ওয়ান ডে, টেস্ট এখন অতীত, পুরোটাই টি-টোয়েন্টি! ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী আশঙ্কা করছেন কপিল দেব?
আইসিসি-র ক্যালেন্ডারে ধীরে ধীরে জায়গা দখল করছে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট। ওয়ান ডে বা টেস্টের ভবিষ্যৎ কী?
বর্তমানে দেশে দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি-ভিত্তিক টি-টোয়েন্টি লিগের দাপট চোখে পড়ার মতো। দাপট এমনই যে, আন্তর্জতিক ক্রিকেট আজ বিপর্যস্ত। আমরা হালেই দেখেছি যে, আইপিএলের শিডিউলের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সিরিজ রিশিডিউল করতে হয়েছে। এখন যেন আন্তর্জাতিক ম্যাচের চেয়ে টি-টোয়েন্টি লিগই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। যেমনটা হয়েছে ফুটবলে। চার বছর পরপর বিশ্বকাপ ছাড়া ফুটবলের পুরোটাই চলে ক্লাব পর্যায়ের প্রতিযোগিতা দিয়ে। আর এই নিয়েই অত্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব।
প্রাক্তন ভারতীয় অধিনায়ক কপিল দেব মনে করেন যে, আইসিসি-র এবার ওডিআই ফরম্যাটের দিকে নজর দেওয়া উচিত। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ টেনে তিনি বলেছেন, টি-টোয়েন্টি এবং টেস্টে বেশি মনোযোগ দেওয়ার জন্য বেন স্টোকস সম্প্রতি ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন। বিশ্ববন্দিত অলরাউন্ডারের অবসরের পরেই বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মত, বর্তমান ক্রিকেটারদের অনেকেই পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচ খেলতে চাইছেন না। ওয়ান ডে ক্রিকেট থেকে স্টোকসের অবসরকে সমর্থন করে ওয়াসিম আক্রম বলেছিলেন, ওয়ান ডে ক্রিকেটকে অযথা টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার বদলে টি-টোয়েন্টি অনেক সহজ ফরম্যাট। সেখানে ৫০ ওভারের ম্যাচ খেলতে গিয়ে অনেকটাই ক্লান্ত বোধ করছেন অনেক খেলোয়াড়ই।
আরেকটি উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিউজিল্যান্ডের স্টার বোলার ট্রেন্ট বোল্টের কথা। কয়েকদিন আগেই বোল্ট নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটকে তাঁকে কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কারণ অবাক হতে হয়। বোঝা যায়, কপিলের চিন্তা মোটেও অমূলক নয়। বোল্ট নিজের সাফাইয়ে জানিয়েছেন, তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে এবং অন্যান্য বিশ্বব্যাপী টি-টোয়েন্টি লিগে অংশ নিতে চান। উল্লেখিত এই দুই ক্রিকেটারই বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম সেরা দুই খেলোয়াড়। একা হাতে ম্যাচের মোড় ঘোরানোর ক্ষমতা রয়েছে দু'জনের। বলাই বাহুল্য, তাঁদের এহেন সিদ্ধান্ত উদ্বেগ তৈরি করেছে বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ড এবং কপিল দেবের মতো বহু প্রাক্তন ক্রিকেটারের মধ্যে।
আরও পড়ুন: ফুলেফেঁপে উঠছে বিসিসিআই, ভারতীয় ক্রিকেটের কতটা উন্নতি হচ্ছে?
কপিল দেবের মতে টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের পাশাপাশি ওডিআই ক্রিকেটের জন্য সঠিক সময়সূচি বানিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে সিরিজ আয়োজন করুক বোর্ডগুলি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, বোর্ডগুলি অনেক বেশি পরিমাণে দ্বি-পাক্ষিক টি-টোয়েন্টি সিরিজ এবং টেস্ট পছন্দ করছে। অন্যদিকে, ওয়ান ডে-র সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এখানে কপিলের প্রশ্ন, তবে কি ফুটবলের মতো অবস্থা হবে ক্রিকেটেরও? তিনি বলেন, "ফুটবলে সারা বছর লিগ চলে। কেবল চার বছর অন্তর বিশ্বকাপ বা ইউরো কাপের মতো প্রতিযোগিতায় দেশগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে খেলে। ক্রিকেটও কি সেই পথে হাঁটছে? শুধু বিশ্বকাপেই দেশগুলো খেলবে? আর বাকি সময় শুধু ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট চলবে? এটা হতে পারে না।"
আইসিসি-র ক্যালেন্ডারে ধীরে ধীরে জায়গা দখল করছে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট। আইপিএল, বিগ ব্যাশের মতো প্রতিযোগিতার জন্য আলাদা সময় ধার্য করছে আইসিসি। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমনই যে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলির সঙ্গে আন্তর্জাতিক সিরিজের ঠোকাঠুকি লাগছে এবং বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি নির্বিকার। আইপিএলের কথাই ধরা যাক। এর আগে পর্যন্ত আইপিএল ছিল ৮ দল ও ৬০ ম্যাচের লিগ। সাধারণত মার্চের শেষ সপ্তাহে শুরু হওয়া আইপিএল চলত মে মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। ২০২২ সালে আইপিএলে দু'টি দল বাড়ায় ম্যাচের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪। গত জুনে আইপিএলের নতুন সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রির পর ২০২৩ সাল থেকে আইপিএলের ম্যাচ সংখ্যা আরও বাড়ছে। আইপিএল এখন ৯৪ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি লিগ। ভারত এখন এত ম্যাচ আয়োজনের জন্য আরও দুই সপ্তাহ সময় যোগ করতে চাইছে। শুধু ভারত নয়, ইংল্যান্ড তাদের দ্য হান্ড্রেড টুর্নামেন্টের জন্যও সময় ফাঁকা রাখছে, অস্ট্রেলিয়া রাখছে বিগ ব্যাশের জন্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তানও নিজ নিজ টি-টোয়েন্টি লিগের জন্য সময় ফাঁকা রাখছে। অগাস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের সময়টা সিপিএলের জন্য বরাদ্দ রেখেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এ-সময় হাতে গোনা কিছু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবে ক্যারিবিয়ানরা। আইপিএলের সময় সাধারণত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয় না বললেই চলে। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া অবশ্য এখন পর্যন্ত দ্য হান্ড্রেড ও বিগ ব্যাশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও আয়োজন করে আসছে।
আর এই সম্পূর্ণ ঘটনা ক্রিকেটারদের অবস্থান কী? যেহেতু কম সময়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি বেশি টাকা তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের দিকেই বেশি ঝুঁকে। দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক চেষ্টার পর তাদের টি-টোয়েন্টি লিগ মাঠে নামাতে যাচ্ছে। সেজন্য এর মধ্যেই টি-টোয়েন্টি লিগকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ২০২৩ বিশ্বকাপে সরাসরি অংশগ্রহণের সম্ভাবনাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। আগামী বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজের পর দুই দলের ওয়ান ডে সিরিজ খেলার কথা। ওয়ান ডে সিরিজটি আবার তাদের টি-টোয়েন্টি লিগের সঙ্গে ক্ল্যাশ করছে। তাই প্রথমে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে ওয়ানডে সিরিজের সূচি বদলানোর প্রস্তাব দিয়েছিল ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা। তারা এই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সাউথ আফ্রিকা ঘোষণা করে দিয়েছে যে নিজেদের দেশে টি-টোয়েন্টি লিগের জন্য অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এক দিনের সিরিজ খেলতে যাবে না তারা। তিন ম্যাচের সিরিজটি না খেললে ওয়ান ডে সুপার লিগের ৩০ পয়েন্ট যাবে অস্ট্রেলিয়ার পকেটে। সুপার লিগের তালিকায় ১১তম দল দক্ষিণ আফ্রিকার সরাসরি বিশ্বকাপে খেলা তখন কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু দেশের বিশ্বকাপ নিশ্চিত করার আগে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড চাইছে আর্থিক সচ্ছলতা। সেজন্য বাধ্য হয়েই তাদের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে টেস্ট ও ওডিআই ক্রিকেটের মৃত্যু হবে। অন্তত এমনটাই আশঙ্কা প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং বিশেষজ্ঞদের। এখন দেখা যাক তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটকে সমানভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আইসিসি কী পদক্ষেপ নেয়। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আইসিসি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগকে জায়গা করে দিতে গিয়ে চাপ বাড়াচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ওপর, মূলত ওডিআই এবং টেস্ট ক্রিকেটের ওপর। এই খেলার সবক'টি ফরম্যাট যদি সমানতালে না খেলা হয়, তাহলে আখেরে ক্ষতি কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেরই।