আট নারী, আশি টাকা, লিজ্জত পাঁপড় দেখিয়ে দিল মেয়েরাই পারে
Lijjat Papad : ব্যবসার জন্য পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন গুজরাতের যশবন্তীবেন, কীভাবে স্বল্প মূলধনেই অসম্ভবকে সম্ভব করল লিজ্জত পাঁপড়
চাটনির সঙ্গে দারুণ সঙ্গত করলেও বাঙালির হেঁশেলে এ স্বাদের পরিচিতি ঘটেছিল অনেক আগেই। কেবল বাংলা বলে নয়, গোটা দেশেই পাঁপড় খাওয়ার চল বহুকালের। সনাতনী ঘড়িটা এই পদের হাত ধরেই আজ এতগুলো বছর ধরে সংসারের হল ধরে আসছেন বহু খেটে খাওয়া মায়েরা। আর এই পথচলার শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ছয় দশকেরও বেশি সময় আগে। কোম্পানির নাম লিজ্জত পাঁপড়। বিয়েবাড়ি হোক বা অন্য কোনও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, সব অনুষ্ঠানেই জিভে জল আনে লিজ্জত পাঁপড়, পরিচিত এই বিজ্ঞাপনটির সঙ্গে ছোট থেকেই কমবেশি সবাই পরিচিত। কিন্তু জানেন কি শুধু বিজ্ঞাপন নয় এই কোম্পানিটির সাফল্যের গল্পে রয়েছে আরও অনেক ওঠাপড়ার ইতিহাস।
পাঁপড়, হাজার রকমফের এই খাবারের। চাল, ডাল, সাবু, আলু অথবা বেসন নানা স্বাদের পাঁপড় খাওয়ার চল রয়েছে আজও। হালফিলের স্যানকসের ভিড়ে এর চাহিদা কমেনি এক রত্তিও। তবে ঘরে তৈরি এইসব পাঁপড়কে এদেশে প্রথম ব্যবসায়িক রূপ দিয়েছিল আট মহিলা। যার মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন যশন্তীবেন যমুনাদাস পোপাট। অবশ্য তিনি একা নন, তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্যবসার হাল ধরেছিলেন পার্বতীবেন রামদাস ঠোবানি, উজমেবেন নারায়নদাস কুড্ডলিয়া প্রমুখ।
আরও পড়ুন - আজও মেলে ৫ টাকায়, ৬৪ বছর পেরিয়ে এসে নস্টালজিয়ার অন্য নাম অপ্সরা পেনসিল
নাম শুনেই আন্দাজ করা যায় এই কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গুজরাটের প্রসঙ্গ। যদিও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ ব্যবসায় চাহিদা যতোই বেড়েছে বিস্তৃতিও ছড়িয়ে পড়েছে গুজরাট সহ ভারতের অন্যান্য প্রদেশে। প্রয়োজন অনুসারে এসেছে স্বাদের নানা রকমফেরও। ব্যবসা যত এগিয়েছে ততই বাড়তে শুরু করেছে কর্মচারী ও শ্রমিকদের সংখ্যা। ফলে সেই তাগিদ মেটাতে ধর্ম-বর্ণ-জাতি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই ব্যবসায় অংশীদার হয়েছেন ভারতীয়রা। ক্রমেই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে লিজ্জত পাঁপড়ের নাম। আজও যে নামে ফেরে লোকের মুখে মুখে।
ব্যবসার আজকের চেহারাটা দেখলে অবশ্য শুরুর সময়টা সহজে আন্দাজ করা যায় না। সামগ্রিক গ্রোথ দেখে কি সত্যিই বোঝা যায় যে এই ব্যবসা যাঁরা শুরু করেছিলেন তাদের পুঁজি বলতে ছিল মাত্র আশি টাকা। না ছিল কোনও ব্যবসায়িক ডিগ্রি না ছিল অ্যানুয়াল টার্নওভার, মার্কেট রিসার্চ, বিজনেস গ্রোথ সম্পর্কে কোনও ধারণা! থাকার মধ্যে ছিল পারিবারিক খরচের দায় নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার মতো মনের জোর আর, ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখার জেদ। আর তাই দিয়েই মিরাকেল ঘটালেন গুজরাটের ওই আট মহিলা। ভাবা যায়, মাত্র আশি টাকা মূলধনে শুরু হয়ে আজ প্রায় ছয় দশক পর এসে সেই ব্যবসার বার্ষিক টার্নওভার ১৬০০ কোটি টাকা৷
জানা যায়, প্রাথমিক ভাবে যশন্তীবেন যমুনাদাস পোপাটের নেতৃত্বে সাত গুজরাটি মহিলা নিজেদের রান্নাবান্না করার কৌশলকে হাতিয়ার করে ব্যবসায় নেমেছিলেন। নিজেদের ঘরের কাজ সামলে ব্যবসা করায় চাপ ছিল। তাই বাধ্য হয়েই ব্যবসাকে পার্টটাইম হিসেবে শুরু করতে হয় মহিলাদের। সংসার সামলে অবসর সময়ে পাঁপড় বানাতেন ওই মহিলারা। অতিরিক্ত দু পয়সা রোজগারের জন্যেই এই কাজ শুরু করেন তাঁরা। আট জন থেকে ক্রমেই সেই ব্যবসার হল আজ প্রায় ৪০০০০ -এরও বেশি মহিলার হাতে। জীবনে স্বনির্ভরশীল হওয়ার লক্ষ্যে যারা অবিচল। এঁরা আজ সকলের কাছে ‘লিজ্জত সিস্টার’ নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন - ২৯৫ টাকা থেকে শুরু করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা, কোন রহস্য লুকিয়ে ব্রিটানিয়ার সাফল্যে
গুজরাটি ভাষায় লিজ্জত শব্দের অর্থ সুস্বাদু। বর্তমানে এই লিজ্জত পাঁপড়ের যা বিক্রি, তাতে অবশ্য সার্থক এ নামকরণ। প্রথম প্রথম মহিলারা খুব বেশি পাঁপড় তৈরি করতে পারতেন না। দিনে মাত্র চার প্যাকেট তৈরি করে ডিস্ট্রিবিউটরের হাতে তুলে দিতেন। সেখান থেকে স্বাদের গুণে ক্রমশ l বাড়তে থাকে এই পাঁপড়ের নাম। আজ কেবল ভারতবর্ষের ১৭টা রাজ্যেই পৌঁছে থেমে থাকেনি লিজ্জত পাঁপড়ের চাহিদা। পাশাপাশি আরও ২৫টি দেশের নাগরিকদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে ভারতীয় লিজ্জত পাঁপড়ের স্বাদের ঘরানা। এখানেই শেষ নয়, বছর দুই আগে ব্যবসার জন্য পদ্মশ্রীও পেয়েছেন যশবন্তীবেন।এমনকী বিখ্যাত এই লিজ্জত পাপড়ের ওপর সিনেমা বানাতে চলেছেন প্রখ্যাত বলিউড পরিচালক আশুতোষ গোয়ারিকর। এতো বিষয় থাকতে কেন পাপড়ের ওপর সিনেমা? তার কারন এই সংস্থার বিরল কীর্তি। কয়েকজন নারীর উদ্যোগে সামান্য পুঁজি থেকে শুরু করে ভারতের অন্যতম সেরা ব্র্যান্ড হয়ে ওঠা লিজ্জত পাঁপড়কে অনুপ্রেরণা হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন পরিচালক। কেবল সিনেমার পর্দাই নয়, বাস্তবের মাটিতে আজও মেয়েদের ঘরে বাইরে যে লড়াই তার চাক্ষুষ প্রমাণ মেলে এই পাঁপড়-এর ব্যবসায়।