বাংলাকে তথ্য প্রযুক্তির দুয়ারে এনেছিলেন তিনিই! মানব মুখোপাধ্যায়কে কেন ভুলবে না রাজ্য

CPIM Manab Mukherjee Passes Away: বাম জমানার সুবক্তা, সুতার্কিক এবং দূরদর্শী মানব মুখোপাধ্যায় না থাকলে তথ্য প্রযুক্তি এ রাজ্যে আসন পেতে বসতই না।

মেশিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চেয়েছিলেন জন হেনরি। তারপর হাতুড়ির ঘায়ে ঘায়ে সময় পেরিয়ে, ইতিহাস পেরিয়ে ধীরে ধীরে মানুষই হয়ে উঠল যন্ত্রশ্রমিক। গতর খাটানোর শ্রমিকদের বঞ্চনার পাশে জুড়ে গেল মাথা খাটানো শ্রমিকদের দুর্দশাও। জুড়ে গেল দাবি দাওয়া, জুড়ে গেল অভাবও। মেশিন মানুষের চাকরি খাবে- এই সত্যের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়াল মেশিন চালানো মানুষ চাকরি পাবে। কর্ম যোগাবে যন্ত্রই, আর কর্মের সংস্থান ঘটাবে মানুষের নির্বাচিত দল, রাজনৈতিক দল। দীর্ঘদিন ধরে কম্পিউটারের বিরোধিতা করেও পরে এই সত্যেরই পাড়ে এসে দাঁড়ায় তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন বাম দল। তথ্য প্রযুক্তি শিল্প তখনও রাজ্যে পা রাখেনি। তার প্রায় দুই যুগ পর পশ্চিমবাংলায় চাকরির বড় লোভনীয় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে আইটি, দেশে বিদেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের সাক্ষী হবে মানুষ। যন্ত্রকে ভাষা জোগাতে মরিয়া হবে মানুষ। বাংলায় কর্মসংস্থানের মোড় ঘোরানো মানুষ ছিলেন মানব মুখোপাধ্যায়। বাম জমানার সুবক্তা, সুতার্কিক এবং দূরদর্শী মানব মুখোপাধ্যায় না থাকলে তথ্য প্রযুক্তি এ রাজ্যে আসন পেতে বসতই না। দীর্ঘ রোগভোগের পর, ২৯ নভেম্বর মঙ্গলবার সকালে প্রয়াত হয়েছেন তিনি।

স্ট্রোক হওয়ার পর মল্লিকবাজারের একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন মানব মুখোপাধ্যায়। বাম তাত্ত্বিক নেতা মানব সাতের দশকে মার্ক্সবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। ৮৭ সালে প্রথমবার বিধানসভা নির্বাচনে জিতে বিধায়ক হন। ১৯৯১ সালে বেলেঘাটা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম বার নির্বাচনে দাঁড়ান মানব, আর সেই বছরই বিধায়ক নির্বাচিত হন। ২০১১ সাল পর্যন্ত বেলেঘাটা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে টানা বিধায়ক ছিলেন তিনিই। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্ত্রিসভায় দুইবার মন্ত্রিত্ব সামলেছেন মানব মুখোপাধ্যায়। প্রথমবার তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী, পরের বার বাম সরকারের পর্যটন মন্ত্রী ছিলেন তিনি। মানব নিজের ৬৭ বছরের সফর সাঙ্গ করে চলে গেলেও, তাঁর এক অনন্য কৃতিত্বের স্বাদ বাংলা ভোগ করবে অনন্তকাল।

আরও পড়ুন- ‘ইন্সট্যান্ট’ বিপ্লব হয় না! বামেদের এখন যে পথে হাঁটতে হবে…

নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে বাংলায় না হলেও, দক্ষিণ ভারতের দুই স্তম্ভ বেঙ্গালুরু আর হায়দরাবাদে তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের রমরমা দেখা দিয়েছে। আজও ভারতের সেরা টেক হাব বলতে মানুষ এই দুই জায়গার নামই সর্বাগ্রে উচ্চারণ করেন। সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে তথ্য প্রযুক্তির সফর শুরু অনেকটাই দেরিতে। তবু, বাংলার উর্বর বাজারে আগ্রহ দেখিয়েছিল পৃথিবীর তাবড় সব তথ্য প্রযুক্তি সংস্থা। বাম আমলে তথ্য প্রযুক্তির হাত ধরে কলকাতায় তৈরি হয় প্রচুর কর্মসংস্থান, জলা জমি বিধাননগর, সল্টলেকের ভোল বদলে যায় রাতারাতি। সল্টলেক সেক্টর ফাইভ হয়ে ওঠে রাজ্যের টেক হাব। আর এখন! ঝাঁ চকচকে সল্টলেক কলকাতার মধ্যে অন্যই এক কলকাতা। অথচ, সফরের বয়স ২১ বছর। ২০০১ সালের আগে বাংলায় অস্তিত্বই ছিল না তথ্য প্রযুক্তি দফতরের। বাম আমলে ২০০১ সালেই তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী হন মানব। তারপর একের পর এক বিখ্যাত তথ্য প্রযুক্তি সংস্থা আগ্রহ দেখাতে শুরু করে বাংলায়।

 

তথ্য প্রযুক্তি মেধাভিত্তিক শিল্প। মানব নিজে ছিলেন বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ছাত্র। ফলে এই নয়ে শিল্পে মেধাশ্রমিকের অভাব বাংলায় অন্তত কখনই হবে না, জানতেন বাম নেতা। একে একে বাংলার জমিতে আসে উইপ্রো, ইনফোসিস, টিসিএস। আইবিএম, কগনিজ্যান্ট, ক্যাপজেমিনি, প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্সের মতো বিখ্যাত আইটি সংস্থা বাংলায় কর্মসংস্থানের ঝাঁপি খুলে দেয়। মানব মুখোপাধ্যায়ের পর, ২০০৬ সালে বাংলায় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী হয়েছিলেন দেবেশ দাস। তিনি বলেন, “মানব মুখোপাধ্যায় ২০০১ সালে তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী হন। এই বাংলায় তথ্য প্রযুক্তির অঙ্কুরোদ্গম শুরু হয় সেই সময়েই। নিউটাউনে ডিএলএফ বিল্ডিং মানব মুখোপাধ্যায়ের সময়েই তৈরি। তারপর আমি দায়িত্বে আসি ২০০৬ এ, তবে সেক্টর ৫, ডিএলএফ বিল্ডিং-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো মানবের সময়েই ঘটে।” তিনি জানান, ২০০১ সালেই প্রথম এই রাজ্যে প্রথম আইটি দফতর হয়, তার আগে ইনফরমেশন টেকনোলজি বলে কোনও দফতরের অস্তিত্বই ছিল না।

আরও পড়ুন- ৪০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে জীবন কাটল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের, সততার সহজপাঠ ছিল হাতের কাছেই

এককালে রাজ্য সরকারি সংস্থার একটা মাত্র ভবন দিয়েই কাজ শুরু হয়েছিল। ২০০৬ সালে তথ্য প্রযুক্তিতে কাজ করতেন ৩৫ হাজার মানুষ, চার বছরেই সেই সংখ্যা লাফিয়ে ১ লাখের গণ্ডি পার করে ফেলে। আর এখন বাংলার কত মানুষ আইটি মুখাপেক্ষী তার গণনা সংখ্যাকেও হার মানায়। ২০০৪-২০০৫ সালে, অর্থাৎ তথ্য প্রযুক্তি দফতর স্থাপনার তিন/চার বছরেই তথ্য প্রযুক্তি শিল্পে রাজ্যের প্রবৃদ্ধির গড় ছিল ২৫ শতাংশ। আর জাতীয় গড় ছিল ১২/১৩ শতাংশ। দেবেশ দাস জানান, “আমাদের সময় উইপ্রো ইনফোসিস এসেছিল, টিসিএস এসেছিল। তারপর থেকে রাজ্যে এমন কোনও শিল্প আসেনি যা আমাদের সময় আসা শুরু করে। উলটে ২০১১ সালের পর আইটি দু’ একটা চলেও গেছে।” শুধু রাজধানীতে আটকে থাকা নয়, দুইটি তথ্য প্রযুক্তি পার্ক চালু করে কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল শিলিগুড়িতেও।

কল কারখানার শিল্পের ধারণা থেকে বেরিয়ে বাংলাকে এক নয়া বিপ্লবের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন বাম নেতা মানব মুখোপাধ্যায়। তথ্য প্রযুক্তিই যে আগামী দিনে বিশ্বজুড়ে চাকরির বাজারকে দিশা দেখাবে তেমনটা আগে থেকে ধারণা না থাকলে এমন বড় পদক্ষেপ বাস্তব হওয়ার আগেই ফিতের জটে আটকে যায়। আজকের সাধারণ অ্যাপ নির্মাণ সংস্থার কর্মী থেকে শুরু করে টুইটারের বেচাকেনায় তোলপাড় হওয়া বঙ্গনাগরিক- মানবকে কেন মনে রাখবেন সে নিয়ে দ্বন্দ্বহীন হতে পারেন। গুলিয়ে দেওয়ার রাজনৈতিক ফিকিরে সত্যের কথা জানতে হলে, বাংলায় তথ্য প্রযুক্তির ইতিহাস জানতে হলে, সল্টলেকের বিকাশ জানতে হলে, টেক হাবের ব্লু প্রিন্ট জানতে হলে সকলকে ফিরে আসতেই হবে বাম আমলের বিশ্লেষণে, ফিরতে হবে মানবের চিন্তনের কাছে।

More Articles