আমাদের মধ্যে জমে থাকা যাবতীয় অন্ধকারেরই প্রতিফলন ডার্ক জোক

Dark Comedy: নানা শিল্পকর্ম আমাদের নানাভাবে অস্বস্তিতে ফেলে। অস্বস্তি দেওয়াটাও শিল্পের একটা কাজ বটে। কিন্তু এই অস্বস্তিরও এক নিজস্ব রাজনীতি রয়েছে।

১৯৩৭ সালে স্পেনের গের্নিকার বাস্ক শহরের উপর জার্মানরা বোমা বর্ষণ করে। মৃত্যু হয় শত শত মানুষের। এই ঘটনা বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর মনে প্রভাব ফেলে, যুদ্ধের ক্ষত বিক্ষত চিত্র বিমূর্তভাবে স্থান পায় পিকাসোর ক্যানভাসে। জন্ম নেয় পিকাসোর বিখ্যাত ছবি ‘গের্নিকা’। ঘটনাচক্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক গেস্টাপো কর্মকর্তা বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর বাড়িতে তল্লাশি চালাতে আসেন। পিকাসোর ঘরে ঢুকেই তিনি দেখতে পান তাঁর আঁকা সেই বিখ্যাত ছবি ‘গের্নিকা’। সেই ছবি দেখে তাঁর বেশ অস্বস্তি হয়।

তিনি জিজ্ঞেস করেন- Did you do this?

পিকাসো উত্তর দেন- No, you did this.

ডার্ক হিউমার নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রথমেই পিকাসোর গল্প বললাম কেন? আসলে দুটো জিনিসের মধ্যে একটা বিষয় সাধারণ— অস্বস্তি। নানা শিল্পকর্ম আমাদের নানাভাবে অস্বস্তিতে ফেলে। অস্বস্তি দেওয়াটাও শিল্পের একটা কাজ বটে। কিন্তু এই অস্বস্তিরও এক নিজস্ব রাজনীতি রয়েছে।

পিকাসোর আঁকা গের্নিকা

হয়তো কোনও কমেডিয়ান বললেন, "আমাদের পাড়ার অটোওয়ালারা এত কনুই মারে যে মেয়েরা পুজোতে নতুন শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট বানায়"। এই জোকটি খুবই ইনসেন্সিটিভ, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এই জোকটা যদি আর জীবনেও না বলা হয়, তাহলে কি অটোওয়ালারা কনুই মারা থামিয়ে দেবেন? অটোর সামনে বসে বুকে কনুইয়ের বাড়ি খাওয়া তো এদেশের মেয়েদের ভবিতব্য। আর এই ঘটনা থেকেই এমন জোকের সৃষ্টি। তাহলে এই জোকটা কে বা কারা লিখেছে? কোনও কমেডিয়ান? না কি সেই সব মানুষেরা যারা রাস্তাঘাটে নির্দ্বিধায় নারী শরীর স্পর্শ করে?

আসলে কোনও বিষয় নিয়ে শত প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও যখন সেই বিষয়টি অপরিবর্তিত থাকে, তখন মানুষ হাল ছেড়ে দেয়। আর যেখান থেকে হাল ছাড়ে, সেখান থেকেই ডার্ক জোকের পথ চলা শুরু।

আরও পড়ুন- আজ ‘অজাচার’, কাল মেয়েদের কটূক্তি! রণবীরদের সব ‘ডার্ক কমেডি’ আমাদের নজরে আসে?

আবার হয়তো, কোনও কমেডিয়ান বললেন, "এই দেশে বিবাহিত মহিলাদের জীবনযাত্রা খুবই অদ্ভুত! অধিকাংশ মেয়েকেই তাদের ধর্ষকদের জন্য রোজ সকালে উঠে ভাত রান্না করতে হয়।" এই জোকটি শুনে অনেকেই রে-রে করে তেড়ে আসবে। কমেডিয়ানের মুণ্ডপাত করবে! বলবে, "এত বড় সাহস! ধর্ষণ নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করা হচ্ছে!" অথচ এদের মধ্যে আশি শতাংশ মানুষ জানেনই না, কিছুদিন আগে ছত্তিশগড় হাইকোর্ট রায় দিয়েছে স্ত্রীর বয়স ১৫ বছরের বেশি হলে স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ বা অস্বাভাবিক যৌনতার অভিযোগ আনা যাবে না।

২০১৯-২০২১ সালে The National Family Health Survey একটি সমীক্ষা প্রকাশ করে যেখানে দেখা যায়, ১৮ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে ৮২% মহিলাই যৌন হিংসার শিকার, আর এক্ষেত্রে যৌন হেনস্থাকারী স্বয়ং তাদের স্বামীরা। আসলে একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, এই ধরনের ডার্ক জোকের ভিতরে রয়েছে একপ্রকারের দীর্ঘশ্বাস। অর্থাৎ যখনই ক্ষমতা আমাকে কোণঠাসা করে দিচ্ছে, আমার কাছে আর কোনও অস্ত্র নেই, তখনই আমি ক্ষমতাকে নিয়ে মজা করছি আর এই মজা ক্ষমতাবানকে অস্বস্তিতে ফেলছে। অর্থাৎ যে জোক বলছে, আর যাকে নিয়ে জোক বলছে তাদের পরস্পরের মধ্যেকার ক্ষমতার সমীকরণ ডার্ক হিউমারের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন- সংকেতে গড়া জাদু-মুহূর্ত! আদিত্য বিক্রমের মায়ানগর যে মুগ্ধতার ছবি আঁকে

এবার ধরা যাক কোনও কমেডিয়ান বললেন, "অন্ধ লোকেদের ক্ষেত্রে সব থেকে মজা হলো, তাঁদের দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই গুড নাইট বলা যায়।" এবার যে কমেডিয়ান এই জোকটা বলছেন, তাঁর যদি দৃষ্টি থাকে আর দর্শকাসনে যদি কোনও অন্ধ মানুষ বসে থাকেন তাহলে ব্যাপারটা কি মজার থাকে? কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এই জোকটা আমি শুনেছিলাম উত্তরপ্রদেশের একজন স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানের থেকে। নাম অভয় শর্মা, যিনি জন্মসূত্রে নিজেই অন্ধ। অর্থাৎ একজন 'কানা' যদি কানাকে 'কানা' বলে, একজন 'খোঁড়া' যদি খোঁড়াকে 'খোঁড়া' বলে তাহলে হয়তো অপরাধ খানিক কমে যায়। আসলে আমরা সবাই কমেডিয়ান! আমাদের সারাদিন অনেক কিছু দেখেই হাসি পায়, কিন্তু আমরা হাসতে পারি না, ভদ্রতার খাতিরেই হোক বা মানবিকতার খাতিরেই। কিন্তু একজন কমেডিয়ান যখন 'নিষিদ্ধ' বা সমস্যাজনক বিষয়গুলো নিয়ে জোক বলেন তখন মূলত দুই ধরনের মানুষ সব থেকে বেশি রেগে যান।

এক, যাঁরা নিষিদ্ধ বা সমস্যাজনক বিষয়গুলো দ্বারা কোনও না কোনওভাবে আক্রান্ত।

দুই, যাঁরা জোকটা শুনে মনে মনে হেসেছেন আর পরমুহূর্তেই তাঁদের 'পাপবোধ' হয়েছে।

আসলে এই দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষদের মধ্যে যে 'শয়তান' লুকিয়ে থাকে সেই শয়তানকেই যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য ওই কমেডিয়ান টেনে বের করে আনেন। তখন নিজের এই রূপ তাঁরা নিজেরাই সহ্য করতে পারেন না, অতএব কমেডিয়ানকে টেনে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেন। তাঁর নামে এফআইআর করেন। তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝোলান। ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ‘The Dark knight’ সিনেমায় Joker-কে মনে আছে? যে গথাম শহরের প্রত্যেক ক্ষমতাবানের মুখোশ খুলে দিয়েছিল? এমনকী শহরের সব থেকে আদর্শবান মানুষটির মধ্যে থেকেও এই শয়তানকে টেনে বের করে এনেছিল সে। আসলে আমাদের মধ্যে জমে থাকা যাবতীয় অন্ধকারেরই প্রতিফলন ডার্ক জোক। এখানে আমার না-পাওয়া রয়েছে, কান্না রয়েছে, হেরে যাওয়া রয়েছে কিন্তু একটাই শর্ত, আমার কাছে সব থাকলেও যেন ক্ষমতা না থাকে। কারণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি ক্ষমতাহীনদের তাঁর সেন্স অফ হিউমার দিয়ে আক্রমণ করে তাহলে সেটা হয় ক্ষমতাপ্রদর্শনের নামান্তর। তখন তার সঙ্গে শাসকের আর কোনও তফাৎ থাকে না। তাই ডার্ক জোকের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যেকার রাজনীতি। কারণ মজা নিছকই মজা নয়।

সম্প্রতি ইউটিউবে একটি শো নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। আমার নিজেরও ব্যক্তিগতভাবে সেই শো-এর কিছু জোক অস্বস্তিজনক লেগেছে এবং মনে হয়েছে এই অস্বস্তি ইচ্ছে করে উস্কে দেওয়া হচ্ছে, কোনও সামাজিক দায়ও নেই এই অস্বস্তির পিছনে। আমি আর সেই শো দেখিনি। অথচ সেই শো-এর ভিউ কয়েক লাখ। তাহলে কি মানুষ অস্বস্তি পেতে পছন্দ করছে? কমেডিয়ানরা ডার্ক জোক বলছেন বলে মানুষ শুনছে, না কি মানুষ ডার্ক জোক শুনতে চাইছে বলে কমেডিয়ানরা বলছেন? এই প্রশ্ন থেকেই যায়। আসলে ভারতবর্ষে কিছু বিষয় বস্তি অঞ্চলের মতো, বিদেশি কেউ এলেই সেই বস্তি অঞ্চল উঁচু পাঁচিল দিয়ে লুকিয়ে ফেলা হয় যাতে বস্তি না দেখা যায়। কিন্তু বস্তির উন্নয়ন আর হয় না, কেবলই উচ্ছেদ হয় সেখানে।

More Articles