সামান্য কাগজের মিল থেকে মোবাইলের জগতে বিপ্লব, নস্টালজিয়ার আরেক নাম নোকিয়া
Nokia Company History : তার পরের গল্পটা একটু আলাদা। কখনও উত্থান, আবার কখনও মুখ থুবড়ে পড়া, এভাবেই এগিয়েছে নোকিয়ার যাত্রা।
একটা হাতের দিকে এগিয়ে আসছে আরেকটা হাত। যেন একে অপরকে ছুঁতে চাইছে, একসঙ্গে এগিয়ে যেতে চাইছে। দূরত্বও যেন কমিয়ে দিচ্ছে সেই ‘হাত’। একটা সময় সেই ‘হাত’ই ছিল আমাদের সকলের বন্ধু। প্রথম প্রেম, প্রথম গেম খেলা, এসএমএসের মধুর চিঠি – সবকিছুর সাক্ষী ছোট্ট একটা যন্ত্র। দিনের শেষে যার একটাই বক্তব্য ছিল, ‘কানেকটিং পিপল’। বহু বছর ধরে বিশ্বের প্রতিটি কোণায় মানুষদের এভাবেই জুড়ে গিয়েছে নোকিয়া। সামান্য মুঠোফোন থেকে কখন যে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে জুড়ে গেল এই শব্দটি, টেরই পাওয়া গেল না!
আজ গোটা বিশ্বে নোকিয়ার পরিচিতি টেলিকম কোম্পানি হিসেবে। গোটা বিশ্বে অজস্র মানুষের সঙ্গী হয়ে উঠেছে এই ব্র্যান্ড। কেবল মোবাইলই নয়, টেলি কমিউনিকেশনের জগতে একপ্রকার বিপ্লবই তৈরি করেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১১ সাল পর্যন্ত নোকিয়াই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মোবাইল উৎপাদন করত এই নোকিয়াই। তার পরের গল্পটা একটু আলাদা। কখনও উত্থান, আবার কখনও মুখ থুবড়ে পড়া, এভাবেই এগিয়েছে নোকিয়ার যাত্রা।
তবে শুরুটা হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। আজ ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া নোকিয়ার শুরুর দিনগুলোর সঙ্গে মোবাইলের দূরদূরান্ত অবধি কোনও যোগাযোগ ছিল না। সালটা ছিল ১৮৬৫, অর্থাৎ ১৫৭ বছর আগের কথা। ফিনল্যান্ডের এক মাইন ইঞ্জিনিয়ার ফ্রেডেরিক ইডেস্ট্যাম ঠিক করলেন, একটা কাগজের মিল তৈরি করবেন। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। ওই বছরই ফিনল্যান্ডের ট্যাম্পায়ার শহরে তৈরি করলেন নিজের কারখানা। মণ্ড থেকে বিভিন্ন রকমের কাগজ তৈরি করে সাপ্লাই করতেন ফ্রেডেরিক।
আরও পড়ুন : প্রথম মোবাইলে কথা বলেন জ্যোতি বসু! স্বপ্ন ছিল, কলকাতা হবে ‘নেটওয়ার্ক সিটি’
একটু একটু করে ব্যবসাও বাড়তে শুরু করল। কয়েক বছরের মধ্যেই আরও একটি কাগজের কল তৈরি করার প্রয়োজন এসে পড়ল। কিন্তু কোথায় করা যায়? শেষমেশ ঠিক হল, ফিনল্যান্ডের নকিয়াভির্তা নদীর ধারে একটি ফাঁকা জায়গায় এই মিলটি তৈরি হবে। ইতিমধ্যেই ফ্রেডেরিকের সঙ্গে আরও একজন এই ব্যবসায় ঢুকে পড়েছেন, লিও মিশেলিন। এতদিন এই কোম্পানিটির কোনও নাম ছিল না। ১৮৭১ সালে দু’জনে মিলে ঠিক করলেন, এবার অন্তত একটা নাম দেওয়া হোক সংস্থার। কী নাম? নকিয়াভির্তা নদীর পাশে দ্বিতীয় মিলটি তৈরি হয়েছিল। সেজন্য ঠিক হল, কোম্পানিটির নাম দেওয়া হোক ‘নোকিয়া এবি’।
আক্ষরিক অর্থে, এভাবেই শুরু হয়েছিল নোকিয়ার যাত্রা। কিন্তু তখনও ছিল কেবল কাগজের মিল হিসেবেই। পরের দিকে সামান্য কিছু সময়ের জন্য জুতোর ব্যবসাও শুরু করেন ফ্রেডেরিক ও লিও। নোকিয়ার জুতো সেই সময় খানিক নামও করেছিল। কিন্তু মিশেলিনের প্রথম থেকেই ইচ্ছে ছিল, একটু একটু করে বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র তৈরির দিকে নোকিয়াকে নিয়ে যাবেন। এদিকে তাঁর এই পরিকল্পনা ফ্রেডেরিকের পছন্দ ছিল না একেবারেই। শেষমেশ ১৮৯৬ সালে ফ্রেডেরিক সরে যান কোম্পানি থেকে, লিও মিশেলিন হয়ে যান চেয়ারম্যান।
১৯০২ সাল থেকে একটু একটু করে ভোলবদল শুরু হয় নোকিয়ার। মিশেলিন ঠিক করেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহনের দিকীবার নজর দেওয়া হোক। ধীরে ধীরে সেই কাজটিও শুরু হল। কিন্তু তারই মধ্যে এসে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথমবার মুখ থুবড়ে পড়ল নোকিয়া। লোকসানের পর লোকসান… এবার কী হবে? এত সাধের কোম্পানিটি একেবারেই উঠে যাবে? সম্ভাবনা তেমনটা থাকলেও, সেটা হল না। ১৯২২ সালে নোকিয়ার সঙ্গে জুড়ে গেল ফিনল্যান্ডের আরও দুটি কোম্পানি – ‘ফিনিশ রাবার ওয়ার্কস’ এবং কেবল ওয়ার্কস কোম্পানি (কাপেলিতেহদাস)। নোকিয়াকে অধিগ্রহণ করার পর কাগজের ব্যবসার সঙ্গে শুরু হল রাবার তৈরি ও ইলেকট্রিক সামগ্রী বিক্রির ব্যবসা। সেইসঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবসা তো ছিলই।
আরও পড়ুন : ‘হাতের ওপর হাত’ এখন অতীত! ৬০ বছর পর পরিবর্তনের ঝড়, হঠাৎ কেন লোগো বদল নোকিয়ার?
এভাবেই বেশ অনেকগুলি বছর এগোচ্ছিল নোকিয়া। মূল বদল শুরু হল ১৯৬০-র দশকের পর থেকে। ১৯৬৭ সালে নোকিয়া, ফিনিশ রাবার আর কেবলের কোম্পানি তিনটি একসঙ্গে জুড়ে গেল। তৈরি হল ‘নোকিয়া কর্পোরেশন’। আরও বড় আকারে নোকিয়ার কাজ শুরু হল এই সময় থেকে। রাবার, ইলেকট্রিক আর কেবলের সঙ্গে জুড়ে গেল আরও একটা জিনিস – ইলেকট্রনিকস। ইতিমধ্যেই প্রযুক্তির জগতে একটু একটু করে বদল আসছিল। বিভিন্ন গবেষণাও চলছিল বিশ্বজুড়ে। সেই ঢেউয়ে নেমে পড়ল নোকিয়াও।
১৯৭০-র দশক। এই সময়ই নোকিয়া ঢুকে গেল রেডিও আর নেটওয়ার্কিংয়ের ব্যবসায়। একটু একটু করে টেলিকমিউনিকেশনের জগতে নিজেকে তৈরি করা শুরু করল এই প্রতিষ্ঠানটি। গ্যাস মাস্ক, মোবাইল রেডিও, টেলিফোন সুইচ ইত্যাদি বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি করে ফিনল্যান্ডের সেনাবাহিনীকে দিতে শুরু করল নোকিয়া। একটু একটু করে এই জিনিসগুলি বাজারেও চলে এল। আর ১৯৮০-র দশকে নোকিয়া তাদের প্রথম ফোন তৈরি করল। যার নাম ‘মোবিরা সেনেটর’। সেইসঙ্গে নিজেদের ‘মিকো ৩’ কম্পিউটারও নিয়ে এল নোকিয়া। এর সঙ্গেই এল ‘নরডিক মোবাইল টেলিফোন’। টেলিকমিউনিকেশনের জগতে বিপ্লব তৈরি করল নোকিয়া। ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই পথচলা শুরু ‘ব্র্যান্ড’ নোকিয়ার।
এরপর একের পর এক ঝড় তুলেছে এই সংস্থা। ৮০-র দশকে আরেক টেলিকম জায়ান্ট সিমেনসের সঙ্গে মিলে নোকিয়া প্রথমবার তৈরি করল জিএসএম নেটওয়ার্ক (GSM Network)। ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে প্রথমবার এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ফোনে কথাবার্তা চালু করে নোকিয়া। এই মুহূর্তে সিমকার্ডের মাধ্যমে কথাবার্তার নেটওয়ার্কটিকেই বলা হয় জিএসএম। নোকিয়া সেই কাজটাই প্রথম শুরু করে। তারপর একের পর এক মোবাইলের মডেল নিয়ে আসে তারা। ভারতেও প্রথম মোবাইল আনে নোকিয়া। গোটা পৃথিবীতে তখন নোকিয়া এক দৈত্যের নাম। যা-ই হাত দিচ্ছে, তা-ই সোনা! মানুষের জীবনের সঙ্গে জুড়ে গেল এই সংস্থা।
আরও পড়ুন : পেট্রল পাম্পে কেন মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ? যে কারণ জানেন তা আদৌ সঠিক তো?
এর মধ্যেই চলে এল নোকিয়ার সেই বিখ্যাত রিংটোন। মোবাইলে গেম খেলার ‘বদভ্যাস’ও তৈরি করে দিল এই কোম্পানিটি। তবে এই সবকিছুর ওপরে ছিল এক অদ্ভুত নির্ভরতা। যার পিছনে ছিল পরিশ্রম, মেধা আর কর্মীদের দক্ষতা। একেবারে প্রথম দিন থেকেই নোকিয়ার যন্ত্রগুলির মূল চালিকাশক্তি ছিল তার হার্ডওয়্যার। সহজে নষ্ট হবে না, বছরের পর বছর একই ফোন দিয়ে চলবে সবটা – নোকিয়া বলতে প্রথমে এই ছবিটাই মাথায় আসে। আজও অনেকের বাড়িতে নোকিয়ার পুরনো ফোনগুলি বহাল তবিয়তে চলছে। এটাই ছিল ইউএসপি।
কিন্তু অ্যানড্রয়েড প্রযুক্তি চলে আসার পর একটু একটু করে পিছিয়ে পড়ে নোকিয়া। অ্যাপেলের আইফোনের পাশাপাশি উঠে আসে স্যামসাং। বেশিরভাগ মানুষ নতুন এই প্রযুক্তির দিকেই চলে যায়। আর এই জায়গাতেই মার খায় নোকিয়া। সঠিক সময় অ্যানড্রয়েডকে ধরতে না পাড়ার মাশুল দিতে হয় তাকে। একসময় বন্ধই হয়ে যায় নোকিয়া। পরে বিল গেটস কিনে নিলে একটু হাল ফেরে। এখন অবশ্য নতুন প্রযুক্তির দিকে আরও বেশি করে ঝুঁকতে চাইছে নোকিয়া। বহু পুরনো লোগোও বদল করা হয়েছে। ফের একবার টেলিকম জগতে বিপ্লব ঘটাতে পারবে আমাদের ছেলেবেলার নস্টালজিয়া নোকিয়া? সেদিকেই তাকিয়ে সবাই।