৮ কোটি শিশু বিপন্ন, ৩০ টি দেশ আক্রান্ত! করোনার পরে মহামারী হয়ে ফিরছে কলেরা?

Cholera Pandemic: টিকাকরণ কর্মসূচি ব্যাহত হওয়ায় যে সব রোগ হারিয়ে গিয়েছিল সেগুলি আবার ফিরে আসার উপক্রম হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৮ কোটি শিশুর জীবন বিপন্ন।

করোনা অতিমারীর থেকে স্বস্তি মিলেছে ঠিকই কিন্তু কিছুতেই যেন দুঃসময় কাটছে না। বিশ্বের একাধিক দেশে কলেরায় আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ক্যারিবিয়ান দেশ হাইতিতে পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাইতিতে সেপ্টেম্বরের শেষ এবং অক্টোবরের শুরু থেকে কলেরায় আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে শুর করে। ফলে সে দেশের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যথেষ্ট বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। তবে শুধু হাইতি নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও করোনার সময় নিয়মিত টিকাকরণের প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে।

হাইতিয়ান জনস্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে , ৭ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬০০ নাগরিক কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া আরও ৬৫০০ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে হাইতি প্রশাসন। দেশে নতুনভাবে কলেরার উত্থানে অতীতের ভয়াবহ স্মৃতি ফিরে এসেছে দেশবাসীর। এর আগে ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি হাইতিয়ান মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তবে নতুনভাবে কলেরার আবির্ভাব শুধুমাত্র হাইতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। লেবাননেও কলেরায় আক্রান্তের খোঁজ মিলছে এবং দেশের পরিস্থিতি আরও সংকটজনক হয়ে উঠতে পারে বলেই মত লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের। এমনকী এই দুই দেশ ছাড়া কেনিয়াতেও কলেরা আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন- শুধু মহারাষ্ট্রেই আক্রান্ত প্রায় হাজার, পরবর্তী মহামারীর আশঙ্কা তৈরি করছে এই ভয়াবহ হাম?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি দেশে কলেরার প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গেছে , যা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত পাঁচ বছরে প্রায় কুড়িটি দেশে কলেরার প্রাদুর্ভাবের রিপোর্ট সামনে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বে কলোরা আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ উর্ধ্বমুখী এবং আরও বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই রোগ ছড়িয়ে পড়া সম্ভবনাও রয়েছে।

ভিব্রিও কোলেরি নামক ব্যাকটেরিয়া কলেরা রোগের জন্য দায়ী। এই ব্যাকটেরিয়া প্রধানত জল ও খাবারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং আক্রান্ত রোগী মারাত্মক ডায়ারিয়ায় ভোগে। প্রতি বছরে প্রায় ২০ হাজার থেকে দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী এই রোগ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব বিশ্বের বহু দেশে এই রোগের বিস্তারে অনুঘটক রূপে কাজ করেছে।

অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে কলেরায় আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভ্যাকসিনের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ভিব্রিও কোলেরি ব্যাকটেরিয়ার অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত স্ট্রেনকে নিষ্ক্রিয়ভাবে ব্যবহার করে প্রস্তুত হয়েছে কলেরার ভ্যাকসিন। ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে অনুমোদন দেওয়া হয় এই ভ্যাকসিনের। এরপর জরুরি ব্যবহারের জন্য লক্ষাধিক ডোজ প্রস্তুত করা হয়। সর্বোপরি ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে কলেরা নির্মূল করার লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে হু। কলেরা মুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে হু-এর মূল মন্ত্র ব্যাপক সংখ্যায় টিকাকরণ, যা করোনা পরিস্থিতিতে ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। টিকার দুটো ডোজের অভাবে বর্তমানে বেশিরভাগ দেশে একটি করেই ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডেভিড স্যাক এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, দ্বিতীয় ডোজ বাতিলের বদলে দুটো ডোজের মধ্যে ব্যবধান বাড়িয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। দুই সপ্তাহের বদলে এক বছরের ব্যবধানে টিকা প্রদানের পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন- যৌন সংসর্গে সংক্রমণ, কতটা কার্যকর এই মারণ ভাইরাসের ভারতে তৈরি ভ্যাকসিন?

হু-এর কলেরা এবং ডায়রিয়া রোগ বিভাগের প্রধান ফিলিপ বারবোঝার মতে, সংকট মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল টিকাকরণ। তবে শীঘ্রই প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডোজের জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। ফিলিপ আরও জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চরম আবহাওয়ার কারণে এই রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনা অতিমারী পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর করে তুলেছে বলে মেনে নিয়েছেন বাড়বো যা। ২০২১ সালে আফ্রিকায় কলেরা রোগে মৃত্যুর হার ছিল প্রায় তিন শতাংশ যা আগের পাঁচ বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি। প্রয়োজন মতো স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে বিলম্ব হওয়ার ফলেই কলেরায় মৃত্যুর হার বাড়ছে।

তবে শুধু হাইতির কলেরা নয়, ভারতেও করোনা পরিস্থিতিতে টিকাকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় শিশুদের জীবনের ঝুঁকি বেড়েছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় অশনি সংকেত দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনস্থ ইউনিসেফ সংস্থা। জানিয়েছে, টিকাকরণ কর্মসূচি ব্যাহত হওয়ায় যে সব রোগ হারিয়ে গিয়েছিল সেগুলি আবার ফিরে আসার উপক্রম হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৮ কোটি শিশুর জীবন বিপন্ন। এশিয়ার যে দেশগুলির পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক ভারত তার মধ্যে অন্যতম। ইউনিসেফের আশঙ্কা, বিশ্বের অন্তত ৮ কোটি শিশু কলেরা, হাম, ডিপথেরিয়া, রুবেলা, পোলিওর মতো রোগে আক্রান্ত হবে। হু এবং ইউনিসেফের যৌথ সমীক্ষায় জানা গেছে ভারত সহ ২৭ টি দেশে হামের টিকাকরণ বন্ধ রয়েছে। শিশুর জন্মের পর থেকে দেড় বছরের মধ্যে কলেরা, হাম, রুবেলা, ডিপথেরিয়ার মতো রোগের টিকা দিতে হয়, যা এই সংক্রামক রোগ নির্মূল করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তবে স্বাস্থ্য দপ্তর এ ব্যাপারে বিভিন্ন রাজ্যকে সতর্ক করে কড়া নির্দেশিকা দিয়ে টিকাকরণ চালু করার পরামর্শ দিয়েছে।

More Articles