পৃথিবী জুড়ে যা ক্যান্ডি ফ্লস, বাঙালির তাই 'বুড়ির চুল'! যে তথ্য অজানা অনেকেরই
Coton Candy : এ এক কটন বলের মতো মজার মিষ্টি, যা মুখে দিতে না দিতেই মিলিয়ে যেত
‘হাওয়াই মিঠাই নেবে গো ...হাওয়াই মিঠাই ...নরম গরম হাওয়াই মিঠাই...’ – কী কিছু মনে পড়ছে এই ডাকটা শুনে? সেই ছোটবেলার দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছেন তাই তো। যখন অলস দুপুরে এইভাবেই ঘণ্টি বাজিয়ে হাওয়াই মিঠাইওয়ালা হাঁক পাড়তে পাড়তে যেত। আর এই হাঁক শোনামাত্র ছুট্টে বেরিয়ে যেতেন বাড়ির বাইরে। আর দেখা পেতেন এক রাশ পেঁজা তুলোর মতো কটন বলের। যার মধ্যে রামধনুর সাত রঙের মিশেল ছিল। হকারের হাতে একটা বড় লাঠি আর তার মাথায় গোঁজা থাকত প্যাকেট প্যাকেট সব নানা রঙের মেঘ। একেই আমরা হাওয়াই মিঠাই বা বুড়ির চুল বলে জানি।
এ এক কটন বলের মতো মজার মিষ্টি, যা মুখে দিতে না দিতেই মিলিয়ে যেত। আট থেকে আশি যেকোনো বয়সের মানুষের পছন্দের জিনিস এই বুড়ির চুল। ছোটবেলায় সেইসব দেখে বায়না করেনি এমন বাচ্চা বোধহয় একটাও ছিল না। মেলায় ভিড় জমে যেত স্টলের সামনে। ঢাউস একটা যন্ত্রের গায়ে কাঠি ছোঁয়াতেই বেরিয়ে আসছে নানা রঙের সব মেঘ। যেন ম্যাজিক। ‘ক্যান্ডি ফ্লস’ বা ‘কটন ক্যান্ডি’ কিংবা ‘স্পুন সুগার’- এসব নাম তো এসেছে আরও পরে। তবে মফস্বলে এর নাম ‘বুড়ির চুল’।
শৈশব মানেই হাজার রকমের বাধা। 'এটা খাবে না ওটা ছোঁবে না', হাজার বারণের ফিরিস্তি। হাওয়াই মিঠাইয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। কিন্তু ওইসব লোভনীয় জিনিস সামনে দেখার পর এই সতর্কবাণী শুনতে কারই বা ভালো লাগত বলুন ! আবার না শুনলেও যে বিপত্তি। মিষ্টি খেয়ে দাঁত ব্যথা হলে তো যেতে হবে সেই ডাক্তারের কাছে। আর এদিকে দাঁতের ডাক্তার মানেই তো ভয়। কিন্তু শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি, যে বুড়ির চুল নিয়ে এত বারণ ছিল ছোটবেলায়; সেই বুড়ির চুলের স্রষ্টা কিন্তু আদতে একজন ডেন্টিস্ট, গোদা বাংলায় বলতে গেলে দন্ত চিকিৎসক। দাঁতের ডাক্তার নিজের হাতে ছোট বাচ্চাদের হাতে ক্যান্ডি তুলে দিচ্ছেন। আগে শোনেন নি তো? আজ শুনবেন। উনিশ শতকে এমনই একজন ডাক্তার থাকতেন আমেরিকার টেনিসিতে। হাওয়াই মিঠাইকে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে রয়েছে তাঁরই অবদান।
কটন ক্যান্ডির বিবর্তনের ইতিহাস
হাওয়াই মিঠাই আধুনিক যুগের খাবার নয়। এর ইতিহাস আরও পুরোনো। ১৫০০ শতকেও হাওয়াই মিঠাইয়ের চল ছিল। সেসময় একজন ইতালীয় রাঁধুনি চিনির সিরাকে কাঁটা চামচ দিয়ে টেনে সুতোর মতো তৈরি করে হাওয়াই মিঠাই তৈরি করত। তবে তা ছিল একেবারে প্রথম ধাপ। আর পদ্ধতিও ছিল বেশ পরিশ্রমের। অন্যদিকে এর প্রায় ১০০ বছর পর, ১৬০০ শতকে ফ্রান্সের সম্রাট ৩য় হ্যানরিকে ভেনিস ভ্রমণের সময় বিভিন্ন রকম মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। তাঁর জন্য নাকি সেসময় বিশেষ স্পুন-সুগার ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। স্পুন সুগার দিয়ে তৈরি মোট ১,২৮৬ টি খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল তাঁর সামনে। যার মধ্যে ছিল একটি টেবিলক্লথও, যা তৈরি হয়েছিল ওই চিনি জ্বাল দিয়ে দিয়েই।
ক্যান্ডি ফ্লস ও কটন ক্যান্ডি
বাঙালি নাহয় পছন্দের জিনিসপত্র নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি রকমের আবেগপ্রবণ। তবে ইউরোপ-আমেরিকাও কিন্তু একটা সময় মজেছিল মজার এই মিষ্টি খাবারে। শুধু শিশুরা নয়, বড়দেরও তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ‘ক্যান্ডি ফ্লস’। অথচ উপকরণ বলতে চিনির শিরা, ফুড কালার আর ছাড়া কিছুই না। তবে বিশেষ উপকরণটি হল হাওয়া। তাতেই বাজিমাত।
হ্যাঁ, আমেরিকাতেই জন্ম এই আধুনিক ক্যান্ডি ফ্লসের। সে অনেক কাল আগের কথা। প্রাথমিক পরিকল্পনাটি উইলিয়াম মরিসন নামে এক দন্ত চিকিৎসকের। ভাবুন একবার ! চিনি আর ডেন্টিস্ট, যাকে বলে পরস্পরের একেবারে জাতশত্রু। অথচ এক দন্ত-চিকিৎসকের হাত ধরেই কিনা দুনিয়া কাঁপিয়ে দিল তুচ্ছ নিরীহ চিনির শিরা। মরিসন ছিলেন উদ্যোগী মানুষ। এর আগে তুলো-বীজ থেকে তেল নিষ্কাশনের এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, নিজের নামে সেটার পেটেন্টও নিয়েছিলেন। মরিসনের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে নতুন এক ধরনের মিষ্টি তৈরির মেশিনের ভাবনা আসে। তার পরিচিত ময়রা জন ওয়ারটনকে তিনি এই পরিকল্পনার কথা জানান। ১৮৯৭ সালে মরিসন ও ওয়ারটন পরীক্ষামূলকভাবে এই মিষ্টি তৈরির মেশিন বানান। এই মেশিনের সাহায্যে তৈরি চিনির সুতোগুলো খুব সূক্ষ্ম হচ্ছিল, ফলে হাওয়ার সংস্পর্শে এসে তাড়াতাড়ি শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। তাই এই নতুন মিষ্টি শুরুতেই সাফল্য পায়নি। সাফল্য এসেছিল সাত বছর পর, ১৯০৪ সালে, সেন্ট লুইস বিশ্বমেলায়। ‘ফেয়ারি ফ্লস’, যেহেতু সাদা সাদা ফোলা ফোলা জিনিসটাকে দেখে পরীদের দেশের মেঘ বলেই মনে হত, তাই এমন নাম। বাক্স প্রতি দাম রাখা হয়েছিল ২৫ সেন্ট। মেলার কয়েকদিনে ৬৮ হাজার বাক্সেরও বেশি বিক্রি হয় ক্যান্ডি ফ্লস। ১৮ হাজার ডলারের কাছাকাছি আয় করেন মরিসন ও ওয়ারটন। সেখান থেকে ক্রমেই গোটা বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয়তা পায় এই হাওয়াই মিঠাই।
ক্যান্ডি ফ্লসের সঙ্গে ডেন্টিস্টদের বোধহয় কিছু একটা নাড়ির যোগ ছিল। ১৯২০ সাল নাগাদ আরেক দন্ত চিকিৎসক জোসেফ লাসকক্স চেষ্টা করলেন মরিসন আর ওয়ারটনের তৈরি খাবারটিকে একটু অন্যরকম চেহারা দিতে। নাম দিলেন ‘কটন ক্যান্ডি’। লাসকক্সের মেশিন বা প্রোডাক্ট কোনোটাই মরিসন বা ওয়ারটনের থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না। তবে ‘কটন ক্যান্ডি’ নামটা দারুণ হিট করে গেল। এই নামেই বছরের পর বছর বাজার মাত করলো এই মিষ্টি। ছড়িয়ে পড়ল অন্যান্য দেশেও।
কিন্তু এই মিষ্টি তৈরির মেশিনগুলো তেমন টেকসই ছিল না। শেষে ১৯৪৯ সালে ওহিও শহরের ‘গোল্ড মেডাল প্রোডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারারস’ নামে এক কোম্পানি স্প্রিং-বসানো মেশিন বের করে সমস্যার সমাধান করে ফেলে। গোল্ড মেডাল কোম্পানিকে লাখ লাখ ডলারের ব্যবসা দিতে শুরু করল মেশিনটি। আরও কয়েক দশক পর ১৯৭০ সাল নাগাদ তারা কটন ক্যান্ডির জন্য তৈরি করে ফেলল স্বয়ংক্রিয় মেশিন। পরবর্তীকালে বিশ্বের সর্বত্র কটন ক্যান্ডি তৈরির জন্য এই মডেলের মেশিনই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
কটন ক্যান্ডি তৈরির প্রক্রিয়া
সাধারণত হাওয়াই মিঠাই তৈরির যন্ত্রের নিচের অংশে একটি মোটরচালিত চুলার মতো থাকে। এখানেই চিনিকে তাপ দিয়ে গলিয়ে ঘন ক্যারামেলে পরিণত করা হয়। এরপর তার সঙ্গে মেশানো হয় ফুড কালার। ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষ গন্ধ ও স্বাদের জন্য নানা সুগন্ধিও ব্যবহার করা হয়। যন্ত্রের ওপরের অংশে মোটরের সাহায্যে একটি চাকা তীব্র বেগে ঘুরতে থাকে। চাকাটিকে আবৃত করে থাকে একটি অতি সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত পাতলা স্টিলের পাত। গরম ঘন ক্যারামেল ছিদ্রযুক্ত সেই লোহার পাত দিয়ে বের হওয়ার সময় সেগুলো তীব্র গতিতে অনেক সূক্ষ্ম সুতার মতো বের হয়। আর বাইরের বাতাসের স্পর্শে এসেই ঠান্ডা হয়ে যায়। এরপর একটা সরু কাঠি দিয়ে সুন্দর করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সংগ্রহ করা হয় হাওয়াই মিঠাই। কিন্তু একটি কাঠিতে হাওয়াই মিঠাই পরিমাণে দেখতে অনেক মনে হলেও সাধারণত এক কাঠিতে মাত্র ৩০ গ্রামের মতো চিনি থাকে। আর বাদবাকি মানে ৭০ ভাগই থাকে হাওয়া কিংবা বাতাস। সে জন্যই তো নাম হাওয়াই মিঠাই।
তবে বর্তমান বাজারে এই মজার মিষ্টির হাল-হকিকত জানতে গেলে ভরসা একমাত্র কোনও মেলা। সেখানেই দেখা যায় সুসজ্জিত রঙিন গাড়ি। আর তাঁকে ঘিরে উপচে পড়া ভিড়। শুধু শিশুরা নয়, এ দলে থাকেন বড়রাও। ব্যাবসা একটু কোণঠাসা হয়েছে ঠিকই, তবে হারায়নি। কিন্তু প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে দাম বেড়েছে বেশ খানিকটা। নানা দেশে নানা নাম এই মজার খাবারটির। আর সেটাই বোধহয় ইউএসপি এর। তবে নাম যাই হোক, যুগ বদলালেও আজও ছোটদের কাছে এই ম্যাজিক-মিষ্টির আবেদন কিন্তু কমেনি একচুলও। আমেরিকায় ৭ ডিসেম্বর পালন করা হয় ‘ন্যাশনাল কটন ক্যান্ডি ডে’৷
খুদেদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য - যদি কখনও মা-বাবা হাওয়াই মিঠাই খেতে মানা করে, বলে যে ওতে খুব মিষ্টি থাকে, দাঁতে পোকা ধরবে, একদম চটপট জানিয়ে দেবে যে ব্যাপারটা মোটেও অতটা গুরুতর নয়। হাওয়াই মিঠাইয়ের মধ্যে সবথেকে বেশি থাকে হাওয়া ! আর তার থেকে অনেকটাই কম পরিমাণে থাকে চিনি। মেশিনে চিনির দানা গলিয়ে, তারপর খুব জোরে সেটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তৈরি হয় তুলোর মত ক্যান্ডি ফ্লস। তাই মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। আর ঠিক সেইজন্যেই এক বোতল সোডার থেকে কটন ক্যান্ডিতে অনেক কম পরিমাণে মিষ্টি থাকে। ফলে ক্যালোরির মাত্রাও কম। তাই ফিটনেসের যুগে এটি খাওয়া নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে।