নতুন মহামারীর নাম হবে অবসাদ?

স্বাধীনতার পর এতগুলি বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও মানসিক রোগের চিকিৎসা করালে তা যে আর পাঁচটা অসুখের মতোই নিরাময়যোগ্য এসম্পর্কে সরকার সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালানোর মতো উদ্যোগও বাস্তবায়িত করেনি বলে অভিযোগ।


করোনাভাইরাস কী ক্ষতি করেছে মানবসভ্যতার, তা মানুষের হাড়ে হাড়ে মালুম হয়েছে বিশ্বজুড়েই। করোনার জেরে মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষয়ক্ষতি বহুলচর্চিত বিষয়। তবে যে বিষয়টি অবহেলিত থেকে গিয়েছে, তা হলো, করোনা সংক্রমণ হু হু করে ছড়িয়ে পড়ার পরে বহু মানুষ মানসিক নানা অসুখ-বিসুখের শিকার হয়েছেন। বিশ্বজুড়ে ২০২০ সালের মার্চের পর থেকে এ-পর্যন্ত করোনার জেরে মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দু'ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত বহু মানুষ। প্রথমত, মানসিক অবসাদ এবং দ্বিতীয়ত, উদ্বেগ।

ভারতেও ক্রমাগত উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে মানসিক অবসাদগ্রস্ত এবং অতিরিক্ত উদ্বেগজনিত মানসিক রোগের শিকার মানুষের সংখ্যা। গবেষকরা জানিয়েছেন, হু হু করে বেড়ে চলা অবসাদগ্রস্ত এবং অস্বাভাবিক উদ্বেগের শিকার যে-সমস্ত নাগরিকরা, তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রবীণ। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি প্রকল্পগুলিতে প্রবীণদের জন্য যে সরকারি ভাতার বন্দোবস্ত রয়েছে, তাতে রান্নার গ্যাসের খরচ পর্যন্ত উসুল হবে না। এছাড়া যুবক-যুবতীরাও অবসাদ ও উদ্বেগের শিকার।

করোনা হানা দেওয়ার পর লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন, এমনকী, পরবর্তীকালে কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বাজারে কোনও কাজ জোটাতে না পেরে কাজ খোঁজাই ছেড়ে দিয়েছেন ওই কর্মীদের মধ্যে একটা বড় অংশ। এঁদের অনেকেই ঘরের কোণে পড়ে রয়েছেন, বেকারত্বের যন্ত্রণা কিংবা অর্থাভাব অসহ্য হওয়ায় এঁদের এখন পাগল হওয়ার উপক্রম।

আরও পড়ুন: ঝুঁকির মুখে লাখো চাকুরিজীবীর কষ্টের সঞ্চয়, সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অর্থনীতিবিদরা

এমনিতেই ভারতের বাজারে অর্থকরী কাজের অভাব। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ চাকরিপ্রার্থীদের সংখ্যার তুলনায় নামমাত্র। বেসরকারি সংস্থাগুলিতে যে নিয়োগ হয়েছে, তাও প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প। বেকারের সংখ্যার তুলনায় বিভিন্ন সংস্থার যে নিয়োগ হয়েছে, সেই নিরিখে কাব্য করলে বলতে হবে, 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী'।

'ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি'-র অধ্যাপক বীরেন্দ্র সিং চৌহান করোনা পরিস্থিতিতে ভারতে উত্তরোত্তর অবসাদগ্রস্ত এবং অস্বাভাবিক উদ্বেগের শিকারজনিত সমস্যা সম্পর্কে সম্প্রতি একটি গবেষণা করেছেন। তাতে উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য। যেমন, অধ্যাপক বীরেন্দ্র সিং জানিয়েছেন, অবসাদ এবং অস্বাভাবিক উদ্বেগের অন্যতম প্রধান কারণ রোজগারের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাতে একেবারেই টাকা না থাকাটাও।

এই গবেষণায় গোটা ভারতে মানসিক রোগের চিকিৎসা নিয়ে যে ছুঁৎমার্গিতা এবং নাগরিকদের মধ্যে মানসিক রোগ সম্পর্কে প্রচলিত যে ধ্যানধারণা রয়েছে, সে-বিষয়ে হতাশাজনক তথ্য উঠে এসেছে। অধ্যাপক বীরেন্দ্র সিং-এর নেতৃত্বে চলা 'ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি'-র ওই গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মানসিক রোগ বিষয়টি ভারতে অবহেলিত থাকার কারণে মানসিক রোগের নিরাময়ে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোই গড়ে তোলা হয়নি। বরং কেউ মানসিক রোগী শুনলে বহু ভারতীয় নাগরিক তাঁর প্রতি সমবেদনা দেখানোর পরিবর্তে কার্যত সেই সহ-নাগরিককে একঘরে করে দেন। এই কারণে রোগ হয়েছে টের পেলেও চিকিৎসকের চেম্বারে যাওয়ার মতো মানসিক জোর পান না অনেকেই। উল্টে মানসিক অসুখ গোপন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু রোগ লুকিয়ে কাজের কাজ কিছু হওয়ার নয়। রোগগ্রস্ত মানুষটি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হন পেশাগত জীবন, পারিবারিক জীবন এবং সামাজিক জীবনে।

ভারতে গত নয়ের দশকের গোড়া থেকেই মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। স্বাধীনতার পর দশকের পর দশক পেরিয়ে গেলেও এদেশে মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য একদিকে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি, অন্যদিকে মানসিক রোগ সম্পর্কে ভারতীয় সমাজে নানা ধরনের কুসংস্কার রয়েছে। ফলত, অনেকে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন টের পেলেও সহজে তা প্রকাশ করতে ভরসা পান না সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয়ে।

ভারতে এখন মানসিক রোগীর সংখ্যা কত, এ-সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই সরকারের হাতেও। স্বেচ্ছাসেবীদের হাতেও নেই এ-সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য। ভারতে মোট মানসিক রোগীর সংখ্যা-সংক্রান্ত সর্বশেষ সমীক্ষাটি চালানো হয়েছিল ২০১৭ সালে। ওই সমীক্ষা অনুসারে, সেই সময়েই ভারতে মানসিক অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। এদের মধ্যে সাড়ে চার কোটির বেশি নানা বয়সের মানুষ অবসাদের কারণে মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেননি। বাকি ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যকই উদ্বেগজনিত বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যার শিকার।

স্বাধীনতার পর এতগুলি বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও মানসিক রোগের চিকিৎসা করালে তা যে আর পাঁচটা অসুখের মতোই নিরাময়যোগ্য এসম্পর্কে সরকার সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালানোর মতো উদ্যোগও বাস্তবায়িত করেনি বলে অভিযোগ। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবারই সতর্ক করেছে, মানসিক রোগে আক্রান্তর হলে তার চিকিৎসা না করানো হলে কার্যত সেটা গোটা সমাজের ওপরই ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। এমনকী, রোগাক্রান্ত মানুষটির কর্মক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকে। যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই মানুষটির পেশাগত জীবন।

গবেষণায় এও দেখা গিয়েছে, মানসিক রোগের অন্যতম কারণ ইঁদুরদৌড়- যা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কে পর্যবসিত করেছে। এব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, যে কোনও নাগরিকদের মধ্যে মানসিক অসুখবিসুখ বাড়লে আখেরে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গোটা সমাজই।

বেঙ্গালুরুর 'ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মেল্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্স'-এর তথ্য অনুসারে, ভারতের মানসিক রোগে আক্রান্ত নাগরিকদের মধ্যে ৮০ শতাংশ চিকিৎসার কথা ভাবেনও না। এর কারণ সচেতনতার অভাব।

তবে ২০২২-২০২৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা যাতে নাগরিকরা লাভ করতে পারেন, এজন্যে 'টেলি-মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রাম' চালু করে এই খাতে ৯৩২ কোটির বেশি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এ-ব্যাপারে 'ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি'-র অধ্যাপক বীরেন্দ্র সিং চৌহান বলেছেন, কেন্দ্রীয় বরাদ্দ টাকার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় কম।

প্রবীণদের মনের হালহকিকত সম্পর্কে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালিয়েছে ওয়াশিংটনের 'ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস'। তাতে নতুন কিছু তথ্য জানা গিয়েছে। করোনা-আক্রান্ত প্রবীণদের মধ্যে ৪৯ শতাংশই অতিরিক্ত মানসিক উদ্বেগের শিকার। আরও দেখা গিয়েছে, করোনা সংক্রমিত হওয়ার পরে আবিশ্ব প্রবীণ নাগরিকদের ভেতর ৪০ শতাংশই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে বৃদ্ধ বয়সে রোগভোগের পাশাপাশি তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের শিকার। এর ফলে জীবনযাপনের মানের অবনতির পাশাপাশি ওই বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জীবনে নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণাও বেড়েছে।

একই ফলাফল 'লন্ডন ইউভার্সিটি কলেজ'-এর আরেকটি গবেষণায়। লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজ-এর গবেষক এলি আইওব জানিয়েছেন, মানসিক এই যন্ত্রণা দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে। সহজে সারছে না।

More Articles