সুতোয় ঝুলছে চাকরি, ChatGPT-এআইয়ের ধাক্কায় কাজ হারিয়ে পথে বসতে পারেন আপনিও!
ChatGPT AI Job Loss : এমনিতে এখন চাকরির জগতের অবস্থা ভালো নয়। খরচ কমানোর জন্য বিভিন্ন পন্থা খুঁজছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি...
২৪ জানুয়ারি, ২০২৩। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ সংবাদমাধ্যমে একটি কলাম লেখেন জনৈক হেনরি উইলিয়ামস নামের এক ব্যক্তি। পেশায় তিনি কপিরাইটার। সেখানে তিনি একটি বিশেষ ঘটনা দিয়ে শুরু করেন। ‘পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যাপারটা কী?’ – এই বিষয়ের ওপর একটি নিবন্ধ লেখার পরীক্ষা করেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স না এআই তো সব কাজ করে দিচ্ছে। চ্যাটজিপিটি-র (ChatGPT) মতো এআই চ্যাট বট এখন রীতিমতো ট্রেন্ডিং। সত্যিই কি ঠিকঠাক কাজ করে এই এআই চ্যাট বটগুলি? সেটাই পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন হেনরি উইলিয়ামস।
ফলাফল? মোটামুটি ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে চ্যাটজিপিটি গোটা একটা নিবন্ধ তৈরি করে ফেলল ‘পেমেন্ট গেটওয়ে’ নিয়ে! সেখানে ব্যাকরণগত বিষয়, বাক্য গঠন, সমস্তটাই একেবারে নিখুঁত! সামান্য একটু ঘষামাজা করলে রীতিমতো ঝকঝকে একটা লেখা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় সেটি। আর এই ঘটনাটাই ‘গার্ডিয়ান’-এর সেই লেখাটার মূল বিষয়। আনন্দ নয়, এই ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছেন হেনরি উইলিয়ামসের মতো বহু কপিরাইটার। এক ঘণ্টায় তিনি যতগুলো লেখা লিখবেন, ওই একই সময় চ্যাটজিপিটি-র মতো এআই প্ল্যাটফর্ম তার কয়েকগুণ বেশি লেখা লিখে দেবে। হেনরি উইলিয়ামস বলছেন, একটা লেখা লিখলে তাঁর পারিশ্রমিক থাকে ৫০০ ইউরো। সেখানে সেই লেখাটাই বিনামূল্যে লিখে দিচ্ছে এআই। তাহলে ভবিষ্যতে আদৌ কি চাকরিটা থাকবে?
একা হেনরিই নন, গোটা পৃথিবী জুড়ে এই একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। তার আগে একবার জেনে জেওয়া যাক এই চ্যাটজিপিটি আসলে কী? অন্যান্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই চ্যাট বটের মতোই কাজ করে চ্যাটজিপিটি। এর পুরো নাম চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেনড ট্রান্সফর্মার (Chat Generative Pre-trained Transformer)। মেসেজের মতোই লিখিত আকারে এই চ্যাট বটের সঙ্গে কথা বলা যায়। সেখানে যেভাবে, যা জানতে চাওয়া হয়, সেভাবেই উত্তর দেয় চ্যাটজিপিটি। আমেরিকার সান ফ্রান্সিস্কোর 'OpenAI' নামের একটি সংস্থা এটি তৈরি করে। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বয়ং ইলন মাস্ক! এখন অবশ্য বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেছেন তিনি। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে চ্যাটজিপিটি বাজারে আসে। তারপরই সমস্ত কর্পোরেট বাজারে নজর কাড়ে এই বিশেষ প্রযুক্তি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনও অবধি যতগুলো চ্যাটবট তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে সবথেকে কার্যকর হল এই চ্যাটজিপিটি। একেবারে সরাসরি, নিখুঁতভাবে উত্তরগুলি মানুষের সামনে রাখে এই এআই প্রযুক্তি। মানুষের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন করার ক্ষমতা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অনায়াসে বিভিন্ন জিনিস লেখা, কাজ করার ক্ষমতা। বই লেখা, কোডিং করা, কভার লেটার, আইনি কাজ করা – সমস্তটাই চোখের নিমেষে করে ফেলছে এই এআই চ্যাট বট। এমনকী, তার কোনও উত্তর পছন্দ না হলে, সেটা জানালে ফের নতুন করে পুরোটা লিখে দেবে।
আরও পড়ুন : ‘চাকরি থাকবে তো?’ এই চিন্তায় বারোটা বাজছে কিডনির! চাপের মধ্যেও কীভাবে সুস্থ থাকবেন
ইতিমধ্যেই যারা ব্যবহার করেছেন, তাঁরা রীতিমতো মুগ্ধ চ্যাটজিপিটি নিয়ে। কোনও খাটনি ছাড়াই এত সহজে কাজ হয়ে যাচ্ছে, এটা তো সবাই চায়। কিন্তু এখানেই প্রমাদ গুনছে বেশকিছু কর্মক্ষেত্র। এভাবে, প্রায় বিনা পয়সায় যদি এত ভালো কাজ করা যায়, তাহলে তো বাজার সেই দিকেই ঝুঁকবে। ফলে ঘা পড়বে চাকরির জগতে। এমনিতে এখন চাকরির জগতের অবস্থা ভালো নয়। খরচ কমানোর জন্য বিভিন্ন পন্থা খুঁজছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি। সেই কাজে অনেক সুবিধা করতে পারে চ্যাটজিপিটি। কারণ এই প্রযুক্তি থাকলে মানুষের জায়গাটি অনেক কমে যাবে। যেখানে আগে ২০-২৫ জনকে নিয়ে কাজ হতো, সেটি কমে যাবে ৩-৫ জনে। চ্যাটজিপিটি আরও উন্নত হয়ে উঠলে, এবং এর মতো আরও এআই সফটওয়্যার বাজারে চলে এলে মানুষের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।
আর এখানেই ভয় পাচ্ছে সবাই। প্রযুক্তি এসে আখেরে মানুষেরই ক্ষতি করবে না তো? এটাই এখন প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চ্যাটজিপিটি-র মতো এআই প্রযুক্তির চ্যাট বটের ব্যবহার যদি বাড়ে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বেশকিছু সেক্টর বিপদে পড়বে। কোন কোন কাজের জায়গা খাদের ধারে দাঁড়িয়ে, একবার দেখে নেওয়া যাক।
প্রযুক্তি বা সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি
চ্যাটজিপিটি-র মতো উন্নত প্রযুক্তি এসে প্রথমেই খেয়ে নিতে পারে অন্যান্য প্রযুক্তিবিদ, কম্পিউটার প্রোগ্রামারদের। কারণ দেখা গিয়েছে, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, কোডিং, ডেটা অ্যানালিসিসের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ভালো কাজ করছে চ্যাটজিপিটি। এআই-কে হাতিয়ার করে সে চোখের নিমেশেই কাজ সম্পন্ন করছে। যদিও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, প্রযুক্তির এই বাজারে কাজের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এআই গ্রাস করলে হয়তো কর্মীদের সংখ্যা কমতে পারে। কারণ এই ভাবনা ইতিমধ্যেই কর্পোরেট জগতে খেলতে শুরু করে দিয়েছে।
আরও পড়ুন : চাকরি নেই, টিকা নেই, বেহাল জনজীবন! জিরো কোভিডের লক্ষ্যে কোন ফাঁড়া ডেকে আনল চিন?
মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি, বিজ্ঞাপন সংস্থা এবং সাংবাদিকতা
‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর লেখায় ঠিক এই জায়গাটিই ধরেছেন হেনরি উইলিয়ামস। সাংবাদিকতা, কপি রাইটিং, মিডিয়া জগতে কাজের পরিধি অনেক ব্যাপক। কনটেন্ট তৈরির কাজেও এআই চ্যাটজিপিটি যে সমান কার্যকর, সেটা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। ইতিমধ্যেই সি-নেট, বাজফিডের মতো মিডিয়া কোম্পানি চ্যাটজিপিটির দিকে সরে যাওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছে। কিন্তু সংবাদ জগতের একাংশের মতে, এআই এলেও পুরোপুরি গ্রাস করতে পারবে না এই জগতকে। কারণ এই ধরনের সৃষ্টিশীল জগতে ‘হিউম্যান টাচ’ থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। যেটা এখনও কোনও কৃত্রিম প্রযুক্তি তৈরি করতে পারেনি। তাই পুরোপুরি হয়তো এআই গ্রাস করে নেবে না।
আইনি কাজকর্ম
ইতিমধ্যেই বিশ্বের প্রথম রোবট বা এআই চ্যাটবট উকিলকে দেখে নিয়েছে সবাই। ‘ডু নট পে (DoNotPay)’-র সৌজন্যে বহুদিন ধরেই চ্যাট বটের মাধ্যমে আইনি নোটিশ তৈরি করা, আইনি পরামর্শ দেওয়ার কাজ করা হচ্ছে। সেই কাজে বেশ সফলও হয়েছে এই প্রযুক্তি। কাজেই আইনি কাজকর্মেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝড় এলে আশ্চর্য হওয়ার নয়। আইনের মারপ্যাঁচের অনেক ক্ষেত্রেই এআই খুব ভালোভাবে কাজ করছে।
শিক্ষক
লকডাউনের সময় গোটা বিশ্ব দেখে নিয়েছে অনলাইন পড়াশোনা। যুগ যুগ ধরে শিক্ষক শিক্ষিকারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে তৈরি করার কাজ করেন। সমাজে বদল আনেন। চ্যাটজিপিটি আসার পর সেই শিক্ষকদের কাজই বিপদে পড়েছে! বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই চ্যাটজিপিটি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই বিশেষ প্রযুক্তি বেশ ভালোভাবেই পড়ুয়াদের পড়ানো, হোমওয়ার্ক দেওয়ার কাজ করছে।
আরও পড়ুন : প্রতিদিন ছাঁটাই হচ্ছেন ১৬০০ জন! ফের প্রশ্নের মুখে ভারতের লাখো প্রযুক্তি কর্মীর ভবিষ্যৎ
ট্রেডার বা ব্যবসায়ী
ওয়াল স্ট্রিট, দালাল স্ট্রিটের মতো জায়গাগুলির নাম এলেই ব্যবসায়ীদের কথা মাথায় আসে। এবার সেই মার্কেটের ছবিটাই বদলে দিতে পারে এআই প্রযুক্তি। যে কোনও ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের কাজ হোক, বা ব্যবসার খাতা বজায় রাখা, অডিটিং –সমস্ত কাজটাই খুব ভালোভাবে করে ফেলছে চ্যাটজিপিটি। ফলে মানুষের কাজের জায়গায় কালো ছায়া নেমে আসছে।
গ্রাফিক ডিজাইনার
বিগত কয়েক মাসে এআই মাধ্যমে তৈরি ছবির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কলকাতায় বরফ পড়া থেকে ভারতের প্রাচীন কালের রাজা-রাজড়াদের সঠিক ছবি তৈরি – সবেতেই নিজের জাদু দেখিয়েছে এআই। আর এখানেই প্রমাণ গুনছেন অজস্র গ্রাফিক ডিজাইনাররা। হার্ভার্ডের বিজনেস রিভিউয়ের রিপোর্ট বলছে, DALL-E নামের একটি বিশেষ এআই সফটওয়্যার নাকি বাজারে এসেছে। এটি কয়েক সেকেন্ডে নিজের মনের মতো ছবি তৈরি করে দিতে পারবে। আর এর ফলেই গ্রাফিক ডিজাইনাররা বিপদে পড়তে পারেন।
এছাড়াও আরও বেশকিছু কাজের জগত রয়েছে, যেখানে হানা দিতে পারে এআই। সংকটের জায়গা এটাই, কর্পোরেট বাজার একটু একটু করে এআই, চ্যাটজিপিটির দিকেই ঝুঁকছে। হয়তো হাতে গোনা কয়েক বছরের মধ্যেই সেদিকে চলে যাবেন অনেকে। তখন কী হবে? যদিও বিশেষজ্ঞরা আরও একটা ব্যাপারে ইঙ্গিত করেছেন। চ্যাটজিপিটির বেশকিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন,
১) চ্যাটজিপিটি ইংরেজি ভাষাতেই আপাতত তার কাজ চালাচ্ছে। বাকি ভাষাগুলি পারে না।
২) চ্যাটজিপিটির কাছে বিশাল তথ্যভাণ্ডার নেই। যেখানে ও তথ্য পায় না, সেখানে ও সেই তথ্য বানিয়ে লিখে দেয়। যেটা পরে কোনও সংস্থার কাজে বিশাল বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষজ্ঞদের মতামত, এই মূল সমস্যার জন্য হয়তো অনেকেই সরাসরি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করবেন না।
৩) একটা প্রোডাক্ট এত মানুষের কাছে প্রায় বিনামূল্যেই দেওয়া হচ্ছে। সেটা 'ওপেনএআই'-র মতো সংস্থা কতদিন বজায় রাখতে পারবে, সেটাও একটা প্রশ্ন।
৪) চ্যাটজিপিটি-কে কোনও বিষয় দিলে সে অল্প সময়ের মধ্যেই সবটা লিখে দিচ্ছে। এর ফলে কপিরাইট ইস্যুও সামনে আসছে। চ্যাটজিপিটি যা লিখছে, তা কি একেবারেই নিজস্ব সৃষ্টি? কপিরাইটের সমস্যা কি কখনই হবে না সেখানে? এই প্রশ্নটির কোনও সঠিক, ভরসাযোগ্য উত্তর নেই। কপিরাইটের ইস্যু থাকতে পারে চ্যাটজিপিটি-তে। আর থাকলে, সেটা অন্যতম বড় সমস্যা।