪ বছর পেরিয়ে এসে নস্টালজিয়ার অন্য নাম অপ্সরা পেনসিল

সময়টা ১৮৯৩। প্রথমবার মুম্বাইতে শুরু করলেন নিজস্ব কোম্পানি। সেখানেই তৈরি হল অম্রুতাঞ্জন নামক এই যুগান্তকারী বাম বা মলম। হলুদ রঙের ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত এই মলম ব্যথার জায়গায় লাগালেই মুক্তি পাবেন ব্যথা থেকে, তাও আবার কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই। মলমের ঝাঁঝই যেন কথা বলে।

কিন্তু প্রথমেই সহজ ছিল না এই মলমের পথ চলা। ব্যবসার শুরু বেগ পেতে হয়েছিল যথেষ্ট। অন্য আরও পাঁচটা দেশি ব্যবসার মতোই অম্রুতাঞ্জনের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। যেই সময়ে অম্রুতাঞ্জন বাজারে এসেছিল তখন চারিদিকে বিদেশি দ্রব্যের রমরমা। ভারতীয় অভিজাত পরিবারও তাই বিদেশি জিনিসের মোহ ছাড়তে পারেননি সহজে। দেশীয় দ্রব্য তখনও তাদের কাছে খুব একটা কদর পায়নি। কিন্তু নাগেশ্বরও নিজের জায়গা ছাড়তে নারাজ ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন দেশীয় এই ওষুধ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। তাই শুরু হল নতুন চিন্তা ভাবনা।

শোনা যায়, যখনই কোথাও কোনও বড় মিউজিক কনসার্ট হত সেখানেই তিনি তার মলম বিনামূল্যে বিতরণ করতে শুরু করেন। আজকের দিনে ঠিক যেভাবে লিফলেট বিলি করে অনেক সংস্থা অথবা কেউ কেউ যেমন জোয়ানের গুলি বিক্রি করার সময় নমুনা চেখে দেখান ঠিক সেইরকম প্রথায় তিনিও শুরু করলেন। এইভাবেই ধীরে ধীরে মানুষ অম্রুতাঞ্জনের ব্যাপারে জানতে শুরু করল। খানিক প্রচারের আলো পেতেই জন্ম নিল বিখ্যাত অম্রুতাঞ্জন লিমিটেড কোম্পানি। কলকাতার মাটিতে দাঁড়িয়ে নাগেশ্বর রাও দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে ইচ্ছে একদিন প্রকাশ করেছিলেন, সেই ইচ্ছে ক্রমে গোটা দেশের কাছে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পেয়ে গেল।

প্রথমদিকে হট সেলিং কচুরিস এর মতো করে মাত্র ১০ আনায় এই অম্রুতাঞ্জন বিক্রি শুরু হয়। এরপর ব্যবসা ধীরে ধীরে আরও ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করে। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি অম্রুতাঞ্জনকে। খুব অল্পদিনের মধ্যেই অম্রুতাঞ্জনের হাত ধরে ভারতের এই স্বাধীনতা সংগ্রামী নাগেশ্বর রাও হয়ে উঠেছিলেন কোটিপতি।

একজন ব্যবসায়ী হিসেবেই যে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা নয়। নাগেশ্বর বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণকর কাজেও নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। দেশের স্বাধীনতা তার কাছে ছিল সবার আগে। শুধু তাই নয়, তেলেগু ভাষা এবং অন্ধ্রপ্রদেশকে এক আলাদা রাজ্য ঘোষণা করার কথা সবসময় বলে এসেছেন তিনি।

আরও পড়ুন - কয়েক লক্ষ মানুষের টিফিন মানে আজও বাপুজী, ৫০ ছুঁইছুঁই বেকারির যাত্রাপথকে সেলাম

স্বাধীনতা সংগ্রামে নাগেশ্বরের যোগদানকে দেখে ভারতের জনগণ তাকে ‘দেশোদ্ধারক’ নামে আখ্যায়িত করেন। গান্ধীজীর সঙ্গে সত্যাগ্রহ আন্দোলন, খদ্দর আন্দোলনেও তার সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করা গেছে। তেলুগুর মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ‘অন্ধ্র পত্রিকা’ নামে এক সংবাদপত্র চালু করেন রাও। তাঁর এই পত্রিকা তেলুগু মানুষদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত অন্ধ্র স্টেট কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।

অবশ্য আক্ষেপ একটাই, যে অন্ধ্র আন্দোলনের একদম শুরুর দিন থেকেই তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারই শেষ তিনি দেখে যেতে পারেননি। ১৯৩৮ সালে তিনি মারা যান। অন্ধ্রকে পৃথক রাজ্য করার যে লড়াই তিনি শুরু করেছিলেন তারই ফলস্বরূপ ১৯৫২ সালে র্অথাৎ তাঁর মৃত্যুর ১৪ বছর পর অন্ধ্রপ্রদেশ নামে আলাদা রাজ্য সৃষ্টি হয়।

নাগেশ্বরের মৃত্যু হলেও তার স্বপ্ন, পাবলিশিং হাউস, এবং সর্বোপরি ভারতীয়দের প্রিয় মাথা ব্যথার মলম অম্রুতাঞ্জন আজও বহাল তবিয়তে আছে। সময়ের সঙ্গে কেবল বদল এসেছে বাইরের মোড়কে। আগেকার হলুদ কাচের বয়াম বদলে এসেছে হাল আমলের ছোট প্লাস্টিকের বয়াম। রংও বদলে হয়েছে সবুজ। যদিও তাতে  অম্রুতাঞ্জনের বিক্রিতে ঘাটতি পড়েনি একটুও। আজও বিক্রির বাজারে গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। শতাব্দী প্রাচীন এই মলম গুণে মানে এবং অবশ্যই কামে ধরে রেখেছে সমান জনপ্রিয়তা।

More Articles