চন্দ্রশেখর আজাদকে গুলি! রামের রাজ্যে 'দলিত আইকন' হয়ে ওঠা এই নেতা আসলে কে?
Chandrashekhar Azad Shot: বাবার মৃত্যুর পরে নিজের গ্রামের বাইরে বড় করে আজাদ লিখে রেখেছেন “দ্য গ্রেট চামারস অব গডকৌলি ওয়েলকামস ইউ”!
"সভি সে আপিল করুঙ্গা, শান্তি বানায়ে রাখখে। হাম আপনি লড়াই সাংবিধানিক তরিকে সে লড়েঙ্গে, ম্যায় ঠিক হুঁ, বাস আপ শান্তি বানায়ে রাখখে।"
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বলছেন দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ রাবণ। পেটে গুলি খেয়ে চন্দ্রশেখর বলছেন শান্তির কথা, সংবিধানের কথা। উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরে ২৮ জুন, বুধবার ভীম আর্মি প্রধান চন্দ্র শেখর আজাদকে গুলি করা হলো। দলীয় এক সমর্থকের বাড়িতে একটি শ্রাদ্ধানুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই চন্দ্রশেখরের গাড়ি ধাওয়া করে অন্য একটি গাড়িতে চড়ে আসে দুষ্কৃতীরা। চন্দ্রশেখর আজাদের এসইউভি লক্ষ্য করে গুলি চলে। একটি গাড়িতে, একটি গুলি সোজা পেটে! আততায়ীদের তখন চেনা যায়নি, তবে বুলেটটি দলিত নেতার পেট চিরে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি। সেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই রক্তের বদলে রক্ত নয়, গুলির বদলে সংবিধানকে অস্ত্র করেছেন রাবণ! চন্দ্রশেখর আজাদ তাঁর বিবৃতিতে পুলিশকে বলেছেন, হামলাকারীদের চিনে ফেলেছেন তাঁর দলের লোকেরা। হরিয়ানার নম্বর প্লেট লাগানো দুষ্কৃতীদের গাড়ি সাহারানপুরের দিকে গেলে তারাও ইউ-টার্ন নেন। ঘটনার সময় আজাদের ছোট ভাইসহ পাঁচজন ছিলেন ওই গাড়িতে। তবে চন্দ্রশেখর আজাদকে গুলি কেন হঠাৎ? কে এই দলিত নেতা?
১৯৮৬ সালে জন্ম চন্দ্রশেখরের, উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলায়। দেশের মোট দলিত জনসংখ্যার বিশ শতাংশই উত্তরপ্রদেশের। আশ্চর্যজনকভাবে দেশে দলিত নির্যাতনের সবচেয়ে বেশি ঘটনাও এই রাজ্যেই। বাবা গোবর্ধন দাস, মা কমলেশ দেবী। বাবা সরকারি স্কুলের মাস্টার। শূদ্র শিক্ষক, অতএব যে পেশাতেই থাকুন না কেন, তাঁকে শুনতেই হয় “চামার হ্যায় মাস্টারজি”। গোবর্ধনদের মতো অজস্র শূদ্র নিজেদের চাকরি, সামাজিক পরিচয় দিয়ে নিজেদের 'চামার জন্মের' ক্ষত ঢাকতে পারেননি। কিন্তু চন্দ্রশেখর আজাদ নিজের রাজনৈতিক দর্শনে দলিতজন্মকে রোম্যান্টিসাইজ করার হিম্মত দেখাতে চেয়েছেন। বাবার মৃত্যুর পরে নিজের গ্রামের বাইরে বড় করে লিখে রেখেছেন “দ্য গ্রেট চামারস অব গডকৌলি ওয়েলকামস ইউ”! এমন লেখার ধককে কেন্দ্র করেই উত্তরপ্রদেশের ঠাকুর ও দলিতদের বিরোধের পর থেকে দেশের দলিত রাজনীতির কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে ওঠেন আজাদ। মেথর পাড়া, মুচিপাড়ার নেপথ্যের জাতের পরিচয়কে অপমান নয় বরং জাত্যাভিমানের জায়গায় দেখার অভ্যাস করাটাই আজাদের ক্ষেত্রে অস্ত্র।
আরও পড়ুন- উত্তরপ্রদেশে যোগী বনাম রাবণ, কে এই দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ?

২০১৬ সালের ২১ জুলাই প্রথম ভীমআর্মির জন্ম হয়, চন্দ্রশেখরের দল আম্বেদকরের নামেই গড়ে ওঠে। দলিত অধিকার রক্ষায় সতীশ কুমার, বিজয় রতন সিং আর চন্দ্রশেখর আজাদের ভীম আর্মি পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মীরাট, সাহারানপুর, শামলি, মুজফফরনগর জুড়ে দলিতদের শিক্ষার জন্য ৩৫০ টি অবৈতনিক স্কুল চালায়। বহুজনদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার জন্য শিক্ষা মৌলিক অধিকারকে সর্বতোভাবে নিশ্চিত করা এবং সরাসরি মাঠে নেমে প্রতিবাদই ভীম আর্মির পথ। আর চন্দ্রশেখরের পথে কখনও এসে দাঁড়ায় শান্তি, কখনও এসে দাঁড়ায় বাবাসাহেবের আদর্শ। প্রথম থেকেই চন্দ্রশেখর বলে এসেছেন, “ব্যক্তি বড়া নেহি হোতা, পার্টি বড়ি হোতি হ্যায়, সংগঠন বড়া হোতা হ্যায়”। সেই চন্দ্রশেখরই তাই গুলি খেয়েও আবেদন রেখেছেন শান্তির।
আসলে চন্দ্রশেখর জানেন, ব্যক্তি বড় নয় বললেও ভারতীয় রাজনীতি চিরকালই ‘আইকন’মুখী। গান্ধীজির হাঁটুর উপর ধুতি আর খালি গায়ের ইমেজ এখানে পূজিত, ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধা সুভাষের ইমেজ এখানে মানুষের স্বপ্ন, কাঁধ অবধি ছোট চুলে পাকা চুলের স্ট্রাইপ ইমেজ, সাদা ধুতি পাঞ্জাবীর ইমেজ অথবা সাদা শাড়ি আর চপ্পলের ইমেজে আসলে দল নয়, ব্যক্তিই আসল। নেতার ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দলকে বাঁচয়ে রাখে। চন্দ্রশেখর জানেন, তাঁর 'শান্তি বানায়ে রাখখে'-র মতো সাদামাটা কথার ওজন কতখানি। তিনি জানেন, উত্তরপ্রদেশে যোগী ও বিজেপির বুলডোজার শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে তাঁর এই একখানি কথাই যথেষ্ট।
আসলে চিরকাল পশ্চাতে রাখা হয়েছে যাদের, তাদের নিজস্ব গল্পরা উঠে আসতে শুরু করেছে ভারতবর্ষে। অন্তত বছর পনেরো আগেও এভিয়েটর সানগ্লাস পরা, সাদা কুর্তা, নীল পাগড়ি, মোচ পাকানো দলিত ‘হিরো’র কথা ভারতের প্রেক্ষিতে ভাবা সুসাধ্য ছিল না। উত্তরপ্রদেশে দলিত আইকন চন্দ্রশেখর আজাদের উত্থান দেশীয় রাজনীতি এবং দলিত অধিকারের লড়াইয়ে এক চমকপ্রদ মোড় অবশ্যই। চন্দ্রশেখরের গুলি খাওয়া আসলে দলিতদের আন্দোলনে সুবিধাই করবে, এমনটা ভাবলেও ভুল নয়।
পিছিয়ে পড়া শ্রেণির কথা বলতে হলে নিজেকে কতখানি এগিয়ে রাখতে হয় সেটা চন্দ্রশেখর নিজের নাম দিয়েই শুরু করেছেন। নিজেই নিজের নাম রেখেছেন ‘রাবণ’। ভারতের মহাকাব্যের পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ এবং নির্মিত খলনায়ককে নিজের সঙ্গে জুড়েছেন। রামের দেশে এবং রাজ্যে রাবণ হতে চাওয়ার মধ্যেকার দাপট শুধুই চমক তৈরি নয়। রাবণকে দলিত প্রতিনিধি করেছেন আজাদ যে রাজ্যে, মনে রাখতে হবে সেই উত্তরপ্রদেশেই ‘রাম কে নাম’ মসজিদ ভাঙা হয়, মাংসের ধর্ম নিয়ে পিটিয়ে মারা হয় অথবা ধর্ষণ করে জিভ কেটে নেওয়া হয় আজও। তাই দলিত সর্বহারাদের প্রতিনিধি হতে, খুব সুচিন্তিতভাবেই নিজের স্টাইলকে ক্ষমতা ও দাপটের সমতুল করেছেন পেশায় আইনজীবী, আম্বেদকর দীক্ষিত এই নেতা। বলেছেন, "ম্যায় উন লোগোকো রাজনৈতিক অধিকার দিলওয়ানা চাহতা হুঁ যিনহে হাজারো সালো সে নাকারা গ্যয়া হ্যায়।"

আরও পড়ুন- “দলিত এখন একটা ফ্যাশন”! আম্বেদকরের আর প্রয়োজন কোথায়?
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বারাণসী আসন থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন আজাদ। ঠিক তার পরের বছরই সংসদীয় রাজনীতিতে “বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়” লক্ষ্যে ভোটের লড়াইয়ে নামতে নিজের দল আজাদ সমাজ পার্টি তৈরি করেন চন্দ্রশেখর, ২০২০ সালের ১৫ মার্চ। সেই বছরই বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের সঙ্গী হয় আজাদ সমাজ পার্টি।
নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ারে উত্তরপ্রদেশের গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন চন্দ্রশেখর। গোরক্ষপুর আসন থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে আজাদ সমাজ পার্টির হয়ে লড়েন চন্দ্রশেখর। হারেন, স্বাভাবিকভাবেই। ৭,৫৪৩ ভোট পেয়ে চতুর্থ স্থানে ছিলেন আজাদ- বহুজন সমাজ পার্টির খাজা শামসুদ্দিন, সমাজবাদী পার্টির সুভাবতী শুক্লা এবং যোগী আদিত্যনাথের বহু পিছনে। ২০১৭ সালে সাহারানপুরে হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে গ্রেফতার হন চন্দ্রশেখর আজাদ। ২০১৮ সালে এক বছরের খানিক বেশি সময় পরে জেল থেকে ছাড়া পান আজাদ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে একটি মিছিলে হিংসার উস্কানির অভিযোগে দিল্লি পুলিশ গ্রেফতার করে আজাদকে। হাথরাসে দলিত তরুণী মনীষা বাল্মিকীর গণধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আবারও গ্রেফতার হয়েছেন চন্দ্রশেখর। তাঁকে নিজের ঘরে নজরবন্দি করেই খোলা মাঠে মাঝরাতে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় মনীষার মৃতদেহ। অর্থাৎ নজরবন্দি করা হোক বা গ্রেফতার বা গুলি- চন্দ্রশেখর ঠিক কাদের নজরে কাঁটা হয়ে উঠেছেন বলার অপেক্ষা রাখে না।
রাজনীতিতে একেবারেই তরুণ হয়েও তাই এমন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন চন্দ্রশেখর আজাদ। চন্দ্রশেখর আজাদের উত্থানে দলিতরা নিজেদের উত্থানের স্বপ্ন দেখেছে। যদিও, এই দেশে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্ভবত আম্বেদকরেরও অজানাই।

Whatsapp
