মাঠে জয়, সমাজে লড়াই; খেলাধুলোর মেয়েরা যে লড়াই লড়ছে
Women Sports: বিজয়ীদের নাম উচ্চারণ করে মনে মনে খালি গর্ব অনুভব করলেই তো আর হবেনা। যারা জেতেনি, যারা খেলা শুরু করলেও চালিয়ে যেতে পারেনি, এমনকি যারা খেলেওনি, তাদের কথাটা ভাবতে গেলে মনটা বিষণ্ণ হয়ে আসে।
ভারতবর্ষের ক্রীড়া অনুরাগীদের বাজারটা বেশ বড়। তবুও প্রচলিত গণমাধ্যমে খেলাধুলোর আলোচনা মোটামুটি সীমিত থাকে প্রধানত পুরুষদের ক্রিকেট আর ফুটবলে। অন্যান্য খেলাগুলো যেন নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক বা বড়জোর শেষের আগের পাতায় দুটো প্যারাগ্রাফ বরাদ্দ তাদের জন্য। একনিষ্ঠ ক্রীড়া অনুরাগীদের বাইরে তাঁদের কথা প্রায় হয় না বললেই চলে। ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার পুরুষদলের একদিনের সিরিজ দেখার সময়ে ওভারের ফাঁকে ফাঁকে দেখছিলাম একটা বিজ্ঞাপন। সেখানে নারী ক্রিকেটারদের জার্সি পরা নিয়ে একটা আলোচনা উঠেছে। বিজ্ঞাপনের নিয়ম মেনে সেই আলোচনার একটা ইতিবাচক সমাপ্তি হলেও, এই আলোচনা যে আজও করতে হয় এটাই পীড়াদায়ক।
সম্প্রতি মহিলা ক্রিকেটে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অজিদের হারিয়ে, দুর্ধর্ষ জয় ছিনিয়ে ফাইনালে পৌঁছল ভারতীয় দল। মহিলাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ ঘিরে আগের তুলনায় উৎসাহ বেশ খানিকটা বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু দেশজুড়ে ক্রীড়াক্ষেত্রে মহিলাদের অবদান নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস নজরে পড়ে না। এমনিও ক্রিকেট আর ফুটবলের বাইরে কোনো খেলাকে স্পটলাইট দেওয়াটা মিডিয়ার চোখে সময় নষ্টের সামিল। আর যেটুকু নিউজপ্রিন্ট তাদের নিয়ে ব্যয় হয় তার একটা ছোট্ট অংশ দেওয়া হয় মহিলা ক্রীড়াবিদদের। তাই তাঁদের সিংহভাগের অবস্থাটা যাকে “ডাবলি জ্যোপারডাইজড" বলে ঠিক তাই। ক্রীড়া ঘিরে আলোচনার যেটা মূলস্রোত সেখানে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নানা রক্ষণশীল চিহ্ন বহমান, এবং মাঝেমাঝে সগৌরবে বহমান। কাজেই ক্রীড়াক্ষেত্রে মহিলাদের অবস্থান নিয়ে নয়, সে মূলস্রোতে নীরব থাকতেই পছন্দ করে, কিংবা কয়েকটা পিঠচাপড়ানি দিয়ে কর্তব্য সারে। ভারতবর্ষের মতো দেশে মহিলা হলেই ক্রীড়াজগতে টিকে থাকতে হলে নিতান্ত অল্প বয়স থেকে যুঝে চলতে হয় হাজারও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। সেটা অবহেলার নয়, সম্ভ্রমের যোগ্য। সব ক্রীড়াবিদের গল্প একরকম না হলেও আমাদের দেশে খেলার ময়দানে মহিলারা অনেক বেশি কোণঠাসা। তাঁদের লড়াইটা প্রায় সব ক্ষেত্রেই অনেক অনেক বেশি কঠিন। মহিলা ক্রীড়াবিদদের নিয়ে কেন আলোচনা কম, সেটা বুঝতে আমাদের ভাবতে হবে একেবারে আঞ্চলিক স্তরে মহিলাদের খেলার সুযোগ এবং সামাজিক অনুমোদন ঠিক কতখানি কম। এরপরেও বহু কৃতী মহিলা ক্রীড়াবিদ, সিস্টেমের আনুকূল্যে নয়, বরং সিস্টেমের সব অন্তর্নিহিত প্রতিকূলতা ছাপিয়ে, নিরন্তর জুগিয়েছেন প্রেরণা, পেয়েছেন ক্রীড়ানুরাগীদের সমাদর।
সাম্প্রতিক জানা গিয়েছে, অনূর্ধ্ব তেইশ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে মহিলাদের বিভাগগুলোতে ভারত এবার পেয়েছে সেরা দলের তকমা। জাপান আর আমেরিকার মতো দেশকে মাত দিয়েছে পয়েন্টস টেবিলে। এক বছর আগে এই একই প্রতিযোগিতায় মহিলা বিভাগগুলোতে ভারত ছিল পঞ্চম শ্রেষ্ঠ দল। এবার তারা জিতেছে সাত সাতটা মেডেল। ফ্রিস্টাইল কুস্তির তিপান্ন কেজি বিভাগে হংসিকা লাম্বা আর ঊনষাট কেজি বিভাগে সারিকা মালিক পেয়েছেন রূপো। পঞ্চান্ন আর সাতান্ন কেজি বিভাগে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছেন নিশু দাহিয়া আর নেহা শর্মা। পঁয়ষট্টি, আটষট্টি আর ছিয়াত্তর কেজি বিভাগে ব্রোঞ্জ জিতেছেন যথাক্রমে পুলকিত কান্দোলা, সৃষ্টি এবং প্রিয়া মালিক।

পদকজয়ী কুস্তিগিররা
এই মুহূর্তে বাহরিনে চলছে এবারের এশিয়ান ইউথ গেমস। সেখানে ভারতীয় মহিলাদের সাফল্য নজরকাড়া। ভারতীয় মহিলা দল কবাডিতে সোনা তো পেয়েছেই, পাশাপাশি আরও দু'টো সোনা জিতেছেন ভারোত্তলনের ৪৪ কেজি ক্লিন অ্যান্ড জার্ক বিভাগে প্রীতিস্মিতা ভোই এবং কুস্তির ৬১ কেজি ফ্রিস্টাইল বিভাগে যশিতা রানা। প্রীতিস্মিতা ৪৪ কেজি স্ন্যাচ বিভাগেও জিতেছেন রৌপ্য পদক। ভারতীয় কুস্তিগীর কণিষ্কা বিধুরি ও খুশি কুরাশের ৫২ আর ৭০ কেজি বিভাগে পেয়েছেন যথাক্রমে রুপো ও ব্রোঞ্জ পদক। রঞ্জনা যাদব, শৌর্যা আম্বুরে ও এডুইনা জেসন রুপো জিতেছেন মহিলাদের পাঁচ হাজার মিটার হাঁটা, একশো মিটার হার্ডল এবং চারশো মিটার দৌড়ে। মহিলাদের দুশো মিটার দৌড়ে ব্রোঞ্জ পেয়েছেন ভূমিকা নেহাতি। মহিলাদের মেডলি রিলেতে রুপোর পদক পেয়েছে ভারতীয় দল। ডিসকাস থ্রো-এ রুপো পেয়েছেন ওশিন আর শটপাটে ব্রোঞ্জ জিতেছেন জসমিন কৌর। মিক্সড মার্শাল আর্টসে রুপো জিতেছেন শ্রিয়া মিলিন্দ সাতাম। এছাড়া ভারতের নারীপুরুষ মিক্সড দল তাইকোন্ডোতে একজোড়া ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছে। টেবিল টেনিসে মিক্সড ডাবলস বিভাগের ব্রোঞ্জ পদকটাও ভারতের হস্তগত হয়েছে। মহিলাদের বক্সিংয়ের নানা ইভেন্টের শেষ চারে একাধিক ভারতীয় খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করবেন। কাজেই মেডেলের সংখ্যা আরও বাড়বে।
আরও পড়ুন- ক্রিকেট বিশ্বকাপের স্বপ্নভঙ্গ থেকে সাক্ষীর কুস্তি ত্যাগ, ফিরে দেখা ২০২৩-এর খেলার দুনিয়া
কয়েক মাস আগেই দাবায় মহিলাদের বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতেরই কোনেরু হাম্পিকে হারিয়ে বিজয়ী হলেন দিব্যা দেশমুখ, একইসাথে অর্জন করলেন গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব। হাম্পি, দ্রোণাবালী হরিকা, বৈশালী রমেশবাবুর পর চতুর্থ ভারতীয় মহিলা হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার পেলেন দিব্যা। গতমাসে অনুষ্ঠিত বক্সিং বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে সব বিভাগ মিলিয়ে ভারতীয় দল তৃতীয় স্থানে প্রতিযোগিতা শেষ করেছে। চারটে মেডেলের সবকটাই এসেছে নারীদের বক্সিংয়ের নানা বিভাগে। মীনাক্ষী হুডা আর জসমিন লাম্বোরিয়া সোনা জিতেছেন ৪৮ এবং ৫৭ কেজি বিভাগে। ৮০ কেজি বিভাগে ব্রোঞ্জ জিতেছেন পূজা রানি। ৮০ কেজি ঊর্ধ্ব বিভাগে রুপো পেয়েছেন নূপুর শিওরান। টেবিল টেনিসে এই বছর মে মাসেই প্রথম কোনো ভারতীয় মহিলা বিশ্বর্যাঙ্কিংয়ে প্রথম পঁচিশজনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন। মণিকা বাত্রা এই নজির গড়ার পথে হারিয়েছেন বিশ্বর্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী খেলোয়াড়কে। দিন কয়েক আগেই ব্যাডমিন্টনের এশিয়া চ্যাম্পিয়নশিপে অনূর্ধ্ব পনেরো এবং অনূর্ধ্ব সতেরো বিভাগের সিঙ্গেলস ইভেন্টে ভারতের শাইনা মানিমুথু আর দীক্ষা সুধাকর জিতেছেন সোনা। সদ্যই একটিও সেট না হেরে মহিলাদের জুনিয়র টেনিসে তেরো বছরের সৃষ্টি কিরণ ডোমিনিকান রিপাবলিকে জিতেছেন আইটিএফ জে৩০ টাইটেল। সেপ্টেম্বরে চিনে অনুষ্ঠিত আইএসএসএফ বিশ্বকাপে মহিলাদের দশ মিটার এয়ার পিস্তল শুটিংয়ে ভারতের এশা সিং জিতেছেন স্বর্ণপদক। অগাস্টে এশিয়ান শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে সিফত কৌর শর্মা রাইফেল থ্রি পজিশন বিভাগে সোনা জিতেছেন। থ্রি পজিশন শুটিংয়ে মহিলাদের দলগত বিভাগে, মহিলাদের জুনিয়র বিভাগে দল এবং ব্যক্তিগত ইভেন্টেও সোনা জিতেছে ভারত। মহিলাদের জুনিয়র ট্র্যাপ ইভেন্টেও দল এবং ব্যক্তিগত দুটি বিভাগেই প্রথম স্থানে ভারতীয় ক্রীড়াবিদরাই। দিন দশেক আগে তীরন্দাজির কম্পাউন্ড ইভেন্টে জ্যোতি সুরেখা ভেন্নাম ব্রোঞ্জ জিতলেন তীরন্দাজি বিশ্বকাপে।

জ্যোতি সুরেখা ভেন্নাম
উদাহরণ চাইলে আরও অনেক দেওয়া যায়। কিন্তু সেই বিজয়ীদের নাম উচ্চারণ করে মনে মনে খালি গর্ব অনুভব করলেই তো আর হবে না। যাঁরা জেতেননি, যাঁরা খেলা শুরু করলেও চালিয়ে যেতে পারেননি, এমনকি যাঁরা খেলেননি, তাঁদের কথাটা ভাবতে গেলে মনটা বিষণ্ণ হয়ে আসে। যে সমাজ খেলার মাঠ থেকে মেয়েদের আলাদা করে রাখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেছে, যে সমাজব্যবস্থা পদে পদে মনে করিয়ে দিয়েছে ঠিক কোন কাজগুলো মেয়েদের জন্য নয়, দিকে দিকে গড়ে তুলেছে নিষেধাজ্ঞার তুখোড় ঘেরাটোপ, সেই সমাজে দাঁড়িয়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মহিলার নাছোড় লড়াই আর চোখধাঁধানো সাফল্যের গল্প বলার সঙ্গে সঙ্গে বলা প্রয়োজন আরও হাজার হাজার মহিলার নিঃশব্দ বা সশব্দ এক্সক্লুশনের কথা। জয়ের গরিমায় বুক ফোলানোর ক্ষেত্র হিসেবেই খালি খেলাধুলোর পরিসর সীমিত নয়। খেলাধুলোর পরিসর মানুষের নিজেকে ব্যক্ত করার পরিসর, আনন্দে মেতে ওঠার পরিসর। কাজেই সে পরিসর যখন সবার জন্য সমান উন্মুক্ত হতে ব্যর্থ হয়, সেই ব্যর্থতা একটা বৃহত্তর সামাজিক সমস্যা। বাজারমুখী মিডিয়া সেই সমস্যার একটা অংশ ছাড়া কিছুই না।
ভারতে তৃণমূল স্তরে খেলাধুলোর পরিকাঠামো একান্তই দুর্বল। আর সেটা নিয়ে প্রশাসনিক দুর্নীতি আর অবহেলা পাহাড়প্রমাণ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পিতৃতন্ত্রের চোখরাঙানি। যে সমাজে অলিম্পিক পদকজয়ী নারী ক্রীড়াবিদকেও সহ্য করতে হয় ব্রিজভূষণের মতো নির্লজ্জ অপরাধীর অত্যাচার, আর ন্যায়বিচার চাইলে নেমে আসে রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতন, সেই সমাজে কতখানি প্রতিরোধ ডিঙিয়ে মহিলাদের খেলার মাঠে পৌঁছতে হয়, সেটা ভাবতে গেলে গর্বের থেকে ঢের বেশি ভয় হয়। রাগ হয়। কাজেই নিউজরুমের পাশাপাশি আমাদের চারপাশে বাড়িতে-পাড়ায় মেয়েদের খেলাধুলোকে উৎসাহ না দিলে, পুরুষশাসিত গেটকিপিংয়ের সংস্কৃতিকে সরাসরি আক্রমণ না করলে, এসব আলোচনা কেবলই থেকে যাবে কেতাবি হতাশা জ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে। গড়িয়ে যাবে একটার পর একটা বিকেল। মেয়েরা খেলতে যায়নি দেখে নিশ্চিন্ত বোধ করবেন রক্ষণশীলতার ধ্বজাধারীরা। ভারতীয় মেয়েরা অনেক পদক জিতছে, কিন্তু আরও অনেক অনেক পদক জেতার পথ বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। আরও একটা পরিসর থেকে সুচারুভাবে সরিয়ে রাখা হচ্ছে মহিলাদের নিজেদের ব্যক্ত করার সুযোগ, আনন্দে মেতে ওঠার সুযোগ। তাতে সমাজের ভেদরেখাগুলোই স্পষ্টতর হচ্ছে, ক্রীড়াজগতের লাভ তো কিছুই হচ্ছে না।

Whatsapp
