ধরে ধরে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এফআইআর, কী লুকোতে চাইছে মণিপুর প্রশাসন

Manipur: এডিটরস গিল্ডকে যেভাবে কোণঠাসা করা হয়েছে মণিপুরে, তা আদতে গণতন্ত্রের ব্যর্থতা

মাস খানেক আগেও অশান্তির আগুনে ফুটেছে মণিপুর। এখনও আক্ষরিক অর্থেই যে শান্তি ফিরেছে, এমনটা হলফ করে বলা যায় না। তবে খবর থেকে কিছুটা সরে এসেছে মণিপুর। তার জায়গা নিয়েছে চন্দ্রাভিযানের সাফল্য, প্রধানমন্ত্রীর নতুন নতুন ঘোষণা, বিরোধীজোটের পরিকল্পনা। ফলে মণিপুর কেমন আছে, সে খবর আপাতত তিমিরে।

তবে খবরে নেই মানেই যে খবর নেই, তা না-ও হতে পারে। গত মাস ছয়েক ধরে জাতিহিংসায় কার্যত ছাড়খার হয়ে গিয়েছিল উত্তর-পূর্বের ছোট্ট রাজ্যটি। বারবার সামনে এসেছে নারীদের উপর নির্যাতনের ঘটনা, যা নড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। মণিপুরে অশান্তি কোনও নতুন বিষয় নয়। এর আগেও নারী নির্যাতনের ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছে মাতৃতান্ত্রিক এই রাজ্য। তবে এবার যে ভাবে পরিস্থিতি প্রতিহিংসার দিকে মোড় নিয়েছিল, তা বোধহয় নজিরবিহীন। সেনাবাহিনীর অস্ত্র লুঠপাট থেকে গুলি চালনার ঘটনা, ধর্ষণ থেকে শুরু করে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া নাগরিকদের, এমন অনেক কিছুরই সাক্ষী থেকেছে মণিপুর। দিনের পর দিন সব দেখে, সব শুনেও চোখে ঠুলি পড়ে থেকেছে প্রশাসন। কেন্দ্র সরকারও নীরব থেকেছে ততদিন, যতদিন না মণিপুরের মেয়েদের নগ্ন প্যারেড করানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বমঞ্চে মুখ পুড়েছে মোদির।

আরও পড়ুন: শান্তি ফিরছে মণিপুরে, বলছেন প্রধানমন্ত্রী, আসল সত্যটা কী?


এখনও কি আদৌ শান্ত হয়েছে মণিপুর! সংশয় রয়েছে। যদিও স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, শান্তি ফিরছে মণিপুরে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যখন ফিরতে বাধ্য। আর সম্ভবত সে কারণেই মণিপুর সফরে যাওয়ার ও সেই অভিজ্ঞতা কাগজে কলমে ফুটিয়ে তোলার মাশুল দিতে হল এডিটর গিল্ড অব ইন্ডিয়ার (ইজিআই) প্রতিনিধি দলকে। এমনকী তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর পর্যন্ত দায়ের করেছে মণিপুর পুলিশ। সম্প্রতি মণিপুর সফরে গিয়েছিল ইজিআইয়ের দলটি। সেখান থেকে মণিপুরের পরিস্থিতি জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারা। আর তার জন্যই তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে মণিপুর পুলিশ।

যদিও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এই বিশেষ ধারাটিকে ২০১৫ সালেই বাতিল করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। তবে তাতে কান দেয়নি মণিপুর। এখনও ওই ধারায় লাগাতার এফআইআর নিয়ে চলেছে মণিপুর পুলিশ। একাধিক বার রাজ্যপুলিশকে এই ধারা ব্যবহার করে এফআইআর দায়েরে নিষেধ করা হয়েছে। তবে তাতে আমল দেয়নি পুলিশ। এই বাতিলকৃত ধারার আওতায় স্পর্শকাতর কোনও কনটেন্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার 'অপরাধে' তিন বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা হতে পারে।

সুপ্রিম কোর্ট ওই আইনটিকে বাতিল করলেও কেন মণিপুরে লাগাতার ওই ধারাটি ব্যবহার করা হচ্ছে, সে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন দলের মধ্যে অশান্তি লাগানোর চেষ্টা, মন্দির-দেবালয় ভাঙা বা কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা, গালিগালাচ-সহ একাধিক অভিযোগের ক্ষেত্রে মণিপুরে ব্যবহার করা হচ্ছে বাতিল হয়ে যাওয়া ধারাটি। একই ধারায় মামলা করা হয়েছে এডিটর গিল্ড অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি দলটির বিরুদ্ধে। যেখানে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত, অশান্তি বাঁধানোর চেষ্টার মতো অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে।

এডিটরস গিল্ডের সদস্যরা রাজ্যে অশান্তি এবং হিংসা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেছেন খোদ মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং। তাঁর দাবি, সে কারণেই পুলিশ প্রতিনিধিদলের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। এফআইআরে নাম রয়েছে সীমা গুহ, ভারত ভূষণ, সঞ্জয় কাপুরের মতো সাংবাদিকদের। এমনকী নাম রয়েছে এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়ার সভাপতি সীমা মুস্তাফাও। পুলিশের কাছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন ইম্ফলের বাসিন্দা সমাজকর্মী এনগাঙ্গম শরৎ। তাঁর দাবি, এডিটরস গিল্ড প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে একটি ছবি ব্যবহার করে দাবি করা হয়েছিল, কুকিদের একটি বাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তবে পরে জানা যায়, আদতে ওই বাড়িটি এক বনকর্তার। তবে এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য অবশ্য পরে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া হয় গিল্ডের তরফে। মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্সে এ নিয়ে ক্ষমাও চেয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে সেই ভুলের উপর ভিত্তি করেই এডিটরস গিল্ডের ওই সত্যতা যাচাইকারী দলটির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়।

মণিপুর প্রশাসনের দাবি, এডিটরস গিল্ডের প্রতিবেদনে সব পক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে ওই রিপোর্ট একতরফা বলে দাবি করা হয়েছে। রাজ্যের দাবি, সাধারণ পরিস্থিতিতে যে কোনও ঘটনা স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা ক্রস চেক করার রীতি রয়েছে। এক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। জাতি হিংসা সংক্রান্ত সাংবাদিকদের সব রিপোর্ট তাই একতরফা বলেই দাবি করা হয়েছে রাজ্য ও প্রশাসনের তরফে। যার জেরে ইজিআইয়ের প্রতিবেদন রাজ্যে শান্তি আনার পরিবর্তে আরও হিংসার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে। এমনকী ইন্টারনেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করেছে ইজিআই টিম। সেটাকেও ভালো চোখে দেখেনি মণিপুর প্রশাসন।

আরও পড়ুন: ফের হিংসা মাথাচাড়া দিল অশান্ত মণিপুরে, এবার গুলি চালাল সেনাও

যদিও মণিপুরে এডিটরস গিল্ডের এই হেনস্থার বিরুদ্ধে সওয়াল করেথে প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া। এফআইআরের বিরুদ্ধে বিবৃতি জারি করে তারা জানিয়েছে, আদতে মণিপুর সরকার সংবাদমাধ্যমের মুখ ভয় দেখিয়ে বন্ধ রাখতে চাইছে। পাশাপাশি তাদের অভিমত, রাজ্য সরকারের এমন পদক্ষেপ আদতে রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হতে চলেছে। সত্যিটাকে ধামাচাপা দেওয়ার যে চেষ্টা অনবরত রাজ্য সরকার করে চলেছে, তা আদতে মণিপুরের শান্তি পরিস্থিতিই আখেরে নষ্ট করছে। ইন্ডিয়ান ওমেন'স প্রেস কর্পসের তরফেও ব্যাপারটির কড়া নিন্দা করা হয়।

এডিটরস গিল্ডের মতো ৪৫ বছরের পুরনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বাকস্বাধীনতা যেভাবে খর্ব করা হয়েছে, তা এ দেশে নতুন নয়। এর আগেও বারবার সাংবাদিকদের উপরে আঘাত নেমেছে। তাদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা চলেছে। তবে তাতে সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া যায়নি আখেরে। এত বছর ধরে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছে যারা, সেই এডিটরস গিল্ডকে যেভাবে কোণঠাসা করা হয়েছে মণিপুরে, তা আদতে গণতন্ত্রের ব্যর্থতা বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ।

More Articles