সোনার দোকান ছেড়ে চানাচুরের ব্যবসা! যেভাবে বাঙালির ব্র্যান্ড হয়ে উঠল 'মুখরোচক'
Mukhorochak: গুণমানই যে একমাত্র মানদণ্ড, সেকথাই যেন বারবার প্রমাণ করে দিচ্ছে ‘মুখরোচক’।
চানাচুর বলতেই মনে হয় ঝাল ঝাল, মিষ্টি মিষ্টি এক বিশেষ খাবার, যা আপনার জিভে জল আনতে বাধ্য। কিন্তু চানাচুর এই কথাটা এল কোথা থেকে? ভেবে দেখেছেন কখনও। শোনা যায়, মুম্বইয়ের বন্দর এলাকায় মোগল যুগের মাঝামাঝি কিছু মানুষকে বিশেষ ধরণের মুচমুচে ডালভাজা বিক্রি করতে দেখা যেত৷ গুঁড়ো ডালকে বিশেষভাবে ঝালমশলা সহকারে ভেজে বিক্রি করা হতো ‘চুড়া’ নামে৷ সময়ের আবর্তে এই ‘চুড়া’ মুম্বইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে প্রায় ভারতজুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে ভারতের নানা স্থানে নতুন পদের এই খাবারটি পরিচিতি পায় ভিন্ন ভিন্ন নামে৷ কোথাও একে ডাকা হত ‘চিবাড়া’ নামে, কোথাও বা একে ‘চিব্দু’ কিংবা ‘ভুষো’ নামেও পরিচিতি পেতে দেখা গেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ইংরেজদের পাশাপাশি আরও অনেক ইউরোপীয় নাগরিকের আগমণ ঘটেছিল ভারতে। তাদের মধ্যেও বেশ মুখরোচক খাদ্য হিসেবে স্থান করে নেয় এই ‘চুড়া’। তাদের হাত ধরে এর বিস্তার ঘটে ইউরোপের নানা দেশে৷ অনেক ইউরোপীয় এলাকায় বেশ জনপ্রিয় এই খাবারকে ডাকা হয় ভিন্ন ভিন্ন নামে। যেমন, আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের অধিবাসীরা প্রথমে মুম্বই থেকে উৎপত্তি লাভ করা এই খাবারকে ডাকে ‘বম্বে মিক্স’ হিসেবে। আর এটাই বাংলার বুকে এসেছে চানাচুর হিসেবে।
বিকেলবেলা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হোক কি হালকা কিছু খাবার খাওয়া– চা বা কফির সঙ্গে ‘টা’ যেন থাকে। আর এই ‘টা’ বেশিরভাগ সময় হয় চানাচুর। কখনও ঝাল, কখনও মিষ্টি কখনও বা মিক্স ফ্লেভার। চানাচুরের সঙ্গে বাঙালির এক আলাদা সম্পর্ক।
আজকের দিনে যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন যে, চানাচুর বা বিকেলের স্নাক্স হিসেবে কী পছন্দ করবেন, তাহলে বেশিরভাগ লোকের জবাব হবে– হলদিরামস বা বিকানেরের চানাচুর বা ভুজিয়া। কিন্তু অনেক বাঙালিই অবগত নন যে, ৭২ বছর ধরে বাংলার ঘরে ঘরে যে চানাচুর স্বাদে সব্বাইকে পেছনে ফেলে দেয় তা হলো, এক বাঙালি ব্যবসায়ীর তৈরি নিজস্ব ব্র্যান্ড ‘মুখরোচক’ চানাচুর। আজ সেই গল্পই শোনাব। কী করে একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী তৈরি করলেন এক জনপ্রিয় খাবারের ব্র্যান্ড।
আরও পড়ুন: একা ‘দাদা-বৌদি’-ই বদলে দিয়েছে সোদপুরের ছবি! নামজাদা রেস্তোরাঁর ঠিকানা এখন মফসসল
শুরুর ইতিহাস
সুদূর অতীত থেকে আমাদের বাঙালিদের একটা ট্যাগলাইন আছে– বাঙালিদের দ্বারা আর যাই হোক, ব্যবসা ঠিক হবে না। তারা পরের চাকরি করবে কিন্তু রিস্ক নিয়ে ব্যবসা করবে না। এইরকম ট্যাবু যখন আমাদের ওপর দেগে দেওয়া হয়, ঠিক সেই সময় পঞ্চানন চন্দ্র নামে বাঙালি বাবু ঠিক করলেন, ব্যবসা করবেন। তাই তিনি সোনার দোকানের স্যাকরার কাজ ছেড়ে দিয়ে ঠিক করলেন নিজেই সোনার দোকান দেবেন, কিন্তু ওই কথায় আছে না– ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’। তাই সোনার দোকানের ব্যবসা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চানন চন্দ্রর ওপর থেকে ভাগ্যলক্ষ্মীর হাত সরে গেল। তার ব্যবসা লাটে উঠল গ্রাহকদের প্রতারণার জন্য।
কিন্তু তিনি দমে যাননি। নিজের এই বিপদ থেকে মুক্তির জন্য দ্বারস্থ হয়েছিলেন সেই সময়ের নামকরা জ্যোতিষী তারিণী মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তারিণীবাবু বলেছিলেন পঞ্চাননবাবু যেন সোনার দোকান ছেড়ে চানাচুরের ব্যবসা করেন, তবেই আবার লক্ষ্মীলাভ হবে।
আর হলোও তাই। জ্যোতিষীর বাণীকে বেদবাক্য মনে করে পঞ্চাননবাবু ১৯৫০ সালে টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর কাছে একটা ছোট্ট চানাচুরের দোকান খুলে ফেললেন। ওই দোকানেই রোজ ৫-৬ কেজি চানাচুর ভাজা হতো। ভালোই বিক্রি শুরু করল চানাচুর। নাম রাখলেন ‘মুখরোচক’। যার ট্যাগলাইন ছিল– ভালো খান, সুস্থ থাকুন; যা আজও বজায় আছে।
পরবর্তী সময়
এরপর কলকাতার সময় পরিবর্তিত হতে শুরু করে। কলকাতায় মেট্রো রেল চালু হলে ‘মুখরোচক’-এর ছোট্ট দোকান ভাঙা পড়ে এবং সাতের দশক নাগাদ পঞ্চানন চন্দ্রর পুত্র নির্মলেন্দুবাবু সপরিবারে নরেন্দ্রপুর চলে যান। এরপর গোবিন্দপুরের বারুলি গ্রামে ২০ বিঘা জমি কিনে নির্মলেন্দুবাবু সেখানেই মুখরোচকের আধুনিক কারখানা গড়ে তোলেন।
‘মুখরোচক’ চানাচুর এখন তিন প্রজন্মের ব্যবসা। তৃতীয় প্রজন্মের কর্ণধার হলেন নির্মলেন্দুবাবুর পুত্র প্রণব চন্দ্র। তাঁর কথায়, ‘মুখরোচক এখন আর শুধু চানাচুরেই আবদ্ধ নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্র্যান্ডেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।' মুখরোচক-এর চানাচুর ছাড়াও টি স্নাক্স, টিফিন স্নাক্স, মিষ্টি, ককটেল মিক্স, ভুজিয়া, আলু ভুজিয়া কাবুলিচানা, মুগডাল ভাজা, মশলা চিড়া ভাজা, মশলা মুড়ি, চাল ভাজা ইত্যাদি নানা ধরণের পণ্য বিক্রি করে। এছাড়াও যুগের চাহিদার কথা মাথায় রেখে নিমকি, নোনতা কাজুবাদাম, নোনতা চিনাবাদাম এবং গুলাবজামুন– সব মিলিয়ে ২৮ রকমের খাবার তৈরি করে এই ব্র্যান্ড। ২০০৪ সালে এই সংস্থা কর্পোরেট সংস্থা হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে। আজ ‘মুখরোচক’ একটি ISO প্রত্যয়িত কোম্পানি। আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতিতে এবং স্বাস্থ্যকর উপায়ে আজ একাধিক জিভে জল আনা খাবার প্রস্তুতিতে মুখরোচক ব্র্যান্ডের জুড়ি মেলা ভার। চানাচুর এবং অন্যান্য খাবার তৈরির জন্য বিদেশি সংস্থার মেশিন বসেছে, যা দিনে ৬ টন চানাচুর ও অন্যান্য নোনতা খাবার তৈরি করতে পারে।
‘মুখরোচক’ ব্র্যান্ডের বৈশিষ্ট্য হলো, টক-ঝাল-মিষ্টি এবং মুচমুচে স্বাদের সঙ্গে কোনও আপস করেননি। অথচ এমন কোনও মশলা তাঁরা কোনও দিন ব্যবহার করেননি, যার সঙ্গে বাঙালি পরিচিত নয়। যখন একের পর এক মাঝারি আয়তনের বাঙালি প্রতিষ্ঠানে তালা পড়ছে, 'মুখরোচক' চানাচুর, যাঁরা বাংলায় স্ন্যাক্সের ব্যবসার পথিকৃৎ, তাঁরা এখনও মাথা উঁচু করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন প্রজন্মের নতুন চিন্তাভাবনা এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গিই সম্ভবত এই বিশেষ বাঙালি ব্র্যান্ডটিকে ডানা মেলতে সাহায্য করেছে।
মুখরোচক-এর বিশেষত্ব
বাঙালির ঘরে ঘরে মুখরোচক কোম্পানিটির এতদিন যাবৎ স্বমহিমায় টিকে থাকার পিছনে রয়েছে স্বাদের সঙ্গে আপস না করার গল্পই। যথাসাধ্য কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে খাঁটি ডাল, চিঁড়ে, বাদাম ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়। এরপর কোম্পানির নিজস্ব পরীক্ষাগারে কাঁচা অবস্থায় তার গুণমান পরীক্ষা করা হয়। ‘মুখরোচক’ পরিবার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, সমস্ত উপাদানের গুণমান সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মানুষের জিভের স্বাদই শেষ কথা বলতে পারে। তাই কোম্পানির যে কোনও উপাদানের সঠিক মান নির্ধারণের জন্য ‘মুখরোচক’ কোম্পানি অত্যন্ত দক্ষ শেফদের দলকে নিযুক্ত করেছে, যাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারের পর তবেই দ্রব্যটি প্যাকেটজাত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, উন্নত অটোমেশন প্রক্রিয়ায় বারংবার পরীক্ষাও করা হয়। কারণ গ্রাহকই তাদের কাছে শেষ কথা। গ্রাহক খেয়ে খুশি হলে তারা খুশি।
‘মুখরোচক'-এর বর্তমান কর্ণধার প্রণব চন্দ্রের কথায়, তাদের চানাচুর খেলে গ্যাস, অ্যাসিডিটি কিচ্ছু হয় না। তিনি আরও জানান, ভারতীয় মশলার কিছু ঔষধিগুণও আছে, সেগুলি যদি সঠিক মাত্রায় খাবারে দেওয়া হয়, তাহলে সেই খাবার স্বাস্থ্যকর হবেই। তাই চানাচুর বা অন্যান্য খাবারের প্যাকেটের পিছনে তার পুষ্টিতালিকাও দিয়ে দেয় ‘মুখরোচক’, যা অন্য চানাচুরের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এইভাবেই 'মুখরোচক' আজও তার খাবারের স্বাস্থ্যগুণ বজায় রেখেছে।
এই সংস্থার আরও একটি বিশেষত্ব হলো, খাবার তৈরির আগে এই সংস্থার সকল কর্মী ‘মেডিটেশন’ করেন। যাতে মন শুদ্ধ থাকে এবং রান্নাও শুদ্ধ হয়। আর এই ব্যবস্থা সংস্থা শুরুর প্রথম থেকেই আছে যা প্রণববাবুর মা, দিদা-ঠাম্মারাও করতেন এবং এই রীতি আজও বজায় আছে।
কোনও ব্যবসার শুরু থেকে শেষ শব্দ পর্যন্ত গুণমানই যে একমাত্র মানদণ্ড, সেকথাই যেন বারবার প্রমাণ করে দিচ্ছে ‘মুখরোচক’। বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্যে আজও এত বছর ধরে তাই সহজেই নিজের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছে আমাদের ছেলেবেলা থেকে আজকের অতি-পরিচিত ‘মুখরোচক’ ব্র্যান্ডটি। তাই চানাচুরের প্যাকেটে আজও বিদ্যমান বাঙালি বাবু পঞ্চানন চন্দ্রর মুখ।
কে বলে বাঙালি ব্যবসা করতে জানে না!