আজও মেলে ৫ টাকায়, ৬৪ বছর পেরিয়ে এসে নস্টালজিয়ার অন্য নাম অপ্সরা পেনসিল
Nataraj & Apsara Pencil : বাঙালির স্মৃতিতে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছে লাল-কালো খোলসের নটরাজ পেন্সিল আর ছাইরঙা খোলসের অপ্সরা পেন্সিল
“সাত দুগুণে চোদ্দোর নামে চার, হাতে রইল পেন্সিল”, এই বলেই আবার অঙ্ক কষতে শুরু করল ‘হ য ব র ল’-এর কাক্কেশ্বর কুচকুচ। কিন্তু কোন কোম্পানির পেনসিলে অঙ্ক কষছিল সে, এই প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় স্বয়ং সুকুমার রায় নিজেও জানতেন না। যদিও তাতে কিছুই যায় আসে না, কারণ পেন্সিল বলতে বাঙালির স্মৃতিতে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছে যারা, তারা হল লাল-কালো খোলসের নটরাজ পেনসিল আর ছাইরঙা খোলসের অপ্সরা পেনসিল। পেনসিল ঘিরে রয়েছে একরাশ শৈশব। যার পরতে পরতে রঙিন গল্পেরা।
নটরাজ-অপ্সরা, এই নাম দুটোই যথেষ্ট। এক নিমেষে মনে পড়ে যায় আমাদের ছোটোবেলার স্মৃতি। শুধু নাম আর খোলসই নয়, নটরাজ এবং অপ্সরার বিজ্ঞাপনও ক্রেতাদের কাছে অভিনবত্ব তৈরি করেছিল সেই সময়ে। একদিকে নব্বই-এর দশকের সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপনে আর পাঁচটা পেনসিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতার দৌড়ে নটরাজ পেনসিল অনায়াসে জিতে গিয়েছে। অন্যদিকে অপ্সরার 'একস্ট্রা ডার্ক' পেনসিল পরীক্ষার খাতায় এনে দিয়েছে একস্ট্রা মার্কস। আর এমন বিজ্ঞাপনের জেরেই জনপ্রিয়তা বেড়েছে নটরাজ, অপ্সরার। পড়ায় খানিক ফাঁকি দিয়েও যদি পেন্সিলের জোরে বেশি নম্বর হাঁকানো যায়, তবে তো আর কথাই নেই। তাই এই লোভে ছোটরা মোটেই চাইল না পেনসিলের কোম্পানি বদল করতে। ব্যাস নটরাজও থেকে গেল রাজার হালে, আর অপ্সরাও তার নাম স্বার্থক করে ফেলল।
আরও পড়ুন : বাড়ি বাড়ি ঘুরে পেন বিক্রি থেকে লিংক সাম্রাজ্য! পাঁচ টাকার পেনে দেশের মন দখল…
সময়টা ১৫৬০ সাল। সিমোনিও এবং লিন্ডিয়ানা বার্নাকোটি নামে এক ইতালিয়ান দম্পতির হাত ধরে ব্যবহারিক জীবনে প্রথম যাত্রা শুরু করল পেনসিল। প্রাথমিকভাবে একটি কাঠের ফ্রেমবন্দি গ্রাফাইট বা কার্পেন্টার পেনসিল দিয়ে লেখার কথা ভাবেন তাঁরা। এরপর ১৮৫৮ সালের ৩০ শে মার্চ হাইমেন লিপম্যান নামে এক ভদ্রলোক পেনসিলের মাথায় রবার বা ইরেজার লাগানোর স্বত্ব পান। পেনসিল সম্পর্কে আরও একটি তথ্য জানা যায়। আমেরিকায় পেনসিল বানানো শুরুর পর থেকে বেশিরভাগ পেনসিলের আবরনের রঙ হয় একঘেঁয়ে হলদেটে। ১৮৯০ সালে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিয়ান কোম্পানী এল এন্ড সি হার্ডমুথ তাদের সবচেয়ে দামী কোহিনূর ব্রান্ডের পেনসিল বাজারে ছাড়ার পর থেকেই এই প্রথা শুরু হয়। ওই সময় কোহিনূর বাদে অন্যান্য পেনসিলের রং ছিল কালো বা এর কাছাকাছি অন্যান্য রঙের, কিন্তু কোহিনূরের রঙ ছিল হলুদ। পরবর্তীতে কোহিনূরের জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিতে হলুদ রংকেই আশ্রয় করে বাকিরা।
এদেশে প্রথম পেনসিল তৈরি শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। 'হিন্দুস্তান পেন্সিলস্ প্রাইভেট লিমিটেড'-র হাত ধরে। 'নটরাজ' ব্র্যান্ডের নাম নিয়ে প্রথম পেনসিল তৈরি শুরু করে এই কোম্পানি। প্রথমদিকে পেনসিলের পাশাপাশি তারা তৈরি করতে থাকে ইরেজার এবং পেনসিল কাটারের মতো প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস। নটরাজ যখন বেশ পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে তখন ব্যবসা আরও খানিকটা প্রশস্ত করতে নতুন কিছুর কথা ভেবে কোম্পানি। এই ভাবনা থেকেই ১৯৭০ সালে 'অপ্সরা' নামক ব্র্যান্ড নিয়ে আসেন উদ্যোক্তারা। শুধু তাই নয়, ভারতে প্রথম নন-ডাস্ট ইরেজার ভাবনাও আসে এই অপ্সরা ব্র্যান্ডের হাত ধরেই। এরও বেশ অনেক বছর পর, ২০০৭ সালে এই হিন্দুস্তান কোম্পানি নটরাজ পেনসিলের খোলসের জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে, একই আদলে তৈরি করে নটরাজ পেন। ততদিনে অবশ্য অপ্সরা ব্র্যান্ডের হাত ধরে আরও একটা অভিনব পথ চলা শুরু হয়ে গিয়েছে। লেখার পেনসিলের থেকে যে আঁকার পেনসিলকে আলাদা হতে হবে এমন ধারণাও ঢুকে গিয়েছে অন্দরে। অপ্সরাই রয়েছে নেপথ্যে। বাজারে তখন জমিয়ে বিক্রি হতে থাকে সবুজ খোলসের ‘2B’, ‘4B’, ‘8B’ অথবা ‘HB’ পেনসিল। কেবল সেদিন বললে ভুল হবে, আজও আঁকার পেনসিলের বিকল্প হিসেবে অপ্সরার আশপাশে কারোর জায়গা হয়নি।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পেনসিলের বন্ধু হয়েছে অনেকেই। কোম্পানিও তাই থেমে থাকেনি। ইরেজার, কাটার, স্কেল, গাণিতিক যন্ত্রপাতি, মেকানিকাল পেনসিল, কালার পেনসিল কিংবা মোম রং এবং জল রংও প্রস্তুত করতে শুরু করে তারা। লেখাপড়ায় বইখাতার সঙ্গে আনুষঙ্গিক যা যা প্রয়োজন তার সবটাই এনেছে একে একে।
আরও পড়ুন : ৭৭ বছর ধরে নতুন-পুরনো কলমের অসুখ সারাচ্ছে ধর্মতলার এই পেন হাসপাতাল
মুম্বাই শহরে প্রথম যাত্রা শুরু হয় হিন্দুস্তান পেনসিলস প্রাইভেট লিমিটেডের। সময়ের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এই কোম্পানির শাখা প্রশাখা। আজকের দিনে যখন পরিবেশ দূষণের ভ্রুকুটি তখন কাঠের পেন্সিল প্রস্তুতিতে গাছ কাটার বিকল্প হিসেবে এক দৃষ্টান্তমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে এই কোম্পানি। নিজস্ব গাছ লাগিয়ে তা থেকে কাঠ কাটা এবং পাশাপাশি আবার নতুন গাছ লাগানো এই পদ্ধতিকেই অবলম্বন করে এসেছে তারা।
শুধু পেনসিল, পেন কিংবা যন্ত্রপাতি প্রস্তুতই নয়, পাশাপাশি একাধিক সামাজিক কাজেও যুক্ত থেকেছে হিন্দুস্তান পেনসিলস প্রাইভেট লিমিটেড। তৈরি করেছে নটরাজ এডুকেশনাল ট্রাস্ট। দুঃস্থ মেয়েদের জন্য স্কুল কিংবা সেরিব্রাল পলসি রোগের চিকিৎসা ইত্যাদি দায়ভার কাঁধে তুলে নিয়েছে এই কোম্পানি।
সময় যতো এগিয়েছে বদলেছে আমাদের জীবনধারণ। হারিয়ে গিয়েছে ফেলে আসা দিনের অনেক স্মৃতিই। খাতা পেনসিলে লেখার বদলে আজ পরিচিত অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে ‘টাইপ’ করা। ফলে পেনসিলও তার জৌলুস হারিয়েছে। কিন্তু আভিজাত্য কমেনি এক রত্তিও। আজও নতুন বইয়ের পাতায় দাগ দিতে গেলে ছোটোবেলার স্কুল ব্যাগটা হাতড়ে এক টুকরো পেনসিল খোঁজে সকলেই। আসলে এতো বড় জীবনে বোধ হয় কেবল ওই একটা জিনিসের দাগই চটজলদি মুছে ফেলা সম্ভব! কাঠের কাজে মাপ নিতে কিংবা প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার খাতায় স্কেচ করতে পেনসিলের বিকল্প এখনও অন্য কেউ হতে পারেনি। সেই পরিচিত অভ্যাসে বদল ঘটেনি, বদল ঘটেনি পরিচিত ব্র্যান্ডেও। আজও দোকানে গেলে নতুন নতুন রঙের পেন্সিলের ভিড়ে খোঁজ পড়ে সেই ছাইরঙা অপ্সরা পেন্সিল কিংবা লাল-কালো খোলসের নটরাজ পেন্সিলটিরই। শৈশব বাক্সটা জানান দেয় দীর্ঘ ৬৪ বছরের যাত্রাপথে ‘নটরাজ’ আর ‘অপ্সরা’ আজও থেকে গিয়েছে নস্টালজিয়া হয়ে। থেকে গিয়েছে অভ্যাস হয়েও।

Whatsapp
