২০০৭ টি-২০ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক থেকে পুলিশকর্মী, আড়ালেই রয়ে গেলেন যোগীন্দর শর্মা

Cricketer Joginder Sharma Retires : পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই শেষ ওভারের নায়ক তিনি। সেই যোগীন্দর শর্মাই এখন অবসর নিলেন ক্রিকেট জগত থেকে।

ক্রিকেটের ক্ষেত্রে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। বাইশ গজের এই লড়াইয়ে নামলে যা খুশি হয়ে যেতে পারে। মাত্র একটা ওভারে খেলা পুরো ঘুরে যেতে পারে। ২০০৭ সাল, টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল সেই ব্যাপারটাকেই প্রত্যক্ষ করে। মাত্র একটা ওভার, আর তাতেই প্রথমবার টি-২০ বিশ্বকাপ জিতে যায় ভারত। তাও চিরশত্রু পাকিস্তানকে হারিয়ে! আচ্ছা, সেই ম্যাচের বোলার যোগীন্দর শর্মাকে মনে আছে? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই শেষ ওভারের নায়ক তিনি। সেই যোগীন্দর শর্মাই এখন অবসর নিলেন ক্রিকেট জগত থেকে।

২০০৭ সালের আগে যোগীন্দর শর্মার নাম সেভাবে কি শুনেছে ভারতীয় ক্রিকেট দর্শকরা? কিংবা ২০০৭-এর পরও তাঁর নাম শোনা যায়নি। ভারতের হয়ে বেশি ম্যাচও খেলেননি তিনি। দেশের জার্সি গায়ে মাত্র তিন বছর খেলেছেন। ২০০৪ থেকে ২০০৭ – এই কয়েক বছরে আটটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন। তবে তার আগে নিজের রাজ্য হরিয়ানার হয়ে রঞ্জিতে খেলেছেন তিনি। ইন্ডিয়া-এ দলের হয়েও খেলেছেন। সেই সময়ই প্রথমবার ভারতীয় ক্রিকেট মহলের নজরে আসেন তিনি। ব্যাঙ্গালুরুতে ভারতের জাতীয় দলের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া-এ’র ম্যাচ ছিল। সেখানেই চমকপ্রদ পারফর্মেন্স করেন যোগীন্দর শর্মা। রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ ও যুবরাজ সিং – জাতীয় দলের তিন সুপারস্টার ক্রিকেটারকে আউট করেন তিনি।

আরও পড়ুন : বাইশ গজে শোয়েব আখতারও ভয় পেতেন তাঁকে, আজও ভারতীয় ক্রিকেটের ভরসার ‘দেওয়াল’ রাহুল দ্রাবিড়

কিন্তু এমন ফলাফলের পরও ২০০৭ একদিনের বিশ্বকাপে জায়গা পাননি যোগীন্দর। সেই সময় ভারতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছিল বাঁ হাতি পেসার ইরফান খান। কিন্তু ২০০৭ সালেরই টি-২০ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে তাঁর নাম উঠে আসে। সেমি ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দলে জায়গা পান যোগীন্দর। এটাই হয়তো তাঁর প্রমাণ করার জায়গা ছিল। বড় মঞ্চ, বড় প্রতিপক্ষ। মারাত্মক চাপ, তার মধ্যে থেকেই ম্যাচ বের করে আনতে পারলেই তো কেল্লা ফতে! নতুন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। সেটা কি পূরণ হবে?

ফাইনালের একেবারে শেষ লগ্ন। পাকিস্তানের নয় উইকেট পড়ে গিয়েছে; হাতে মাত্র একটি উইকেট বাকি। শেষ ওভারে পাকিস্তানের জেতার জন্য দরকার মাত্র ১৩ রান। ক্রিজে রয়েছেন সেট হয়ে যাওয়া ব্যাটার মিসবা-উল-হক। সেই সময়ই মাস্টারস্ট্রোক খেললেন ধোনি। শেষ ওভারটা দিলেন তুলনায় অনভিজ্ঞ বোলার যোগীন্দর শর্মাকে। প্রথম বলটিই ওয়াইড! তার পরের বলটিও একটুর জন্য ওয়াইড হল না। তৃতীয় বলটি টেনশনের চোটে ফুলটস দিয়ে দিলেন যোগীন্দর। ফলাফল? সোজা ছক্কা হাঁকালেন মিসবা। পরের বলটি আউটসাইড অফ স্টাম্প করলেন। মিসবা ভেবেছিলেন, একটা ছয় মারলেই ম্যাচ শেষ। কেবল বলটাকে বাউন্ডারিতে পাঠাতে হবে। নিজের প্রিয় স্কুপ শট খেলবেন তিনি। কিন্তু খেয়াল করলেন না, তার ঠিক পেছনে, ডানদিকে বাউন্ডারির কাছেই রয়েছেন শ্রীসন্থ।

পরিকল্পনামাফিক বল করতে আর ভুল করলেন না যোগীন্দর শর্মা। সেই ফাঁদে পড়লেন অভিজ্ঞ মিসবা। শ্রীসন্থের হাতে ক্যাচ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমবারের জন্য ২০০৭ টি-২০ বিশ্বকাপ জিতে নেয় ভারত। শেষ ওভারে বল করে নায়ক হয়ে যান যোগীন্দর শর্মা। হরিয়ানা সরকার ২১ লক্ষ টাকা পুরস্কার দিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়। কিন্তু যোগীন্দর শর্মাকে ২০০৭ বিশ্বকাপ জেতার পর আর জাতীয় দলে দেখা গেল না। ক্রিকেট মানচিত্র থেকেও যেন হারিয়ে গেলেন তিনি। মাঝখানে আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে খেললেও, চমকপ্রদ পারফর্মেন্স ছিল না। যে মানুষটি ২০০৭ টি-২০ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক, তাঁকেই কার্যত ভুলে গেল ভারত!

আরও পড়ুন : ক্রিকেটার কবিগুরু! যে রবীন্দ্রনাথকে আজও চেনেই না বাঙালি

কাট টু কোভিড মহামারী ও লকডাউন। ২০০৭-এর পর কেটে গিয়েছে প্রায় ১৩ বছর। পৃথিবীর মতো গোটা ভারতেও চলছে লকডাউন। করোনা ভাইরাসের দাপটে জেরবার মানুষ। সেই সময় ফের সামনে এলেন যোগীন্দর শর্মা। ১৩ বছর পর ফের তাঁকে দেখতে পেল ভারত। তবে এবার ক্রিকেটার নয়, পুলিশ প্রশাসক হিসেবে। টি-২০ বিশ্বকাপের পরই হরিয়ানা প্রশাসন যোগীন্দরকে পুরস্কৃত করে। তখনই তাঁকে হরিয়ানা পুলিশের কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যোগীন্দর শর্মা ডিএসপি পদে কাজ করছেন। এখনও হরিয়ানা পুলিশের সঙ্গেই যুক্ত। কোভিডের সময় মানুষের যাতে অসুবিধা না হয়, সেজন্য অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গেই রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন তিনি। এটাও তো দেশের হয়ে লড়াই করা! কেবল বাইশ গজের জায়গায় হরিয়ানার রাস্তাঘাট, পুলিশ স্টেশন।

হয়তো ক্রিকেটে ফিরবেন, এমন আশা ছিল মনের ভেতর। কিন্তু সেটা আর হল না। ৩৯ বছর বয়সে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে নিজের অবসর নেওয়ার কথা জানালেন যোগীন্দর শর্মা। তবে খেলোয়াড় হিসেবে না হোক, ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে চান তিনি। অন্য ভূমিকায় হয়তো তাঁকে দেখা যেতে পারে, সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন।

More Articles