পাউডারেই লুকিয়ে ক্যানসারের বিষ, ভারতের শিশু ও মহিলারা কতটা বিপদে
বিগত ছ'বছরে হাজার-হাজার মহিলার অভিযোগ জনসন অ্যান্ড জনসনের পাউডার থেকে ক্যানসার হচ্ছে। এই মুহূর্তে হাজার হাজার মহিলা এই সংস্থার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই মামলা করেছেন।
বিশ্বজুড়ে জনসন অ্যান্ড জনসন নিজেদের সংস্থার তৈরি ট্যাল্ক-নির্মিত বেবি পাউডার বিক্রি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল। তবে বাদ পড়ল ভারত। 'মানিকন্ট্রোল' সূত্রে জানা যাচ্ছে, ভারতে এযাবৎ যে পরিমাণ জনসন অ্যান্ড জনসনের বেবি পাউডার উৎপাদন হয়েছে, তা সম্পূর্ণ বিক্রি না হওয়া অবধি বাজার থেকে নিজেদের এই পণ্য তারা প্রত্যাহার করবে না।
বিগত ছ'বছরে হাজার-হাজার মহিলার অভিযোগ জনসন অ্যান্ড জনসনের পাউডার থেকে ক্যানসার হচ্ছে। এই মুহূর্তে হাজার হাজার মহিলা এই সংস্থার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই মামলা করেছেন।
দু'বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সংস্থা সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করেছিল নিজেদের ট্যাল্ক-নির্মিত বেবি পাউডারের বিক্রি। ভারত বাদে বিশ্বের বাকি দেশগুলি থেকে এই পাউডার বিক্রি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিতে দুই বছর সময় নিল জনসন অ্যান্ড জনসন।
আরও পড়ুন: রান্নার তেলেই বিষ মিশছে প্রতিদিন, নিজের অজান্তেই ডেকে আনছেন মৃত্যু
চলতি বছরেই ভারতে জনসন অ্যান্ড জনসনের তৈরি শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার পনেরো বিলিয়ন মার্কিন ডলারে (যেখানে এক বিলিয়ন মানেই দশ কোটি মার্কিন ডলার) পৌঁছেছে, জানাচ্ছে অল ইন্ডিয়া অর্গানাইজে়শন অফ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস।
আদালতে দাঁড়িয়ে জনসন অ্যান্ড জনসন যা দাবি করল
কিন্তু তার আগে বারে বারে দাবি করে এসেছে তারা যে, তাদের তৈরি বেবি পাউডারে ফর্মালডিহাইড এবং অ্যাসবেস্টসের মতো ক্ষতিকর পদার্থ নেই। পাশাপাশি এত সংখ্যক মামলার সামনে দাঁড়িয়ে জনসন অ্যান্ড জনসন জানিয়েছে, তারা এবার থেকে কর্নস্টার্চ থেকে বানাবে শিশুদের পাউডার। যে-সময় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই সংস্থা, তখনও কিন্তু নিজেদের তৈরি পাউডার যে ক্ষতিকর নয়, সেই পুরনো বক্তব্যেই অটল থেকেছে তারা।
তবে জনসন অ্যান্ড জনসন যে জোর গলায় দাবি করছে, তাদের পাউডার এবং শ্যাম্পু সম্পূর্ণ নিরাপদ, তা কিন্তু নিজেদের করা গবেষণার ভিত্তিতে বলছে; যে গবেষণা এই সংস্থা বাদে অন্য কেউ তত্ত্বাবধান করেনি।
অথচ রয়টার্সের সূত্রে জানা যাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি রেকর্ড, ট্রায়াল টেস্টিমনি এবং অন্যান্য প্রমাণ স্পষ্ট করছে, ১৯৭১ থেকে ২০০০ পর্যন্ত জনসন অ্যান্ড জনসন নিজেদের তৈরি পাউডারে বেশ কয়েকবার সামান্য হলেও অ্যাসবেসটস ব্যবহার করেছে। কিন্তু সেই প্রমাণ সংস্থার সামনে পেশ করার পরেও তারা বারে বারে অ্যাসবেসটস ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
অন্যদিকে ফর্মালডিহাইডের প্রভাবে মায়েলয়েড লিউকেমিয়া, ন্যাসোফেরেঞ্জিয়াল ক্যানসার সৃষ্টি হতে পারে।
কতটা ক্ষতিকারক অ্যাসবেসটস এবং ফর্মালডিহাইড?
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার ইতিমধ্যেই অ্যাসবেসটসকে মানুষের শরীরে ক্যানসারের কারণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ব্রিটেনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (এনআইএইচ), সেন্টার ফর ডিজি়জ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি), এবং ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রিশন (এফডিএ) অনেক আগেই অ্যাসবেসটসকে কার্সিনোজেনিক বা ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
অ্যাসবেসটস নিঃশ্বাসের সঙ্গে খুব সহজেই শ্বাসনালী হয়ে ফুসফুসে পৌঁছতে পারে। ফুসফুসে ক্যান্সার তৈরি হওয়ার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অ্যাসবেসটস। ফুসফুসে যত বেশি অ্যাসবেসটস প্রবেশ করে, ততই বাড়ে ক্যানসারে ভোগার সম্ভাবনা।
ফুসফুসে ক্যানসারের পাশাপাশি অ্যাসবেসটস মেসোথেলিওমা ঘটার পিছনেও দায়ী। মেসোথেলিওমা একটি বিরল ধরনের ক্যানসার। বুক এবং পেটের মধ্যে থাকা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মেসোথেলিয়াম কোশে এই ক্যানসার হতে দেখা যায়। এর পাশাপাশি অ্যাসবেসটসের প্রভাবে ওভারি অর্থাৎ ডিম্বাশয়েও ক্যানসার হতে দেখা গেছে।
ডিসিজিআই চুপ!
জনসন অ্যান্ড জনসনের শ্যাম্পু এবং ট্যাল্ক-নির্মিত বেবি পাউডারে ফর্মালডিহাইড এবং অ্যাসবেসটসের মতো উপাদানের সন্ধান পাওয়ার দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছিল এই সংস্থার তৈরি শ্যাম্পু এবং পাউডারের ল্যাবরেটরি পরীক্ষার পদ্ধতি। কারণ এই দুই পদার্থই শরীরে ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। বেশ কিছু ব্যক্তি এই জনসন অ্যান্ড জনসনের পাউডার ব্যবহার করে ইতিমধ্যেই ক্যানসারের শিকার। ভারতে জনসন অ্যান্ড জনসনের শ্যাম্পু ও পাউডার প্রত্যাহারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী, তা জানতে চেয়ে ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া বা ডিসিজিআই-কে পাঠানো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি, এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছিল তার পাঁচ দিন আগেও।
সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজে়শনের দায়িত্বহীনতা
গত বছর ন্যাশনাল কমিশন অফ প্রোটেকশন ফর চাইল্ড রাইটস ডেকে পাঠায় ডিসিজিআই এবং সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজে়শনকে। কারণ জনসন অ্যান্ড জনসনের ল্যাবরেটরির পরীক্ষা পদ্ধতিতে অসংগতি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য এই পরীক্ষাটি জনসন অ্যান্ড জনসন নিজেদের তৈরি পাউডার ও শ্যাম্পুতে অ্যাসবেসটস এবং ফর্মালডিহাইড আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য করেছিল। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে রাজস্থানের ড্রাগ পরিদর্শক জনসন অ্যান্ড জনসনের 'নো মোর টিয়ার্স' বেবি শ্যাম্পুতে ফর্মালডিহাইডের উপস্থিতির কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বছরেরই জুন মাসে কলকাতার সেন্ট্রাল ড্রাগ ল্যাবরেটরি জানিয়েছিল, সেই শ্যাম্পু নাকি একেবারেই নিরাপদ।
জানা যাচ্ছে, যথাযথ পরীক্ষা নাকি কলকাতার সেন্ট্রাল ড্রাগ ল্যাবরেটরি এবং চণ্ডীগড়ের রিজিওনাল ড্রাগস টেস্টিং ল্যাবরেটরি, কেউই মানেনি।
যেখানে সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজে়শনের দায়িত্বই হলো, নতুন ড্রাগসের ব্যবহারে অনুমতি দেওয়া, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল তত্ত্বাবধান করা, ড্রাগ পরীক্ষার পদ্ধতি কীভাবে হবে তা নির্ধারণ করা, এবং ভারতের বাইরে থেকে আসা ড্রাগের মান নিয়ন্ত্রণ করা, সেখানে তারা জনসন অ্যান্ড জনসনের পাউডার ও শ্যাম্পুর ক্ষেত্রে পরীক্ষার মানোপযোগী পদ্ধতি অনুসরণ করেনি। পরীক্ষা পদ্ধতিতেও ছিল অনেক অসংগতি।
এত কিছুর পরেও বাজার থেকে নিজেদের পণ্য সরাচ্ছে না জনসন অ্যান্ড জনসন। একথা জলের মতো স্পষ্ট, ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া এবং সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজে়শনের অনুমতি ছাড়া কোনও জনসন অ্যান্ড জনসনের পণ্যই বাজারে এখনও বহাল তবিয়তে থাকতে পারে না।
তাহলে ভারতীয় শিশু ও মহিলাদের ক্যানসার হলে দায় কে নেবে?