ক্রিকেটারের ধর্ম কী? জানা কি খুব জরুরি?
Mohammed Shami: আহমেদাবাদ টেস্টে শামিকে 'উত্যক্ত' করতে ওঠে জয় শ্রীরাম স্লোগান।
বিষ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে বিষাদ। প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আগে এমনটা ছিল না। এমনটা হওয়ার কথাও নয়। তবু, সবকিছু যে নিয়ম মেনে হয় না। সুলতান নিরুদ্দেশ, এখন শুধু চোখরাঙানি আর বিদ্বেষ। একটা প্রজন্ম বড় হতে হতে দেখেছে বাবরি ধ্বংস বা গুজরাত। কিন্তু খেলার মাঠে ঘামে যখন ঘাসের গন্ধ মিশে যায়, কাঠের উইকেটগুলো যখন ইঁট দিয়ে ঠুকে অনেকটা গভীরে শেকড় পায়, তখন কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়ত মাঠমুখী ছেলের দল। আনসারি, ডিঙাপাড়ার কানু, রফিক, জগাই। শরদসংঘের মাঠে টুর্নামেন্ট ফাইনাল। ৬-এর পল্লীর ছেলেগুলোকে না হারালে যে সম্মান থাকবে না! তারপর ম্যাচ জিতে জার্সি ওড়ানো। মায়ের হাতে সেলাই করে দেওয়া জার্সির পিছনের ডাকনাম থেকে কখন যে একটা সুতোয় টান পড়েছে খেয়ালই নেই। তারপর কাদা মাখা শরীরে একসঙ্গে পুকুরে ঝাঁপ। পুরো পুকুর দাপাদাপি। জল ঘোলা হয়ে যাওয়া। কখনও বা পড়ন্ত বিকেলে মাঠে ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে দৌড়। আজ আর খবর নেই আমাদের দোস্তোজির। আমার ঘুড়ি কেটে কাঁটাতার পেরিয়ে চলে গেছে সেই নিরুদ্দেশের ঠিকানায়। এদেশে এখন শুধু চোখরাঙানি আর বিদ্বেষ।
ক্রিকেট রোমান্টিসিজমের সাক্ষী ছিলেন ওয়াসিম আক্রম। অবাক চোখে দেখতাম বাঁ হাত থেকে বেরনো গোলাগুলোর দিকে। অদ্ভুত বিস্ময়ে তাকিয়ে ভাবতাম রিভার্স সুইং এমনও হয়! আমার দেশ সামনে পড়লে সভয়ে দেখতাম লাহোরের সুলতানকে। তখন এত বাণিজ্যিক ক্রিকেট বিশ্লেষণ বা অবিরত হয়ে চলা হাইলাইটসের প্রাচুর্য ছিল না। টিভি খুলে যা দেখা, ওই ৫০ ওভারেই। তবে খবরের কাগজে পিছন পাতায় ছবি দেখে দেখে তখন খুব পরিচিত তিনি। বল চোখে দেখার আগেই ছিটকে দিত অফ স্ট্যাম্পের বেল। বহু পরে জেনেছি, অস্ট্রেলিয়ার অ্যালেন ডেভিডের মতো ব্যক্তিত্বও তাঁকে সেরার তালিকায় রাখেন। আরেকজনকে দেখেও অমন বিস্ময় লাগত। ভয় লাগত। সূর্যগ্রহণ দেখতে গিয়ে চোখে লেগে যাওয়া ধাঁধার মতো খানিক। আমার শহরকে সে স্তব্ধ করে দিতে পারে। ষাটহাজারি ইডেন চিৎকার করছে তাঁর ইয়র্কার দ্রাবিড়ের লেগস্টাম্প ছিটকে দেওয়ায়। স্বয়ং ঈশ্বরের আগমন বার্তা ভেসে আসছে ইডেনের হাইকোর্ট এন্ড থেকে।
আরও পড়ুন- ‘এ রোমাঞ্চের জন্য বাঁচা চলে’, বাংলা কবিতায় বারবার যেভাবে উঠে এসেছে ক্রিকেট
শোয়েব পরে কোনও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ঈশ্বরকে সেদিন বড় বেশি 'ক্যাজুয়াল' লাগছিল তাঁর। ইডেনের গর্জন উত্তরোত্তর মাত্রা ছাড়াচ্ছে। বাড়ছে উত্তেজনা। সব স্তব্ধ করে দেওয়া একটা ইয়র্কার। ভূপতিত সচিনের মিডল স্ট্যাম্প। সেদিন রাগ হয়েছিল, অভিমান হয়েছিল। কিন্তু সব কিছুর পরেও যেটা ক্রিকেটের অংশ ছিল না, তা হলো ধর্মবিদ্বেষ। উগ্র চিৎকারে জয় শ্রীরাম ধ্বনি। শোয়েব বলেছিলেন, সেদিন তিনি প্রত্যক্ষ করেন, কলকাতা ক্রিকেটের ঈশ্বরকে কতটা ভালোবাসে। এই শহর ভালোবাসা ফিরিয়েও দেয়। রাওলপিন্ডি এক্সপ্রেসের এক একটা অনবদ্য ঘাতক ডেলিভারি। গতির কাঁটায় ১৪০ ছাড়ানো গোলাগুলো যখন ব্যাটসম্যান স্পর্শ করতে পারেন না, স্বাভাবিক নিয়মেই তখন আসমুদ্র হিমাচল উঠে দাঁড়ায়। ভারতবর্ষ হোক কী শারজাহ, কেউই শ্রদ্ধা জানাতে বিস্মৃত হয় না। পরে আমার দলেও এল প্রতিভা। আর ভয় নয়। বেহালার ছেলে শিখিয়েছে ঔদ্ধত্যের সংজ্ঞা। দলে আছে জাহির খান কিংবা ইরফান পাঠান। নীল জার্সিও পাচ্ছে বিশ্বজুড়ে রাজত্বের আস্বাদ। কখনও পড়ছে, কখনও হোঁচট খাচ্ছে, দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের আগুনে পুড়ছে কিন্তু ময়দান ছাড়ছে না।
ইতিমধ্যে, এইসব দেখতে দেখতে শহরের বুকে বড় হচ্ছে আরেকজন। ততদিনে মোরাদাবাদের পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে সে চলে এসেছে কলকাতায়। টাউন ক্লাবে ভালো পারফরমেন্স দেখিয়ে অল্পবিস্তর নজরে পড়েছে সিএবির সিলেক্টরদের। দেবব্রত দাস বুঝেছিলেন, এ ছেলের চোখে স্বপ্ন আছে। হাতে আছে অনবদ্য সুইং। আর আছে ইতিহাস গড়ার ক্ষমতা। এ কখনও টাকা উপার্জনের স্বপ্ন দেখে না। বল অফ স্টাম্প ছুঁলে এক অনাবিল হাসি খেলে যায় দাড়ি ভর্তি গালে। উজ্জীবিত হয়ে আবার রান আপ নেয়। সুযোগ আসে শতাব্দী প্রাচীন মোহনবাগান ক্লাবে খেলার। তারপর আসে ২০১২-১৩ রঞ্জি মরসুম। দুরন্ত পারফরমেন্স। মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিকসহ গোটা ইনিংসে ১১উইকেট! ততদিনে জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরে চলে এসেছেন তিনি। ডাক পেয়েছেন আইপিএলেও। ২০১৩ থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ডান হাতের অবিশ্বাস্য সুইংয়ে ভর করে চলে স্বপ্নের উড়ান। কিন্তু সাফল্যের পিছনে এসেছে কাঁটা। ব্যক্তিগত জীবনে বহু সমস্যায় জর্জরিত শামি ফিটনেস টেস্টে ব্যর্থ হয়েছেন আফগানিস্তান টেস্টের আগে। বিবাহবিচ্ছেদ মামলা আদালতে পৌঁছয়। দিনের পর দিন কাটাছেঁড়া চলে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। প্রাণের চেয়ে প্ৰিয় মেয়ের থেকেও দূরে থাকতে হয় বাংলার সুলতানকে। আবার নীরবে মাঠে কামব্যাক করেন, দুরন্ত পারফরমেন্স উৎসর্গ করেন কন্যাকে। বিশ্বকাপে হাত থেকে ক্রমাগত বেরিয়ে যাওয়া আফগানিস্তান ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে দলকে ফিরিয়ে আনেন লড়াইতে। বিশ্বকাপের মঞ্চে হ্যাটট্রিক! তবুও তাঁকে পরীক্ষা দিতে হয়। তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খারাপ পারফর্ম করলে তথাকথিত 'ধর্মনিরপেক্ষ' দেশে প্রশ্ন ওঠে। টুইটারে ট্রেন্ড আসে। গুগলে সার্চ সাজেশন লিস্টে প্রশ্ন আসে তিনি 'পাকিস্তানি কিনা'।
আরও পড়ুন- ক্রিকেটার কবিগুরু! যে রবীন্দ্রনাথকে আজও চেনেই না বাঙালি
'দেশ বদল রাহা হ্যায়'। আমাদের নস্টালজিক শৈশব কেটে গেছে। বাতাসে ক্রমাগত মিশছে সাম্প্রদায়িকতার ঝাঁঝালো বিষবাষ্প। প্রতিটা নির্বাচনে নেতাদের অমোঘ বাণীতে অনুস্মারক 'হিন্দু খতরে মে হ্যায়'। দেশের জার্সি পরে জাতীয়তাবাদের প্রমাণ দিতে হয় অর্শদীপ সিংহ, মহম্মদ সিরাজকে। হোটেলে ঢোকার মুখে তিলক না পরার ভিডিও ভাইরাল করে তাঁদের জন্যও অঘোষিত হুমকির দেওয়াল লিখন, পারফরমেন্স খারাপ হলে দেশের প্রতি আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে। এই আবহেই কিছু দলনেতা থাকেন, বা পরিস্থিতির চাপে দায়িত্ব নিতে হয় তাঁদের। সবচেয়ে বৃহত্তম ও ক্ষমতাশালী ক্রিকেটবোর্ডের আগেও তারা সরব হতে পারেন সতীর্থের জন্য। ধর্মের নামে অশালীন আক্রমণের নো-বল যে ডিপ স্কোয়ার লেগের উপর দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দেয় 'বিরাট' ছক্কায়। শক্তিশালী বোর্ড প্রমাদ গোনে। সরে যায় বেপরোয়া নির্ভীক ক্যাপ্টেনের ছায়া। আরব সাগরের তীরে বহু ঢেউ ভাঙে গড়ে। আহমেদাবাদ টেস্টে শামিকে 'উত্যক্ত' করতে ওঠে জয় শ্রীরাম স্লোগান। দেশের প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য উপস্থিতির পরে এহেন ঘটনা! সর্বশক্তিমান বোর্ড নীরব।