সবুজ পৃথিবীর দিকে এক পা, কালি কলমে পথ দেখাচ্ছে সুলেখা-মান্দাস
Sulekha Ink: রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ রায়, অনেকেরই পয়লা নম্বর পছন্দ ছিল এই সুলেখা কালি। সেই কালির গুণগত মান এতটাই ভালো ছিল যে বহুক্ষেত্রেই বিদেশি কালিকেও ছাপিয়ে যেত সুলেখা।
অসির চেয়ে মসির জোর বেশি। কিন্তু সেই মসি থেকে ক্রমাগত দূরে সরে আসছে আজকের প্রজন্ম। কি-বোর্ডে আলতো চাপে লেখা হয়ে যাচ্ছে এক পৃথিবীর যত মহাকাব্য। কালি-কলমের থেকে দূরে তৈরি হয়ে গিয়েছে এক নতুন পৃথিবী। কিন্তু সেই দুনিয়া কেড়ে নিচ্ছে অনেক কিছুই। এককালে যা ছিল গর্বের, স্বাধীনতার, সেই কালির পেন আজ শুধুই নস্টালজিয়া। কারওর কারওর ক্ষেত্রে তা শখও বটে। খাগের কিংবা পালকের কলম থেকে ঝর্না কলম হয়ে ডট পেন এবং ইউজ অ্যান্ড থ্রো- এই লম্বা যাত্রাপথের ফাঁকে গলে গিয়েছে কত খুচরো-আনা। ডিজিটাল বিশ্বে পেনের প্রয়োজন ক্রমশ কমছে। রাস্তাঘাটে লেখার প্রয়োজনে পকেট থেকে পেনের বদলে বেরিয়ে আসে মোবাইল। গল্প-কবিতা-উপন্যাস লেখা হয়ে যায় কি-বোর্ডেই। কিন্তু তা কি আদৌ কোনওদিন পেনের বিকল্প হয়ে উঠতে পেরেছে। আজও কি রূপকথা বোনে না কলম।
প্রযুক্তি আমাদের জন্য তৈরি করে দিয়েছে আরও সহজ, আরও সুলভ সিঁড়ি। সেই রাস্তা দিয়েই একদিন জায়গা করে নিয়েছিল ডট পেন। কিন্তু সেসময় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল তলানিতে। কারণ কলম জাত চেনায়। অন্তত তখন চেনাত। গাড়ি, বাড়ি, মোবাইল যেমন অভিজাতপনার সূচক, তেমনই সেসময় ছিল পেন। ফলে বলাই বাহুল্য, একসময় ডট পেন ছিল তথাকথিক ভদ্রলোকের কাছে 'ইতর' পেন। ক্রমে ব্যবহারিক জীবনে আরও বেশি করে জায়গা করে নিতে লাগল সেই 'ইতর পেন'-ই। ঠিক যেমন করে আশির দশকে এসে সিনেমা বদলাল, বদলাল রুচি, তেমনভাবেই বদল এল পেনের জমানাতেও। বাঙালির সাধের ঝর্ণা কলম চলে গেল ব্যাকফুটে। মানুষ অভ্যস্ত হতে লাগল সস্তা, পরিশ্রমহীন ডট পেনে। আসলে যুগের হাওয়াটাই যে ছিল উল্টোমুখী।
কিন্তু এই ডট পেন শুধু যে পরিশ্রমই কমালো, তা কিন্তু নয়। এই যে ইউজ অ্যান্ড থ্রো সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল সমাজ, তার একটা ভয়ানক দাগ পড়বে পরিবেশেও। এই যে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেন আমরা ব্যবহার করছি, লিখছি, লেখা হয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি, কখনও ভেবে দেখেছেন আসলে কোথায় যাচ্ছে সেসব পেন। বৃদ্ধবয়সের জষ্টি যদি হয় লাঠি, তাহলে ছাত্রবয়সে সেই একই কাজ করে কলম। কলম ছাড়া পড়ুয়ার কোনও অস্ত্র নেই। ফলে যতই মানুষ ডিজিটাল দুনিয়ায় অভ্য়স্ত হয়ে পড়ুক না কেন, পরীক্ষার হলে কিন্তু কলমের বিকল্প নেই। প্রতিবছর দেশে যতকটি বড় পরীক্ষা অর্থাৎ বোর্ডের পরীক্ষা হয়, তাতে বসে গড়ে প্রায় সাত-আট লক্ষ করে পড়ুয়া। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, আইসিএসই, সিবিএসই থেকে মাদ্রাজা। প্রায় সব পরীক্ষার্থীরাই পরীক্ষার হলে পেনসিল বাক্স ঠেসে নিয়ে যায় নানাবিধ পেন। তার মধ্যে বেশিরভাগটাই ডট এবং ইউজ অ্যান্ড থ্রো-এ ঠাসা। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট পরীক্ষার্থীর ৯০ শতাংশই পরীক্ষা দেয় ডট পেন এবং ইউজ অ্যান্ড থ্রো-এ। আরও একটি হিসেব বলছে, গোটা পরীক্ষা দিতে প্রতি বছর একজন পরীক্ষার্থীর গড়ে ৭ থেকে ৮টি ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেন লাগতে পারে। ফলে প্রতিবছর পরীক্ষা শেষ শুধুমাত্র পেনজাত বর্জ্য পৃথিবীর বুকে কতখানি জমতে পারে আন্দাজ করতে পারেন কি! হ্যাঁ, সংখ্যাটা চমকে ওঠার মতোই। মনে রাখতে হবে, এই ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেনগুলি কিন্তু তৈরি হয় গোটাটাই প্লাস্টিক দিয়ে। রিফিল থেকে শুরু করে পেনের শরীর, সবেতেই রমরমা প্লাস্টিকের। আর এই প্লাস্টিক গিয়ে জমে নর্দমায়, সেখান থেকে নদীকে দূষিত করে সোজা গিয়ে পৌঁছয় সমুদ্রে।
বিশ্বনেতারা মানুন ছাই না মানুন, গোটা দুনিয়া জুড়ে গরম বাড়ছে। উষ্ণায়নের প্রভাবে গলে যাচ্ছে হিমবাহ, বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর। সমুদ্র দূষণের ফলে গণবিলুপ্তির দরজায় দাঁড়িয়ে আয়ু গুনছে অজস্র সামুদ্রিক প্রাণী। অথচ এসব 'ছেদো' ব্যাপারে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না তেমন। প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে বাজার করতে যাচ্ছি, প্লাস্টিকের থালায় খাচ্ছি, প্লাস্টিকের বোতল ফেলে ছড়িয়ে রাখছি যেখানে সম্ভব। ছোট ছোট ব্যক্তিস্বার্থের ভিড়ে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না সমষ্টিস্বার্থ। জন্মলগ্ন থেকেই আমরা গল্পের সেই গাছ কাটা 'কালিদাস'। তাই যে থালায় খাই, সে থালাতেই ফুটো করি। যে পৃথিবীর বুকে আমাদের শস্যশ্যামলা জীবন, তাকেই আমরা সাজিয়ে দিই প্লাস্টিক-বিষে। হাজার সচেতনতা, প্রচারেও টনক ফেরে না আমাদের। কিন্তু একটাই ভালো দিক, সকলেই মূক ও বধির নন, কেউ কেউ পৃথিবীর দিকে ফিরে তাকাতেও জানেন। যেমন তাকিয়েছে সুলেখা। ডট বা ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেন এই যে এতগুলো বছর ধরে বিরাট কার্বন ফুট প্রিন্টের জন্ম দিয়ে চলেছে, তার পাল্টা দৃষ্টান্ত খাড়া করতে, সবুজ পৃথিবীর প্রতি দায়বদ্ধতায় এগিয়ে এসেছে সুলেখা।
ঝর্না কলম একসময়ে ছিল বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ। শুধু বাংলাই বা কেন, গোটা দেশ জুড়েই তার ছিল যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা। ডট পেন এসে সেই বাজার ধ্বসিয়ে দিয়েছিল একেবারে। তবে ফ্যাশন ফেরে, ফেরে পুরনো সংস্কৃতি। কলম ফিরবে না! এক সময় ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্নকে দু-পা এগিয়ে দিয়েছিল স্বদেশি কালি। বিদেশি কালি বর্জন করে স্বদেশি জিনিসকেই আপন করে নিয়েছিল সেদিনের ভারত। ঠিক সেই উদ্দেশ্য নিয়েই পথচলা শুরু করেছিল সুলেখা কালি। যাদবপুরের সুলেখার মোড়ের সঙ্গে কমবেশি সকলেই আমরা পরিচিত। তবে সেই সুলেখার মোড়ের নাম যে আমাদের নিজস্ব সুলেখা কালির সঙ্গে ওতোপ্রত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে, তা অনেকেই জানি না। বিদেশি জিনিস বর্জন, আর স্বদেশিকে আরও বেশি করে কাছে টেনে নেওয়ার এক মুখ হিসেবে ১৯৩৪ সালে পথচলা শুরু করে সুলেখা কালি। স্বদেশি আন্দোলনের হাওয়া এসে ছুঁয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী ননীগোপাল মৈত্রকে। জেলে বসেই পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাশ করেন ননীগোপাল। বিদেশি কালি ব্যবহার করবেন না বলে পেনসিলেই দিয়েছিলেন গোটা পরীক্ষাটা। পরীক্ষানিয়ামক তার জন্য় কেটে নেন কিছুটা নম্বর, যার জেরে দ্বিতীয় হন ননীগোপাল। সেই ননীগোপাল কীভাবে এসে গেলেন কালি-কলমের দুনিয়ায়, সে-ও এক গল্প।
দেশ জুড়ে স্বদেশি আন্দোলন ততদিনে জোরদার। এদিকে দেশীয় ভালো কালির তখন বড়ই অভাব ভারতে। ব্যাপারটা বড়ই কাঁটার মতো বিঁধছিল গান্ধিজিকে। বিদেশি বর্জনের পক্ষে আন্দোলন করবেন, আওয়াজ তুলবেন, এদিকে কাগজ কলমের কাজে ব্যবহার করবেন বিদেশি কালি। এ বিষয়টি গান্ধিজি জানান খাদির প্রতিষ্ঠাতা সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তকে। সে সময় অবশ্য খাদির তৈরি নিজস্ব একটি কালি পাওয়া যেত, যার নাম ছিল কৃষ্ণধারা। তবে সতীশচন্দ্রকে গান্ধিজি স্বদেশি কালি তৈরির নির্দেশ দিলেন। তদ্দিনে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ননীগোপাল। হঠাৎই একদিন ননীগোপালকে ডেকে পাঠালেন সতীশচন্দ্র। তিনি শুধু খাদির প্রতিষ্ঠাতাই নয়, বেঙ্গল কেমিক্যালসের নামকরা এক কেমিস্টও বটে। ততদিনে কালি-কলমের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিলেন ননীগোপাল ও তাঁর ভাই শঙ্করাচার্য মৈত্র। কিন্তু ননীগোপালের ইচ্ছা, নিজেকে পুরোপুরি স্বাধীনতা আন্দোলনে সঁপে দেওয়ার। সেসময় সতীশচন্দ্র তাঁকে বোঝান, সকলেই যদি সক্রিয় সংগ্রামে নামেন, তাহলে স্বদেশি জিনিসপত্র তৈরি করবেন কে! নিজস্ব কালির ফর্মুলাও ননীগোপালদের দেন সতীশচন্দ্র। সেই কালির উপর পরীক্ষানিরিক্ষা করেই তৈরি হল ভারতের নিজস্ব দেশি কালি। সেই কালি নিয়ে ব্যারাকপুরে গিয়ে গান্ধিজির সঙ্গে দেখা করলেন ননীগোপালেরা। স্বদেশি এই কালি পছন্দ হল গান্ধিজির। সতীশচন্দ্র সংস্থার নাম রাখলেন সুলেখা। সু-লেখা অর্থাৎ ভালো লেখা। সেখানে থেকেই নতুন কালি-কলমের কারখানার নাম হল সুলেখা। বাঙালি এবং আপামর ভারত পেল এক্কেবারে নিজস্ব কলম-দোয়াত। আর তার জন্য ব্রিটিশ শক্তির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হল না দেশবাসীকে। দেশজুড়ে একচেটিয়া কালির ব্যবসা শুরু করল সুলেখা। বাংলা, বাংলার বাইরে এমনকী দেশের বাইরেও সাম্রাজ্য বিস্তার করতে লাগল সম্পূর্ণ দেশি এই সংস্থাটি। রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ রায়, অনেকেরই পয়লা নম্বর পছন্দ ছিল এই সুলেখা কালি। সেই কালির গুণগত মান এতটাই ভালো ছিল যে বহুক্ষেত্রেই বিদেশি কালিকেও ছাপিয়ে যেত সুলেখা। স্বাভাবিক ভাবেই ধীরে ধীরে সুলেখার কালির প্রতি ঝুঁকছিল বাংলা এবং ভারত।
এরই মধ্যে লেগে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অন্য সব বাজারের মতোই টান পড়ল কালি-কলমের কাঁচামালেও। অন্য কালি বিক্রেতা সংস্থাগুলি যেখানে নিজেদের পণ্যের গুণগতমানের সঙ্গে সমঝোতা করছিল, সুলেখা হাঁটল না সেই পথে। বরং খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁরা জানাল, যুদ্ধ লাগার দরুণ কাঁচামালে ব্যাপক টান পড়েছে। কমাতে হয়েছে উৎপাদন। ফলে সুলেখা কালির ব্যবহারকারীরা যাতে বুঝে কালি খরচ করেন। কোনও মতেই স্বদেশিকতা ও গুণগতমানের সঙ্গে সমঝোতা করতে রাজি ছিলেন না ননীগোপালরা। ক্রমশ দক্ষিণ এশিয়ার বড় অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল সুলেখা কালির সুনাম। এমনকী আফ্রিকায় প্রথম কালির কারখানাও তৈরি হয়েছিল ননীগোপালদের সৌজন্যেই। কেনিয়াতে কারখানা গুছিয়ে দিয়ে এসেছিল সুলেখা। তারপর নানা উত্থান-পতন দেখেছে সংস্থাটি। মধ্যিখানে কুড়ি বছর বন্ধ পড়েছিল সাধের সুলেখা। এরই মধ্যে বাজারে স্বমহিমায় অবতীর্ণ হল ডট পেন। কালির কলম ছেড়ে ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেনেই অভ্যস্ত হয়ে উঠল নতুন প্রজন্ম। বাজারে টিকে থাকতে সেসময় ডট পেন উৎপাদনে মন দেয় সুলেখা। এরই মধ্যে চলে এল করোনা মহামারি। সেসময় পেনের পাশাপাশি মাস্ক, স্যানিটাইজার তৈরিতেও হাত পাকিয়েছিল সুলেখা। তার সঙ্গেই চলছিল অল্পবিস্তর কালির পেন তৈরির কাজ। যে অতিমারি বিশ্বের কাছে অভিশাপের, সেই অতিমারিই শেষমেশ সুদিন এনে দিয়েছিল সুলেখাকে। অসুখ, জীবাণু, লকডাউনে বিধ্বস্ত মানুষ কোনও এক অজানা কারণে ফের পছন্দ করতে শুরু করলেন ঝর্না কলমকে। চাহিদার সঙ্গে উৎপাদন বাড়াতে লাগল সুলেখা। শুধু বাংলাতেই নয়, গোটা দেশ জুড়েই ফের জনপ্রিয়তার মুখ দেখল সাধের ঝর্না পেন। তার পর ব্যবসা এবং ঝর্না কলমের বাজারকে ধরে রাখতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছে সুলেখা। ইতিমধ্যেই তাঁরা পৌঁছে গিয়েছে বাংলাদেশ এবং প্রতিবেশী দেশ নেপালেও। বের করে ফেলেছে সাতাশটি রঙের কালি। আঠাশ নম্বরটি আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়।
তবে শুধু বাজার নয়। এর পাশাপাশি পরিবেশের সুস্থতার দিকেও মন দিতে চাইছে সংস্থাটি। প্লাস্টিকের ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেন থেকে যে বিপুল পরিমাণ দূষণ হয়, তার বিকল্প বোধহয় একমাত্র কালির কলম। অবশ্য প্রশ্ন উঠতেই পারে, সব ঝর্না কলমই কি আর ধাতুর তৈরি! বহু ঝর্না কলমই তো তৈরি হয় প্লাস্টিক দিয়ে। তবে ইউজ অ্য়ান্ড থ্রো পেনের তুলনায় অনেক বেশি দিন চলে ঝর্না কলম। একবার করে কালি ভরাতে পারলেই কেল্লাফতে- কলম চলবে বছরের পর বছর। আসলে ঝর্না কলম বা কালির কলম তো একটা নস্ট্যালজিয়ারও নাম। যা ছড়িয়ে পড়ে পরম্পরা থেকে পরম্পরায়। ক্রমে ক্রমে জনপ্রিয়তা বাড়ছে ঝর্না কলমের। সুলেখা সংস্থার কর্ণধার কৌশিক মৈত্র জানালেন, ইদানীং চিকিৎসকেরাও কালির পেন ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। আসলে ডট পেনের ক্ষেত্রে অনেকটাই বেশি চাপ দিয়ে লিখতে হয়। ফলে চাপ পড়ে আঙুল থেকে কাঁধে। বাড়ে ফিঙ্গার আর্থারাইটিস। যে আশঙ্কা অনেকটাই কমানো যায় কালির পেন ব্যবহার করলে। পাশাপাশি এখন কালির পেন ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে স্কুলগুলিতেও। ছোট থেকেই আমরা শুনে এসেছি, কালির পেন ব্যবহার করলে হাতের লেখা ভালো হয়। তাছাড়া ঝর্না কলমে লিখে যে আরাম রয়েছে, তা ডট পেনে খুঁজে পাওয়া কঠিন। পাশাপাশি মনঃস্তাত্বিকেরাও মনে করেন, ঝর্না কলমে লিখলে চিন্তনের সঙ্গে লেখার সাযুজ্য থাকে। ফলে লেখার মানও বাড়ে। এমন হাজার রকমের গুণাগুণ রয়েছে কালির কলমের।
তবে সবচেয়ে বড় দিক বোধহয় পরিবেশ। ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেন তৈরিতে দু'টো জিনিস প্রয়োজন হয় প্রধানত। তার একটি অবশ্যই প্লাস্টিক। এবং দ্বিতীয়টি প্রচুর পরিমাণে ইলেকট্রিক। কারণ পেন তৈরির জন্য প্রচুর তাপমাত্রায় গলাতে হয় ওই প্লাস্টিক গ্রানুয়েলসগুলিকে। থার্মাল ইলেকট্রিসিটি মানেই প্রচুর পরিমাণে কয়লা পোড়ানো। অর্থাৎ পরিবেশে বিরাট কার্বন ফুটপ্রিন্ট ছেড়ে যাওয়া। যা আখেরে একদিন ধ্বসিয়ে দেবে আমাদের গোটা বাস্তুতন্ত্রকেই। তাছাড়া কোনও ভাবেই ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেন থেকে বেরোনো বর্জ্য প্লাস্টিককে রিসাইকেল করার কোনও ব্য়বস্থা নেই। ফলে গোটাটাই জমা হয় পরিবেশে। যা থেকে খানিকটা হলেও রেহাই দিতে পারে এই ঝর্না কলম। আর এই সচেতনতাটাই আরও বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায় কালি-কলম সংস্থা সুলেখা। আর তাদের এই উদ্যোগে তার হাত ধরেছে মান্দাস। প্রকাশনা ও পুস্তক বিপণী হিসেবে মান্দাস মাত্র দেড় বছরেই কলেজ স্ট্রিটে নজর কেড়েছে। মান্দাসের বই বিপুল ভাবে সমাদৃত হচ্ছে পাঠকমহলে। পরিবেশের কল্যাণে কালির কলমকে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়াই তাঁদের উদ্দেশ্য, জানালেন মান্দাসের কর্ণধার সুকল্প চট্টোপাধ্যায়।
কালি-কলম নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন ভাবনা বাজারে আনছে সুলেখা। যেমন দামি কালি ও কলমের সংগ্রহ রয়েছে তাঁদের কাছে, তেমনই রয়েছে পড়ুয়াদের জন্য কমদামি কালি ও ঝর্না কলমও। সাধারণ ভাবে ডট পেনের কালি হয় অয়েল বেসড অর্থাৎ তেলে গোলা, সেখানে কালির কলমে ব্যবহার করা হয় ওয়াটার বেসড অর্থাৎ জলে গোলা কালি। ভবিষ্যতে আরও বেশি রঙের কালি বাজারে আনার ইচ্ছা রয়েছে সুলেখার। রয়েছে এমন নানা কালির বিশেষ সেটও।
দীর্ঘদিন ধরে কলম সংগ্রহের নেশা শুভব্রত গাঙ্গুলির। কলমের দুনিয়ায় তিনি অবশ্য চম দা নামেই বেশি পরিচিত। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে কয়েক হাজার দেশি-বিদেশি ঝর্না কলম। তিনি জানালেন, ঝর্না পেন আসলে এক আন্দোলনের নাম। ডট পেন বা ইউজ অ্যান্ড থ্রো সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজনে যে আন্দোলন চলছে সারা বিশ্ব জুড়ে। দুনিয়া জুড়ে সার্বিক ভাবেই কমেছে কাগজ-কলমের ব্যবহার। এখন কম্পিউটারেই ভাসে আমাদের সমস্ত ভাবনার জগৎ। কম্পিউটারই বলে দেয়, আমাদের কী করতে হবে। কী লিখতে হবে। ফলে কলম সেখানে ব্রাত্য। তবু দিনের শেষে কাগজ-পেনের সঙ্গে আসলে আমাদের এক আত্মীয়তা গড়ে ওঠে, যা কম্পিউটার দিতে পারবে না কোনও ভাবেই। লেখার যে সহজাত প্রক্রিয়া, যে চিন্তন প্রণালি তাকে বের করে আনতে সাহায্য করে কলম। আর সেই দুনিয়ায় ঝর্না কলম যেন আত্মার আত্মীয়টি। শুভব্রতবাবু মনে করেন, এই যে অবিরত ছুটে চলা, যান্ত্রিক সময়, তার থেকে কোথাও গিয়ে একবার থমকে দাঁড়ানো প্রয়োজন। নিজেকে দেখা প্রয়োজন। সেই কাজটা বোধহয় করতে পারে কালি-কলম। কথায় বলে, কালি, কলম, মন, লেখে তিন জন। আমরা যা ভাবি, তা আসলে মাথা থেকে পৌঁছয় মনে, মন থেকে আঙুলে এবং আঙুল থেকে পেনের নিবে। এই গোটা প্রক্রিয়ায় মনের সঙ্গে কাগজের সংযোগ ঘটায় পেন। আর এখানেই ঝর্না কলম আলাদা। শুভব্রতবাবু মনে করেন, ডট পেনের কোনও চরিত্র নেই আসলে। লেখকের কাছে কখনই নিজের সত্তা নিয়ে হাজির হতে পারে না ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেন। সে যেন বারোয়ারি। অমল, বিমল, কমলদের ভিড়ে 'ইন্দ্রজিৎ' হয়ে ওঠার ক্ষমতা তাঁর নেই। যেটা পারে ঝর্না কলম। আসলে কাগজের উপরে কালির কলম যে ক্যাথারসিস ঘটাতে পারে, তার বিকল্প কখনওই হতে পারে না সস্তার ডট, ইউজ অ্যান্ড থ্রো-রা। ফলে শুধু পরিবেশের হয়ে নয়, কলমপ্রিয় বাঙালির কাছেও সুলেখা কালির এই উদ্যোগ কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। যাকে রূপ দেওয়ার জন্য অবিরত চেষ্টা করে চলেছে মান্দাস। ঘরে ঘরে ফিরুক কালি-কলমের নস্টালজিয়া, ঝর্না কলমের স্মৃতি, এর চেয়ে ভালো আর কী-ই হতে পারে বলুন তো!