এখনও হয়নি যথেষ্ট টিকাকরণ, বিশ্বজুড়ে নখ শানাচ্ছে করোনা! আবার অতিমারী?

ভারত ছাড়াও যে-সমস্ত দেশে নতুন করে করোনা সংক্রমণের বিপদ বেড়েছে, সেই দেশগুলির তালিকায় ওপরের দিকে নাম রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইতালি এবং চিনের।


দুনিয়া থেকে কবে বিদায় নেবে কোভিড? এই প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। উপরন্তু গত ২৪ ঘণ্টায় সারা পৃথিবীতে করোনা-সংক্রমিত আরও ১,৪৮৩ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আবিশ্ব নতুন করে করোনা-আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন ৭ লক্ষ ৩০ হাজার ৮৩৮ জন নাগরিক। ওয়ার্ল্ডোমিটার নামে আন্তর্জাতিক সমীক্ষক সংস্থা সূত্রে উদ্বেগজনক এই তথ্য জানা গিয়েছে।

সমীক্ষা অনুসারে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে আবিশ্ব করোনা-আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ কোটি মানুষ। আর করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়ে এ-পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় মৃতের সংখ্যা ৬ কোটি ৩৫ লক্ষরও বেশি। ২০১৯ সালে মারণ করোনাভাইরাস চিন থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পর বিপর্যয় ছড়িয়েছে দুনিয়াজুড়ে। টানা দু'বছর করোনা সংক্রমণের জেরে মানুষের মৃত্যুমিছিলও ক্রমে ভয়াবহ চেহারা নেয়। এরপর ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কাজকর্মে খানিক গতি এলেও ফের বিপদ ঘনাচ্ছে।

করোনার বিপদ কাটেনি বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন করে সতর্কতা জারি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রস আধানম ঘেব্রেইসাস জানিয়েছেন, ১১০টি দেশে করোনা সংক্রমণ আবারও বাড়ছে। একই সঙ্গে করোনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আবিশ্ব করোনা-সংক্রমণ নতুন করে ২০ শতাংশ বেড়েছে।

আরও পড়ুন: পানীয় জলের বিষ চেনাবে অ্যাপ! যুগান্তকারী আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের

বারংবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনা সংক্রমণ রুখতে জরুরি ভিত্তিতে টিকাকরণ করা উচিত। আবিশ্ব অন্তত ৭০ শতাংশ নাগরিককে করোনার টিকা প্রদান করা হলে সংক্রমণ সেক্ষেত্রে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হবে। এছাড়া মাস্ক পরা, স্যানিটাইজার ব্যবহার কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাও উচিত।

কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্রই করোনাবিধি মেনে চলার ব্যাপারে নাগরিকদের মধ্যে শৈথিল্য দেখা দিচ্ছে। সতর্কতামূলক প্রচারেও কাজ হচ্ছে না তেমন। এমনকী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স-সহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির নাগরিকরা কোভিড বিধি অমান্য করে ইতিমধ্যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভেও শামিল।

এই আবহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করল অতিমারী পর্ব শেষ হয়েছে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। উদ্বেগ বাড়িয়ে করোনার বিএ.৪ এবং বিএ.৫ ভ্যারিয়েন্ট শতাধিক দেশে সংক্রমিত হতে শুরু করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রস আধানম ঘেব্রেইসাস সাংবাদিক সম্মেলন করে ফের করোনার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে নতুন কিছু তথ্য পেশ করেছেন। যেমন, মোটে ৫৮টি দেশের ৭০ শতাংশ নাগরিক এ-পর্যন্ত করোনার টিকা পেয়েছেন। বাকিদের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলির সরকার করোনা প্রতিরোধক টিকার ব্যবস্থাই করে উঠতে পারেনি। এই দেশগুলি নিম্ন আয়ের দেশ। আর করোনা প্রতিরোধক টিকা পাননি এখানকার বাসিন্দা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রবীণ নাগরিক।

এমনই একটি দেশ মধ্য আফ্রিকার রোয়ান্ডা। রোয়ান্ডাতে দ্বিতীয় দফায় করোনা প্রতিরোধক টিকাকরণের হার ৬৫ শতাংশ। এছাড়া নিম্ন আয়ের দেশগুলির মোটে ১৮ শতাংশ বাসিন্দা করোনা প্রতিরোধক টিকা পেয়েছেন। উচ্চ আয়ের দেশগুলিতে প্রথম দফার টিকা পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট দেশের ৮১ শতাংশ নাগরিক।

অন্যদিকে, প্রখ্যাত মার্কিন সংবাদপত্র দ‍্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুসারে, সারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৬৮.৮ শতাংশ করোনার প্রথম দফার টিকা পেয়েছেন। সেই হিসেবে করোনা প্রথম দফার টিকাকরণ সম্পন্ন হয়েছে ৫.২৩ বিলিয়ন মানুষের। দ‍্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এই সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের 'আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা' নামে একটি সমীক্ষাকে উদ্ধৃত করে।

আবিশ্ব নতুন করে যে হারে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে শিশু এবং অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা। এজন্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে সতর্ক হয়েছে, অতিমারী পরিস্থিতি বিলীন হয়নি। এদিকে আবিশ্ব এক-তৃতীয়াংশ মানুষই প্রথম দফার কোভিড টিকা পাননি। এঁদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ আফ্রিকার দেশগুলির বাসিন্দা। বিশ্বের অন্য অঞ্চলগুলির তুলনায় আফ্রিকাতেই টিকাকরণের গতি সবচেয়ে মন্থর।

ভারতেও করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে করোনা সংক্রমিত হয়েছেন আরও ১৮,৮১৯ জন। গত চার মাসের নিরিখে বর্তমানে ভারতে করোনা সংক্রমণের হার সর্বোচ্চ। একই সঙ্গে গত চার মাসের তুলনায় সক্রিয় করোনা রোগীর হারও সর্বোচ্চ। সক্রিয় করোনা রোগীর সংখ্যা এখন লক্ষাধিক। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে মৃত্যু হয়েছে ৩৯ জন সংক্রমিতের। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৯৮.৫৫ শতাংশ করোনা রোগী।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক আরও জানিয়েছে, করোনা প্রতিরোধক টিকাকরণের ওপরে জোর দেওয়া হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় টিকাপ্রদান করা হয়েছে ১৪ লক্ষ ১৭ হাজার ২১৭ জনকে।

তাও মহারাষ্ট্র, কেরল, কর্নাটক ও দিল্লিতে উদ্বেগজনকভাবে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। করোনা সংক্রমণের নিরিখে প্রথম স্থানাধিকারী রাজ্য মহারাষ্ট্র। মহারাষ্ট্রে করোনা সংক্রমিতর সর্বশেষ সংখ্যা চার হাজার ছুঁইছুঁই। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সরকারগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে, নাগরিকরা যাতে কোভিডবিধি মেনে চলেন, সে-ব্যাপারে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব রাজেশ ভূষণ চার রাজ্যের সরকারকে লিখিতভাবেই এই নির্দেশ দিয়েছেন।

বাস্তবে এও দেখা যাচ্ছে, বহু নাগরিকই করোনাবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাসীন। ফলে বিপদও বাড়ছে।

ভারত ছাড়াও যে-সমস্ত দেশে নতুন করে করোনা সংক্রমণের বিপদ বেড়েছে, সেই দেশগুলির তালিকায় ওপরের দিকে নাম রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইতালি এবং চিনের। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হলেও নাগরিকদের উদাসীনতার কারণে তাতে অনেক সময়েই লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন' মার্কিন নাগরিকদের আর্জি জানিয়েছে, তাঁরা যেন কোভিড সংক্রমণ এড়াতে ঘরে-বাইরে সর্বত্রই মাস্ক পরেন। চিন সরকারও সেদেশের নানা শহরে নতুন করে লকডাউন জারি করেছে লকডাউন প্রসঙ্গে নাগরিক অসন্তোষ সত্ত্বেও। অন্যদিকে, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে চালানো একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, করোনা পরীক্ষাতেও অনাগ্রহী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

ভারতে কোভিড সংক্রমণ বাড়লেও বিশেষজ্ঞরা আশ্বস্ত করেছেন, আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। এ-ব্যাপারে নয়া দিল্লির এইমসের ডিরেক্টর ডা. রণদীপ গুলেরিয়া বলেছেন, "ভারতে করোনা সংক্রমণ নির্দিষ্ট কিছু এলাকাতেই বাড়ছে। ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হবে নাগরিকরা কিছুটা সচেতন হলেই।"

More Articles