দর্শক মনে প্রাণে চেয়েছিল শাহরুখ মরুক! সাইকোপ্যাথ খুনিই ছিল বাজিগরের 'হিরো'
Shah Rukh Khan: তিনটে সিনেমা করে শাহরুখ খান বলিউডি নায়কের চিরাচরিত ধারণাকে একেবারে চুলের মুঠি ধরে নেড়ে দিলেন।
কোনও আশা ছিল না। ভালো ফুটবল খেলতেন। অভিনয় জানতেন। এটুকু বুঝেছিলেন, মুম্বইয়ের এই কঠিন জগতে বাবা-কাকা ছাড়া বাঁচা মুশকিল। আর তাই ভদ্রলোক ঠিক সেটাই করেছিলেন যেটা ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব। অন্যের হেলায় ফেলে দেওয়া ভূমিকায় একের পর এক অভিনয় করে গেছেন, আর নিজের একশো শতাংশ ঢেলে দিয়েছেন তাতে। শাহরুখ খানের উত্থান এক নায়কের উত্থানের গল্প, রক্ত ঘাম ঝরানো পারফরমেন্সের গল্প, আবার একই সঙ্গে পপার টু প্রিন্সের গল্প, স্টুডিও ঘরানার শেষ মহানায়কের গল্প।
বলিউড সিনেমার ইতিহাস লেখা হলে আশির দশক এক অদ্ভুত টালমাটাল জায়গায় থাকবে। এই দশকের মাঝামাঝি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির মেন স্ট্রিম নায়করা বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন, তবু মেনে নিতে চাইছেন না। একের পর এক সিনেমায় কলেজ বয় সাজছেন আর ডোবাচ্ছেন। কম্ফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসার বিন্দুমাত্র চেষ্টাটুকু করছেন না। অন্যদিকে এই দশকে উঠে আসা তরুণ নায়করা, আমির খান, সলমন খান, কুমার গৌরব, অনিল কাপুরও একেবারে ছকে বাঁধা হিরোর বাইরে বেরোচ্ছেন না। ফলত গোটা বলিউড একটা আবদ্ধ কুয়োতে ঘুরপাক খাচ্ছে। যেন একটু অন্যরকম হলেই ফ্যানরা মুখ ঘুরিয়ে নেবেন। আর এখানেই একেবারে বহিরাগত হয়ে শাহরুখের আবির্ভাব। দিল্লি থেকে আসা, সিরিয়ালে অভিনয়, যে কোনও কাজের জন্য হাপিত্যেশ- এই সবক'টাই তাঁর বিরুদ্ধে ছিল হয়তো। আর সেই অভিশাপই আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল তাঁর জীবনে। জানতেন তাঁর চেহারায় হিরো হতে পারবেন না। তাই অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন মনেপ্রাণে। সেই পথেই প্রায় এক দশক ধরে অস্থির প্রেম, পাগলামো আর প্রতিশোধের মুখ হয়ে উঠলেন একেবারে সাধারণ চেহারার এই ছেলেটি, যে আপনি আমি যে কেউ হতে পারে।
আরও পড়ুন- নক্ষত্রের অবসর নেই, খুচরো জনতার খড়কুটো আজীবন শাহরুখই
গোটা বাজিগর ছবিতে তাঁর জীবনের ওয়ান পয়েন্ট অ্যাজেন্ডা। যে মদন চোপড়া তাঁর পরিবারের দুর্দশার জন্য দায়ী, তাকে ধ্বংস করা। যেনতেন প্রকারেণ। মদন চোপড়ার জন্যেই তাঁর মা আজ পাগল, বোন আর বাবা মৃত। এই ধরনের প্রতিশোধের ছবি আগেও বলিউড দেখেছে। দিওয়ার, জঞ্জির কিংবা ইয়াদো কি বারাত তো এই ধরনের প্রতিশোধেরই ছবি। তাহলে বাজিগর আলাদা কোথায়? এই প্রথমবার হিন্দি ছবির কোনও হিরো প্রতিশোধের জন্য একেবারে নির্দোষ কাউকে খুন করল। মদন চোপড়ার মেয়ে সীমাকে সে শুধু খুনই করে না, খুন করে অদ্ভুত স্যাডিস্টিক প্লেজারও পায়। এ জিনিস দর্শক আগে কখনও দেখেনি। হিরো যে একেবারে বিবেকশূন্য খুনিও হতে পারে, তা ভেবে দর্শকের শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত বয়ে যায়! শুধু তাই নয়, সীমার দুই বন্ধু, যারা অজয়রূপী শাহরুখকে সন্দেহ করে, দুইজনকেই নৃশংসভাবে খুন করে সে। একেবারে বিবেকশূন্যতার চরমে গিয়ে। গীতার সেই “জানামি ধর্ম ন চ মে প্রবৃত্তি/ জানাম অধর্ম ন চ মে নিবৃত্তি”-র মতো অজয় জানে ঠিক কী, ভুলই বা কী। কিন্তু সে অন্যায় না করে পারে না। আর এই পাগলামোকে কী নিখুঁত ফুটিয়ে তোলেন শাহরুখ। সীমার পার্টির যে ছবিতে তাঁকে দেখা গেছিল, সেই ফটোকে পুড়িয়ে না ফেলে সে গিলে ফেলে। সাইকোপ্যাথ হিরোর অবতারণা হিন্দি ছবিতে এইভাবে আগে কোনওদিন দেখা যায়নি। কিন্তু তার পরেই ছবি কিছুটা জাস্টিফিকেশান আর প্রিচিংয়ের দিকে ঝুঁকে যায়। সিনেমার সবচেয়ে দুর্বল অংশ সেইটাই। অনন্ত মহাদেবন (যিনি ছবিতে শাহরুখের বাবা) এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন আব্বাস-মস্তান সিনেমা শেষের পর আবিষ্কার করেন, তাঁর হিরো প্রায় অকারণেই একের পর এক খুন করে যাচ্ছে। তখনই নাকি অজয়ের বাবা-মা ইত্যাদির ক্যারেক্টার আর্কগুলো নিয়ে আসা হয়। শেষে মদন চোপড়াকে খুন করে মায়ের কোলে মাথা রেখে অজয় মারা যায়। অপরাধী, সে যদি নায়কও হয়, তবুও শাস্তি পায়। আর শাহরুখ পান সেই বছরের সেরা অভিনেতার ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার।
বাজিগরের ঠিক পরে পরেই শাহরুখ একই ধরনের দুটো নেগেটিভ রোল করলেন। ডর ছবির রাহুল মেহরা আর আঞ্জামের বিজয় অগ্নিহোত্রী। এখানে আর প্রতিশোধ না, বরং অবসেশন। দুটো ছবিতেই চরিত্ররা নায়িকার প্রতি অবসেশড আর সেই অবসেশন এই পর্যায়ে যায় যে, সে ধীরে ধীরে সাইকোপ্যাথ হয়ে ওঠে। ডর-এ তাঁর চরিত্রের মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজর্ডার আছে। আমি না, সিনেমায় ডাক্তারই বলেছেন। সে নিজের মরা মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে, মায়ের মৃত্যুর জন্য বাবাকে দায়ী করে, আর নিজেই ভেবে নেয় কলেজের সহপাঠী কিরণ (জুহি চাওলা) তাঁকে ভালবাসে। এই ছবিতে সে সুইসাইডাল, সে স্যাডিস্টিক। বুক চিরে কিরণ লিখতে তাঁর হাত বিন্দুমাত্র কাঁপে না। যেমন অনায়াসে সে ভাবতে পারে কিরণের প্রেমিক সুনীলকে (সানি দেওল) খুনের কথা। এই পাগল মা-হারা ছেলেটার প্রতি ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের করুণাও হয়। কিন্তু ওই যে! সে অপরাধী। তাঁকে মরতেই হবে শেষে। এখানে একটা কথাই বলার। আগে শাহরুখের রোলটা সানিকে অফার করা হয়েছিল, তিনি নেননি। হিরো নাকি নেগেটিভ রোলে মানায় না। ভাগ্যিস!
আরও পড়ুন- চরিত্রে অহিংস দেশ, প্রমাণ শাহরুখের ছবি-জীবন
আঞ্জাম ছবিটা এই ধারার শেষ ছবি। আর তিনটের মধ্যে সবচেয়ে ডার্কও বটে। বিবেকের মধ্যে অদ্ভুত এক শয়তানি খেলা করে, যার সে অর্থে কোনও কারণ নেই। সে যেন এক দুরন্ত শিশু, যে সুন্দর কোনও খেলনাকে ভেঙেই স্যাডিস্টিক প্লেজার পায়। শুধু অপরাধের আনন্দেই অপরাধ। ব্যাটম্যানের জোকারের সঙ্গে এই জায়গায় বিজয়ের অদ্ভুত মিল। নায়িকা শিবানীকে (মাধুরী দীক্ষিত) সে পেতে চেষ্টা করে। যখন বোঝে পাবে না, তখন প্রথমে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করতে চায়, বিফল হয়ে খুনের এক অদ্ভুত খেলায় মেতে ওঠে। সত্যি বলতে শিবানীর স্বামীকে হত্যা, শিবানীকে সেই হত্যার জন্য ফাঁসানো, তার দুনিয়াকে একেবারে শেষ করে দেবার পিছনে আপাত কোনও মোটিভই নেই। এই ছবিতে শাহরুখ আদ্যন্ত এক বলি-মেগালোম্যানিয়াক ভিলেন। একমাত্র এই ছবিতেই দর্শকদের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি সে পায় না। এই প্রথম দর্শক মনে প্রাণে চায় শাহরুখ মরুক।
এই তিনটে সিনেমা করে শাহরুখ খান বলিউডি নায়কের চিরাচরিত ধারণাকে একেবারে চুলের মুঠি ধরে নেড়ে দিলেন। জানি না, তাঁর দেখাদেখি কিনা, কাজলও গুপ্ত ছবিতে আদ্যন্ত এক ভিলেনের ভূমিকায় চমকে দিলেন দর্শককে। শুধু ভেবে দেখুন, আগের তিনটে ছবি বাদেও জীবনের শুরুর দিকে কী সব ভূমিকায় অভিনয় করছেন শাহরুখ! রাম জানের চরম ম্যানারিজম, মায়া মেমসাবের অস্থির তরুণ, কভি হাঁ কভি না-তে হতাশ একপেশে প্রেমিক। শাহরুখ খান মানেই তখন নিত্য নতুন চমক। এক একটা ছবি, এক এক ঘরানার, এক এক স্বাদের। কোনও বলিউড অভিনেতা জীবনের শুরুতেই প্রায় সব জঁরের সিনেমায় অভিনয় করেছেন, এমন উদাহরণ আর দু'টি নেই।
তারপর কোথা থেকে কী হইয়া গেল, দিলওয়ালে দুলহনিয়া রিলিজ হইল।
আরও পড়ুন-ফুটপাথ থেকে কেনা হয়েছিল অমিতাভের পোশাক! ‘ডন’ কেন আজও এক ম্যাজিক?
আমার মতে অভিনেতা শাহরুখ ঠিক এখানেই দশ গোল খেয়ে গেলেন নায়ক, রোম্যান্টিক হিরো শাহরুখ খানের কাছে। জানি না, কে বা কারা তাঁকে বুঝিয়ে দিল, এবার এতদিনে তুমি তোমার জায়গা খুঁজে পেয়েছ। কম্ফোর্ট জোন চিনে নিয়েছ। এবার সেই কম্ফোর্টেই খেলে যাও। শাহরুখের বয়স বাড়ছিল। আমার বিশ্বাস তিনিও ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন নিজেকে প্রমাণ করতে করতে। থিতু হবার জন্য এবার চলল লাইন ধরে একই রকম ছবি, একই ম্যানারিজমে বানিয়ে চলা। স্বদেশ কিংবা চক দে যতবার তাঁর জীবনে এসেছে, আমরা ভেবেছি এই তো পুরোনো ছন্দে ফিরছেন শাহরুখ। আমাদের একেবারে ভ্রান্ত প্রমাণ করে আবার তিনি ফিরে গেছেন মন্নতের আরামদায়ক ওমে। উদাহরণ তাঁর সামনে ছিল। ছিল বিরাট লম্বা একদা সব হারানো অমিতাভ বচ্চন, যিনি এই বয়সেও নিজের আগের ইমেজকে পর্দায় ধ্বংস করছেন নিজের হাতে।
একমাত্র শাহরুখ খান এটা পারেন। জানি না, কেন করেন না। তিনি এই অভাগা দেশের শেষ সুপারহিরো। এই মিডিওকারদের দলের শেষ গলিয়াথ। প্রায় ষাটের কোঠায় চলে এসেছেন তিনি। বিজয় সেথুপথি, পঙ্কজ ত্রিপাঠিরা এর অনেক কম বয়েসেই ভারতীয় সিনেমাকে সেরা কিছু প্রৌঢ় উপহার দিয়েছেন। শাহরুখ এখনও পাঠান বানিয়ে হল কাঁপাচ্ছেন, যেখানে আমরা সেই পুরোনো শাহরুখের চর্বিত চর্বন করছি। নতুন কাউকে পাচ্ছি না।
উত্তমকুমার একবার সৌমিত্রকে বলেছিলেন "বুড়ো হলে চুটিয়ে সিনেমা করব, বুঝলি পুলু। তুই আর আমি। এখানে ভাল বুড়ো নেই।" উত্তম নিজে পারেননি।জীবন তাঁকে পারতে দেয়নি; যদিও শেষদিকে মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন। সিনেমায় ভাল বুড়োদের দরকার।
হিরো না... আবার অভিনেতা শাহরুখের জন্ম হোক।