৯০ বছর ধরে বাঙালির ভরসা দুলাল চন্দ্র ভড়! যেভাবে 'ব্র্যান্ড' হয়ে উঠল তালমিছরি
Dulal Chandra Bhar Talmishri: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মিছরির চাহিদা ছিল তুঙ্গে। তখন ঘরে ঘরে চিনির বদলে মিছরির শরবত খাওয়ার চল ছিল।
দুলালের তালমিছরি বললে চোখের সামনে কী ভেসে ওঠে? মাঝারি মাপের কাঁচের বয়াম, তাতে মিষ্টি মুখের হাসি নিয়ে এক বাঙালি ব্যবসায়ীর ছবি। তিনিই দুলালচন্দ্র ভড়। যার তালমিছরি খেয়ে ৯০ দশকের কচিকাঁচারা বড় হয়েছে, রোগভোগ থেকে বেঁচেছে। ছোট থেকেই বাঙালি শুনে আসছে বাঙালির দ্বারা আর যাই হোক ব্যবসাটা ঠিক হয় না। নির্ঝঞ্ঝাট বাঙালি তাই পরের খিদমতগিরি করে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। অবস্থা বদলাল কই? বর্তমানে চাকরির বেহাল দশা যখন বেকারত্বের হার দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে তখনও হন্যে হয়ে পড়ে থাকতে হয় কবে ‘চাকরি’ পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যাবে। সত্যিই বাঙালি ব্যবসার ঝুঁকি নিতে ভয় পায়? তাহলে শোনা যাক এক ঊনিশ বছরের ছেলের সাহস করে তৈরি করা তালমিছরির ব্যবসার কথা। ৮০-৯০ বছর ধরে যা বাঙালির ঘরে ঘরে ডাক্তারি প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বহু রোগ নিরাময় করে যাচ্ছে নিঃশব্দেই। তালমিছরির মধ্যে দিয়েই অমলিন বাঙালির সেই একান্ত নিজস্ব স্রষ্টা দুলালচন্দ্র ভড়। মৃত্যুর ২২ বছর পরেও আমবাঙালি তালমিছরির শিশি কেনে তাঁর ছবি আর সই দেখেই৷
“তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।”
রবিঠাকুরের ছড়ার মতোই এ দেশের রাস্তাঘাটে হুটহাট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা তালগাছের দেখা মেলে। তালের রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে এরপর তা ক্রিস্টালে পরিণত করার মাধ্যমে তালমিছরি পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে আজও তালমিছরি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুলালের তালমিছরির কথা। তালমিছরির গুণ তো অনেক। বাচ্চারা অসুখে পড়লে দুধের সঙ্গে তালমিছরি মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। বাঙালির ঘরে তালমিছরি একটা সময় খুব স্বাভাবিক একটি উপাদান ছিল। যদিও দিন বদলেছে, আধুনিক বাঙালির মনে ও মুখে পুরনো জিনিস আর তেমন একটা রোচে না। তবুও সমঝদার বাঙালির কাছে দুলালের তালমিছরি এখনও সমান প্রিয়। নব্বইয়ের দশকে যাঁরা বেড়ে উঠেছেন, সবাই বাড়িতে দুলালের তালমিছরির বোতল দেখে বড় হয়েছেন।
আরও পড়ুন- গুড়ের সন্দেশকে টেক্কা দিল চকলেট সন্দেশ! মিষ্টিমুখেও সাম্রাজ্যবাদ
মিছরির ইতিহাস
যেখানে বাঙালি ব্যবসা করতে ভয় পায় বলে ধারণা, ঠিক সেই বঙ্গেই এক ১৯-২০ বছরের ছেলে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে অদম্য সাহস আর জেদের উপর ভর করে তৈরি করেন নিজস্ব এক ব্র্যান্ড। কিন্তু দুলালের তালমিছরির এই ইতিহাস জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। হাওড়ায় তখন জহরলাল ভড়ের একচেটিয়া কাপড়ের কারবার। পারিবারিক সূত্রে হাওড়ায় অনেক দোকান। জহরলাল বাবুর ছেলে, নাতিও এই ব্যবসায় নেমে পড়েছে কিন্তু বেঁকে বসলেন বছর ১৯-এর দুলালচন্দ্র ভড়।
কোনও ব্যবসা বা ব্র্যান্ড যেমন একদিনে তৈরি হয় না ঠিক তেমনই একটি ব্র্যান্ডকে উচ্চতার শিখরে নিয়ে যেতে গেলে লাগে সাহস আর ধৈর্য। দুলালের তালমিছরির যাত্রাপথ এত সহজ ছিল না। দুলালচন্দ্রের পারিবারিক ব্যবসায় কোনও রুচি ছিল না। তিনি চাইতেন নিজের মতো করে কিছু করতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মিছরির চাহিদা ছিল তুঙ্গে। তখন ঘরে ঘরে চিনির বদলে মিছরির শরবত খাওয়ার চল ছিল। ব্যস, প্রচলিত কাপড়ের ব্যবসায় না গিয়ে শুরু করলেন সাদা মিছরি বিক্রি। কিন্তু তাতে তাঁর লাভ হলেও মন ভরল না। নিজস্ব কিছু করার লক্ষ্যে নতুন কাজ করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
হুগলির বাসিন্দা হওয়ার কারণে এবং তাঁদের বিঘে বিঘে জমিতে তালগাছ থাকার কারণে তালগাছের সঙ্গে পরিচিতি ছিলই। সেই থেকেই শুরু করলেন নতুন চিন্তা। শুরু হলো নয়া উদ্যোগ। সাদা মিছরির বদলে তিনি তৈরি করলেন তালমিছরি। যা অন্য কেউ কোনওদিন ভাবতেও পারেনি। ১৯৩৪ সালে তৈরি হলো দুলালের তালমিছরি। এরপর তা ধীরে ধীরে বাজারে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। রাজবলহাটের তন্তুবায় পরিবারের বছর ২০-র যুবক দ্রুত তালমিছরির জগতে কায়েম করলেন একচ্ছত্র অধিকার। ব্যবসায় তখন ব্র্যান্ড বা ট্রেডমার্কের চল তেমন ছিল না। অথচ তাঁর ব্যবসা একান্তভাবে তাঁরই হবে না, এ মানা যায় না! দুলাল চেষ্টা শুরু করলেন। ১৯৪৪ সালে কোম্পানিটি পাকাপাকি ভাবে নথিভুক্ত করা হলো তাঁর নামে।
আনন্দবাজার পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দুলালচন্দ্রের ছেলে ধনঞ্জয় ভড় জানিয়েছিলেন শুরুর দিকের সে সব গল্প। তার কথায়, এখন আর রেজিস্ট্রেশন নম্বর দরকার পড়ে না, তবু তাঁরা রেখেছেন বাবার ওই উদ্যোগকে কুর্নিশ জানাতে। সেকালে মিছরি প্যাকেজিং হত বস্তায়। নানান মাপের চটের বস্তায় বন্দি হয়ে তালমিছরি পাড়ি দিত বাংলার নানা প্রান্তে। শুধু কি বাংলা? দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়েছিল বিহার থেকে অসম, আহমেদাবাদ, ওড়িশায়। দুলালের তালমিছরির ব্যবসায় আরেকটি বিশেষত্ব হল, না এঁদের কোনও চটকদার ব্র্যান্ড আম্বাসাডর আছেন না তো কোনও সেলসপার্সন। ক্রেতারা অগ্রিম টাকা দিয়ে মিছরির অর্ডার করেন। আবার অনেকে বড়বাজারে তাঁদের অফিসে এসেও যোগাযোগ করে মিছরি নিয়ে যান। কী এমন আছে তালমিছরিতে, যা বছরের পর বছর ধরে একে ধরে রেখেছে সাফল্যের চুড়োয়? “আসলে দ্রব্যগুণ! তালের খাঁটি রস আর সামান্য চিনি ছাড়া তো তেমন কিছু থাকে না,” বলেছেন ধনঞ্জয় ভড়।
তালমিছরি তুমি কার - পারিবারিক দ্বন্দ্ব
জানা যায়, ১৯৮৫ সালে দুই ভাই দুলাল চন্দ্র ভড় ও সনাতন ভড় ব্র্যান্ডের নাম নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। তাদের এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। “শুরু থেকেই দুলালের তালমিছরির প্রস্তুতকারক হিসেবে দুলাল চন্দ্র ভড়ের নাম লেখা থাকত লেবেলের গায়ে। দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের পর ঠিক হয়, সনাতন ভড় তাঁর ব্যবসার জন্য ‘দুলালের তালমিছরি’ নামটি ব্যবহার করতে পারবেন, কিন্তু প্রস্তুতকারক হিসেবে দুলাল চন্দ্রের নাম রাখতে পারবেন না। অন্যদিকে আমার বাবা মিছরিকে ‘দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরি’ হিসেবে নতুন নাম দিয়ে বাজারে ছাড়েন। একইসঙ্গে তিনি লেবেলে তাঁর ছবি আর স্বাক্ষরও জুড়ে দেন,” জানান ধনঞ্জয় ভড়।
এরপর থেকে বাজারে ‘দুলালের তালমিছরি’ ও ‘দুলাল চন্দ্র ভাড়ের তালমিছরি’ দুটোই সমানে ব্যবসা করে এসেছে। এখনও দুলালের তালমিছরির বেশ চাহিদা রয়েছে গড়পড়তা বাঙালির কাছে। পশ্চিমবঙ্গের একটি ই-কমার্স প্লাটফর্মের সহপ্রতিষ্ঠাতা তন্ময় সর জানান, তাঁর প্লাটফর্ম থেকে মাসে গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ বোতল তালমিছরি বিক্রি করা হয়। এছাড়া সম্প্রতি বাংলার বাইরে থেকেও অর্ডার পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন- ৭৮ বছর ধরে বাঙালির ভরসা, এখন কী অবস্থা শালিমার নারকেল তেলের?
দুলালের তালমিছরির এত চাহিদা কেন?
কারণটা সহজ। মিছরি তৈরির জন্য তমলুক থেকে খাঁটি খেজুরের গুড় সংগ্রহ করা হত। বিকল্প হিসেবে কোনও সস্তা বা নিম্নমানের উপাদান ব্যবহার করা হত না। শুরু হয় মিছরির জায়গায় তাল মিছরির তৈরির প্রক্রিয়া, যা দুলালচন্দ্র নিজেই করেছিলেন বলে জানা যায়। প্রথমে তালের গুড় কিনে তা ভালো করে জ্বাল দিয়ে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়ে যেতে লাগলেন। তারপর ফুটন্ত গরম অবস্থায় থাকা গুড় ঢালা হত বড় বড় ট্রেতে। বিশেষ ধরনের চটের কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হত ট্রের মুখ। এরপর বন্ধ ঘরে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তা ওইভাবেই রেখে দেওয়া হত একসপ্তাহ মতো। এই পাক ও মিশ্রণ ঠিকঠাক হলে ট্রের উপরের অংশে জমাট বাঁধতো পুরু আকারের মিশরি। সেগুলোকে কাটিং করে প্যাকিং করে বিভিন্ন মাপের বস্তায় ভরে রপ্তানি করা শুরু হয় গোটা বাংলা সহ পূর্ববঙ্গেও।
নিজের তৈরি ব্যবসাকে উচ্চস্থানে নিয়ে যাওয়া খাঁটি বাঙালি দুলাল চন্দ্র ২০০০ সালে ইহজগৎ ত্যাগ করেন। কিন্তু তারপরেও এক ও অদ্বিতীয় ব্র্যান্ড হিসেবে এখনও এই মিছরি এক নম্বরে, শুধুমাত্র দ্রব্যের গুণমানের জন্য। বর্তমানে এই ব্র্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত দুলালবাবুর উত্তরসূরিরা এখনও তমলুক থেকে আনা তালের গুড় ছাড়া মিছরি তৈরি করেন না এবং এর কর্মচারীরাও বংশানুক্রমেই এই কাজে যুক্ত। পাশাপাশি, একটা মজার তথ্যও বলে রাখা দরকার, এই প্রোডাক্ট এতটাই বাঙালিয়ানা বহন করে যে ১৯৭৬ সালের হিট হিন্দি সিনেমা ‘দো আনজানে’ তে অভিনেত্রী রেখার ফ্ল্যাটটিকে বাঙালি বাড়ি বোঝাতে পরিচালক দুলাল গুহ সেটের তাকে দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরির একটি শিশি রেখেছিলেন, কারণ বাঙালির ঘরে ঘরে তখন এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।