৮ সেপ্টেম্বর দিনটিকে কেন বেছে নেওয়া হলো নেতাজির মূর্তি উন্মোচনের জন্য? তুঙ্গে বিতর্ক
Netaji: কেন ৮ সেপ্টেম্বর বেছে নেওয়া হলো নেতাজির মূর্তি উন্মোচনের জন্য, প্রশ্ন বসু পরিবারের।
৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ইন্ডিয়া গেটে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একটি মূর্তি উন্মোচন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জেট ব্ল্যাক গ্রানাইট মূর্তিটি দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের পূর্ব দিকে গ্র্যান্ড ক্যানোপির নিচে উন্মোচিত হয়। ৭ তারিখ মূর্তিটি বসানো হয়েছে।
২৮ ফুট লম্বা। দোতলা বাড়ির চেয়েও উঁচু। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি ভারতের অন্যান্য স্মারক মূর্তির মান অনুযায়ী এটি বেশ ছোট। যেমন, স্ট্যাচু অফ ইউনিটি-ই তো প্রায় ৬০০ ফুট লম্বা। কিন্তু, গ্র্যান্ড ক্যানোপির উচ্চতার জন্য এই মূর্তির আকারও সীমিত করতে হয়েছে।
নেতাজির মূর্তি উন্মোচনের জন্য ছাউনিতে প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী শঙ্খ ভাদায়ম এবং কেরলের ঐতিহ্যবাহী পঞ্চ ভাদ্যম এবং চন্দের মাধ্যমে ঘোষণা হয়। মূর্তিটির উন্মোচনের সঙ্গে চলতে থাকে, ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’। এই গান নেতাজির ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর গান। দেশের সমস্ত প্রান্ত থেকে ৫০০ জন নৃত্যশিল্পী একটি সাংস্কৃতিক উৎসব প্রদর্শন করেন কর্তব্য পথ-এ বা পূর্ববর্তী রাজপথে। ১৯৪৭ সালে প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পণ্ডিত কৃষ্ণরতন জঙ্করজির লেখা মঙ্গলগান উপস্থাপন করেন পণ্ডিত সুহাস বশী ও তাঁর সম্প্রদায়। অর্থাৎ, এককথায় অঢেল আয়োজন। দেশ স্বাধীনতার মহোৎসব পালন করছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে নেতাজিকে স্মরণ করে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা মন্দ কী!
আরও পড়ুন: অধীন থেকেই স্বাধীন! নেতাজির দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়েছিল গান্ধী-নেহরুর হাত ধরে?
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত ঘটা করে নেতাজির মূর্তি উন্মোচনের জন্য এই ৮ সেপ্টেম্বর দিনটাকে বেছে নিল কেন মোদি সরকার? নেতাজির জন্ম এবং কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এই দিনটার কী সম্পর্ক? এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ বসু পরিবার। তাঁরা এই অনুষ্ঠান বয়কটের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন আগেই। শুধু দিনটা নিয়ে নয়, বসু পরিবার তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো নিয়েও আপত্তি জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী নন, আমন্ত্রণ গিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রকের যুগ্মসচিব লিলি পান্ডিয়ার পক্ষ থেকে। যা দায়সারা বলেই মন্তব্য করেছে বসু পরিবার। তাই আমন্ত্রণ পেলেও এই অনুষ্ঠান বয়কট করছেন নেতাজি পরিবারের সদস্যরা। আগেই জানানো হয়েছিল, জার্মানি থেকে আসছেন না অনিতা পাফও। আগেই ফোনে তিনি জানিয়েছেন, "আমি আশ্চর্য। ৮ সেপ্টেম্বরের সঙ্গে নেতাজির কী সম্পর্ক, সেটাই বুঝতে পারছি না।" ওইদিন মূর্তি উদ্বোধন করার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন বসু পরিবারের অন্যতম সদস্য তথা নেতাজির দৌহিত্র চন্দ্রকুমার বসুও। পরিবারের মতে, দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কোনও পুতুল নন যে, কোনও জায়গার সৌন্দর্যায়নে তাঁর মূর্তি বসিয়ে দিলেই হলো। দিনক্ষণ দেখেই আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনানায়ককে সম্মান দেওয়া উচিত। সেই মতো ২১ অক্টোবর এই অনুষ্ঠান করা যেত বলেও পরামর্শ দিয়েছিল বসু পরিবার। কারণ, ১৯৪৩ সালের এই দিনেই আজাদ হিন্দ সরকার গঠন হয়েছিল। নয়তো, নেতাজির জন্মদিন ২৩ জানুয়ারি। এবার যার ১২৫ বছর। অন্যদিকে, আজাদ হিন্দ সরকারেরও ৮০ বছর হতে চলেছে। এর কোনওটিকে না বেছে আচমকা তাৎপর্যহীনভাবে ৮ সেপ্টেম্বর তারিখ বেছে নেওয়ায় প্রবল ক্ষুব্ধ বসু পরিবার। তাই কেন্দ্রের তৈরি ‘নেতাজি:১২৫’ উচ্চ পর্যায়ের কমিটির অন্যতম সদস্য হওয়া এবং গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও চন্দ্রকুমার বসু সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে ক্ষোভ ব্যক্ত করেছিলেন। ৮ সেপ্টেম্বর তারিখটি বাতিলের জন্য কথা বলেছিলেন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি সচিব গোবিন্দ মোহনের সঙ্গেও। তবে কিছুতেই কোনও লাভ হয়নি। তাই এই বয়কটের সিদ্ধান্ত।
প্রতি বছর ২১ অক্টোবর দেশজুড়ে আজাদ হিন্দ সরকারের প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপন করা হয়। ওই দিন ভারতের প্রথম স্বাধীন অস্থায়ী সরকার আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৪২-এ আজাদ হিন্দ ফৌজ (আইএনএ) গঠিত হয়েছিল। এর নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর নেতাজি-র নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আজাদ হিন্দ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় জাপান, ক্রোয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জার্মানি, ইতালি ও বার্মার মতো আরও কয়েকটি দেশ। ১৯৪৩-এ ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বোচ্চ সেনাপতি হিসেবে স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার গঠন করেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
আজাদ হিন্দ সরকারের ছিল নিজস্ব ব্যাঙ্কও। এর নাম ছিল আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক। এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৪৩-এ। এই ব্যাঙ্কের ১০ টাকার কয়েন থেকে শুরু করে এক লক্ষ টাকার নোটও ছিল। এক লক্ষ টাকার নোটে ছিল সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি। এই সরকারের ছিল নিজস্ব ডাক টিকিট ও তিরঙ্গা পতাকা। আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের মাহেন্দ্রক্ষণে কেন নেতাজির মূর্তি উন্মোচনের এই বিশেষ আয়োজন করা হলো না?
১৮৯৭-এর ২৩ জানুয়ারি কটকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। স্বল্প কিছু সময়ের জন্য তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত সুভাষচন্দ্র বসু সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কাজ করা একেবারেই পছন্দ ছিল না স্বাধীনচেতা সুভাষচন্দ্র বসুর। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। কালক্রমে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৩৮-এ জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত হন তিনি। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী ও দলের হাই কমান্ডের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে তিনি সভাপতি পদে ইস্তফা দেন। তিনি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে চেয়েছিলেন। ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে সিঙ্গাপুরে ১৯৪২-এ প্রথম আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠিত হয়। পরে তা ভেঙে যায়। সুভাষচন্দ্র বসু দক্ষিণ এশিয়ার বসবাসকারী ভারতীয়দের সাহায্যে আবার আইএনএ গঠন করেন এবং এই বাহিনীর নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন।
১৯৪৪-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের কোহিমা ও ইম্ফলের কাছে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছিল। আজাদ হিন্দ সরকার জাপানের কাছ থেকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিকারও অর্জন করেছিল। এই সরকারের ছিল নিজস্ব মুদ্রা, বিচার ব্যবস্থা ও দণ্ডবিধি। আজাদ হিন্দ বাহিনীর গঠন হয়েছিল জাপানে। আজাদ হিন্দ ফৌজে সাড়ে আট হাজার সেনা ছিলেন। এতে মহিলাদের একটি ইউনিটও ছিল।
এই আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের দিন এবং মহান দেশনায়কের জন্মদিন- কিছুই চোখে পড়ল না মোদি সরকারের? আদতে তাৎপর্যহীন হয়ে রইল ৮ সেপ্টেম্বর।