কালীর ধূমপান! কেন বারবার ধর্মীয় ভাবাবেগ নিয়ে দানা বাঁধছে বিতর্ক?
'কালী’ নামক একটি তথ্যচিত্রের পোস্টার নিয়ে তুমুল বিতর্ক। চলচ্চিত্রকার লীনা মনিমেকলেই ২ জুলাই ট্যুইটারে এই পোস্টার শেয়ার করেন। তারপর এই নিয়ে উত্তাল হয় দেশ। কী আছে এতে?
কখনও হিন্দু, কখনও মুসলিম। কখনও পয়গম্বর, কখনও মা কালী। দেশের হাওয়া বারবার গরম হচ্ছে ধর্মকে কেন্দ্র করে। কিছুদিন আগেই নুপুর শর্মার পয়গম্বর মন্তব্য নিয়ে দেশে আগুন জ্বলেছে, শিরশ্ছেদ হয়েছে এক দর্জির। সেই সময় বারবার প্রশ্ন উঠেছে, মুসলমানদের ভাবাবেগে আঘাত করা নিয়ে। এবার আবার হিন্দুদের ভাবাবেগের প্রশ্ন। মা কালীকে নিয়ে হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা লীনা মনিমেকলেই, এমনই অভিযোগ। মা কালীর মুখে সিগারেট, এমন একটি ছবি তিনি দিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। আবার এই বিতর্কে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। এফআইআর হয়েছে পরিচালকের বিরুদ্ধে।
কেন বিতর্ক
'কালী’ নামক একটি তথ্যচিত্রের পোস্টার নিয়ে তুমুল বিতর্ক। চলচ্চিত্রকার লীনা মনিমেকলেই ২ জুলাই ট্যুইটারে এই পোস্টার শেয়ার করেন। তারপর এই নিয়ে উত্তাল হয় দেশ। কী আছে এতে?
'কালী' ছবির পোস্টারে মা কালীর মুখে সিগারেট দেখা যাচ্ছে। পিছনে এলজিবিটিকিউ, অর্থাৎ সমপ্রেম ও রূপান্তরকামীদের আত্মাভিমানের পতাকা। ইতিমধ্যে পরিচালকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে দিল্লি পুলিশ ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। গো মহাসভার অজয় গৌতম আলাদা করে অভিযোগ দায়ের করেছেন। ছবিটি নিষিদ্ধ করার দাবিও উঠেছে।
আরও পড়ুন: ধূমধাম করে প্রথম সমকামী পুরুষের বিয়ে, কলকাতা সাবালক হল?
এফআইআর-এর স্ক্রিনশট শেয়ার করে এক সংবাদ সংস্থা ট্যুইট করে, এফআইআর হয়েছে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, ধর্মকে অসম্মান, ধর্মীয় ভাবাবেগে ইচ্ছা করে আঘাত দেওয়া, শান্তি ভঙ্গ করার চেষ্টার অভিযোগ এনে।
লীনা মাদুরাইয়ের মেয়ে, যদিও থাকেন কানাডার টরেন্টোতে। কানাডা ফিল্ম ফেস্টেভ্যালে মুক্তি পায় তাঁর ডকুমেন্টারি `কালী’। আর সেই পোস্টার সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে লীনা লিখেছিলেন, আমি উচ্ছসিত। নর্থ আমেরিকায় থাকা ভারতীয় হাই কমিশন ইতিমধ্যেই কানাডা সরকারকে অনুরোধ করেছে, যাতে টরেন্টো বেস আগা খান মিউজিয়াম থেকে পোস্টারটি সরিয়ে ফেলা হয়। তবে এসবে ভীত নয় বলে জানিয়েছেন লীনা।
কে লীনা
লীনা হলেন মাদুরাইয়ের মহারাজাপুরমের বাসিন্দা। বাবা অধ্যাপক। অল্প বয়সে তাঁর বিয়ের পরিকল্পনা করে পরিবার। সেই সময় বাড়ি ছেড়ে চেন্নাইয়ে চলে যান তিনি। তখনই তাঁর আপসহীন চেহারা সামনে আসে। একটি তামিল ম্যাগাজিনে কাজে যোগ দেন। ওই ম্যাগাজিনের মালিক অবশ্য লীনার ঘটনা জেনে তাঁকে পরিবারের হাতে তুলে দেন। কিন্তু এরপরও তাঁর লড়াই থামে না। এবারও তিনি বিয়ে রুখে দেন। ভর্তি হন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে। এই সময় তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। পরিবারে নেমে আসে ঝড়। হাল ধরতে আইটি ফার্মে যোগ দেন লীনা। পরে সেই কাজ ছেড়ে নিজের মনের মতো কাজে যোগ দেন। শুরু হয় সিনেমা বানানো। ২০০২ সালে ছবি তৈরি করার স্বপ্ন সফল হয়। মুক্তি পায় তাঁর ছবি `মহাত্মা’।
এই তথ্যচিত্রে সমাজের অবহেলিত মানুষের কথা তুলে ধরেন লীনা। ছবিটি উচ্চ-প্রশংসিত হয়। আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অন্ত্যজ শ্রেণির জন্য কাজ করায় একাধিক ফেলোশিপ পান। তাঁর ছবি বহু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়। তবে বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি। কারণ তিনি লড়াইয়ের নামান্তর। ২০০৪ সালে পরবর্তী ছবি 'পারাই'। একজন দলিত মহিলার জীবন নিয়ে সেই ছবি। এই ছবি নিয়েও বিতর্ক হয়। ২০১১ সালে ধনুশকোডির জেলেদের দুর্দশা নিয়ে তাঁর প্রথম কাহিনিচিত্র `সেনগাদল’ তৈরি করেন। এই ছবির শীর্ষ চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি। সেই ছবি নিয়েও বিতর্ক হয়। কেন্দ্রীয় সেন্সর বোর্ড আপত্তি তোলে। পরে অবশ্য মুক্তি পায় ছবিটি। এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়।
তাহলে একথা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে, বিতর্ককে তিনি বারবার চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। `কালী’ ছবি নিয়েও লড়াকু মেজাজের পরিচালক নির্ভয়ে প্রতিক্রিয়া দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন, মৃত্যুকেও তিনি ভয় পান না। তাঁর কথায়, "আমার হারাবার কিছু নেই। আমি নির্ভয়ে কণ্ঠ ছাড়তে ভয় পাই না। যদি জীবন দিতে হয়, তখনও ভয় পাব না।‘’
মহুয়ার যুক্তি
মা কালীর পোস্টার বিতর্ক নিয়ে একাধিকবার মুখ খুললেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। পরিচালকের পক্ষেই ব্যাটন ধরেন মহুয়া। বলেন, "আমার কাছে মা কালী আমিষ ভক্ষণকারী এবং সুরাপানকারী এক দেবী। কে কীভাবে তাঁর আরাধ্য দেবতার ছবি আঁকবেন, এটা একেবারে তাঁর নিজস্ব বিষয়। ভারতের এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে দেবীকে হুইস্কি অর্পণ করে পুজো দেওয়া হয়। কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় ওই রীতিকে ধর্মীয় অনুশাসন-বিরোধী বলে মনে করা হয়।‘’
তাঁর মন্তব্য নিয়ে জলঘোলা হওয়ার পর আবার নিজের মন্তব্যের পক্ষে সাফাই দেন সাংসদ। বলেন, তিনি কখনও কোনও পোস্টার সমর্থন করেননি বা ধূমপান শব্দকেও সমর্থন করেননি। তিনি শুধু বলেছেন, তারাপীঠে মা কালীর মন্দিরে যান, দেখুন কীভাবে দেবীকে ভোগ এবং পানীয়র মাধ্যমে পুজো উৎসর্গ করা হয়।
বারবার কেন ধর্ম
বিতর্কের কেন্দ্রে যখন ধর্ম, তাতে যে অনেক রংচং চড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
পয়গম্বর নিয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ দেখেছে দেশ। এমনকী, এই মন্তব্য সমর্থন করে এক দর্জির শিরশ্ছেদের মতো পাশবিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছে দেশ। এবার ধর্ম পাল্টেছে। পাল্টায়নি বিতর্কের চরিত্র। প্রশ্ন হল, বারবার ধর্মই কেন? ধর্ম নিয়ে দেশ উত্তেজনায় ফুটলে যে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের মতো আরও অনেক জ্বলন্ত বিষয় থেকে দেশবাসীকে ভুলিয়ে রাখা যায়, এ আর কী এমন আশ্চর্যের! ফলে এর পিছনে অন্য কোনও অভিসন্ধি কাজ করছে না তো? এই নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ধর্মের অন্ধকূপে মুখ লুকোচ্ছে না তো এই সমাজ?