ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরনোর মুহূর্তে বনলতা সেন আবৃত্তি করেছিলাম

Muhammed Zafar Iqbal: আজ আর সেই ঘটনার কোনও গুরুত্ব নেই আমার জীবনে। তবে, বেচারা ছেলেটির জন্য আমার মায়া হয়। গোটা জীবনটা ছেলেটিকে জেলবন্দি হয়ে কাটাতে হবে।

সকালবেলা আমার ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে আমি বাসা থেকে বের হয়েছি। সিলেটের বাসায় আমি একা, আমার স্ত্রী ইয়াসমিন এখানে নেই। আমার মেয়ে ইয়েশিম সন্তানসম্ভবা হিসেবে ঢাকা বেড়াতে এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে এই দেশে সন্তান জন্ম দেবে। সে জন্যে যখন সম্ভব হয় আমার স্ত্রী তার সাথে থাকে৷ ইয়াসমিন যদি ঢাকা না থেকে মার্চ মাসের ৩ তারিখ সিলেটে আমার সাথে থাকত, তাহলে পরবর্তী ঘটনা অন্য রকম হতে পারত।

বাসা থেকে বের হয়ে আমি যেই ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি সাথে সাথে আমাকে নিরাপত্তা দেওয়া পুলিশ বাহিনী আমার সাথে সাথে হাটতে শুরু করল। এটা হচ্ছে এখন আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডি- আমি আর স্বাধীনভাবে কোথাও যেতে পারি না। সবসময় আমার সাথে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর লোকজন থাকে। যদি এরকম হতো যে, সাদা পোশাকের একজন একটু দূর থেকে আমার দিকে লক্ষ রাখছে, সেটাও মেনে নেয়া যেত। কিন্তু বেশ কয়েকজন পুলিশ সবসময় আমাকে সামনে-পিছনে ঘিরে রেখে আসামির মতন নিয়ে যাচ্ছে, সেটা জীবনের অনেক বড়ো ট্র্যাজেডি। আমার মনে আছে, আমাদের জালালাবাদ থানার ওসির কাছে আমি একদিন কাতরভাবে আমাকে এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। তিনি তার পকেট থেকে একটা বিশাল চিঠি বের করে দেখালেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই চিঠিতে আমাকে কীভাবে দেখেশুনে রাখতে হবে তার বিশদ বর্ণনা দেয়া আছে। আমি যখন ডিপার্টমেন্ট থেকে বাসায় যাব তখন সামনে কতজন এবং পিছনে কতজন কী অস্ত্র নিয়ে হেঁটে যাবে, সেটাও বলে দেওয়া আছে। সেই চিঠিটি এতই হৃদয়বিদারক যে এক-দুই লাইন পড়ে বাকিটা পড়ার কৌতূহল-আগ্রহ সবই হারিয়ে ফেললাম ।

ব্যাপারটি ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে। প্রথমে ছিল মাত্র দু'জন পুলিশ। সেটাই আমার জন্যে অনেক বড়ো একটা ব্যাপার ছিল। প্রথম যখন আমাকে পুলিশ দেওয়া হয়েছে তখন জঙ্গিদের সাথে সাথে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী ওলামা লীগ- সবাই আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে! ব্যাপারটা আমি কোনোভাবেই বোঝাতে পারব না, তাই চেষ্টাও করব না। ইংরেজিতে 'অ্যাক্টিভিস্ট ফানি' তারপর আমার নাম লিখে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে ইউটিউবে ১৭ সেকেন্ডের একটা ভিডিও পাওয়া যায়, সেটা দেখলেই শুধুমাত্র আন্দোলনটার রহস্য খানিকটা বোঝা যেতে পারে।

এদিকে দেশে জঙ্গিদের তাণ্ডব খারাপ থেকে খারাপ হতে থাকল। হোলি আর্টিজানের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে শুধু সারা দেশ নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ শিউরে উঠল। জঙ্গিদের যেকোনো তালিকায় আমার নাম সবসময় একেবারে উপরের দিকে থাকে। শুধু তা-ই না, তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের অনেককে এর মাঝে হত্যা করা হয়ে গেছে। এতদিন আমি একা হত্যার হুমকি পেয়ে এসেছি, ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ইয়াসমিনকেও হত্যার হুমকি দেয়া হলো ('আমাদের নূতন তালিকায় আমন্ত্রণ, যেকোনো সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে' আনসারউল্লাহ বাংলা টিম) এবং আমি আমার নিয়মিত হুমকি পেতে থাকলাম ।

আরও পড়ুন- হার্ডকভার মস্তিষ্ক, হৃদয় পেপারব্যাক! দু’য়ে মিলেই গড়াচ্ছে ফরাসি বইবাজারের চাকা

আমি যদিও এ ধরনের হুমকি পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি কিন্তু দেখলাম হঠাৎ করে পুলিশ পুরো ব্যাপারটাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছে। আমার সাথে আলাদাভাবে যোগাযোগ করে তারা আমাকে জানাল তাদের কাছে নানা রকম তথ্য আছে এবং আমি একটা মারাত্মক ঝুঁকির মাঝে আছি। জঙ্গিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেকোনো উপায়ে আমাকে হত্যা করতে হবে, কাজেই আমি আর আমার নিরাপত্তা নিয়ে হেলাফেলা করতে পারব না। আমি হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম, অসংখ্য পুলিশ সারাক্ষণ আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে ঘিরে থাকে, আমি যেখানেই যাই, একটা পুলিশের গাড়ি আমার পিছু পিছু যেতে থাকে। যারা আমার শুভাকাঙ্ক্ষী তারা আমার নিরাপত্তা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এবং আমি আমার নিরাপত্তার বহর দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম!

যাই হোক, বাসা থেকে বের হয়ে আমি আমার বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে আমাদের সেন্ট্রাল অডিটোরিয়ামে হাজির হয়েছি। অডিটোরিয়ামের দোতলায় কার্নিভালের একটা বড়ো প্রতিযোগিতা হবে। একটা জটিল পথ তৈরি করা আছে, ছেলেমেয়েদের তৈরি করা রোবটগুলোকে সেই পথ অনুসরণ করে যেতে হবে। শুধু তা-ই নয়, যাওয়ার সময় রোবটগুলোকে নানা রকম জটিল কাজকর্ম করতে হয়। রোবট নিয়ে এই প্রতিযোগিতাগুলো খুবই নূতন, কিছুদিন আগেও দেশে এগুলো ছিল না। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে ট্রিপল ই ডিপার্টমেন্টটা নূতন, অভিজ্ঞ শিক্ষক দূরে থাকুক, কাজ চালানোর মতো শিক্ষকও নেই, তারপরেও ছাত্রছাত্রীরা খুব উৎসাহ নিয়ে সবকিছু করে যাচ্ছে। একেবারে নূতন ডিপার্টমেন্ট হওয়ার পরও প্রায় সময়ই চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগটি তৈরি হওয়ার পর আমাকে তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, আমার ইচ্ছে ছিল কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগটা যেভাবে সবাইকে নিয়ে দাঁড় করিয়েছিলাম, এটাকেও সেভাবে দাঁড় করাব। কিন্তু মাঝখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন নোংরামো শুরু হয়ে গেল যে আমার এই প্রশাসনের সাথে কাজ করার রুচি হলো না। তাই ক্লাস নেয়া ছাড়া বাকি সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়েছিলাম। নূতন ভাইস চ্যান্সেলর আসার পর আবার কিছু কিছু দায়িত্ব নিয়েছি, সেই হিসেবে আবার ট্রিপল ই ডিপার্টমেন্টটার দায়িত্ব ঘাড়ে এসেছে (নতুন ভাইস চ্যান্সেলরকে বলেছিলাম এক শর্তে দায়িত্ব নিতে পারি, কোনোদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো মিটিংয়ে থাকব না, তিনি তাতেই রাজি হয়েছেন)।

সেন্ট্রাল অডিটোরিয়ামের দোতলায় যেখানে রোবটদের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে, তার এক পাশে আমাদের বসায় জায়গা করে দেয়া হয়েছে। একটু দূরে আমার পুলিশ বাহিনী, তারা আমাকে পাহারা দিচ্ছে। আমি সেখানে বসে বসে প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে বই পড়ছি। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা যখন কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় তখন সত্যিকারের প্রতিযোগিতা থেকে অংশগ্রহণকারীদের চোখ-মুখের উত্তেজনা আমার কাছে বেশি চমকপ্রদ মনে হয়। আমার ধারণা বেশিরভাগ মানুষ এটা জানে না। আজকাল স্মার্টফোন নামে একটা বিচিত্র যন্ত্র বের হয়েছে, যখন কিছু করার থাকে না তখন বেশির ভাগ মানুষ এই স্মার্টফোনের ছোট স্ক্রিনে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করে। কিন্তু তারা যদি একবার চোখ খুলে চারপাশে তাকাত, তাহলে তারা দেখত চারপাশের জগৎটা কত জীবন্ত, কত চমকপ্রদ, কত চিত্তাকর্ষক। পৃথিবীর এই বিচিত্র উত্তেজনায় কেউ একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে সে আর স্মার্টফোনের এই ছোট স্ক্রিনটিতে কখনো সন্তুষ্ট হতে পারত না।

একসময় প্রতিযোগিতা শেষ হলো, আমরা চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম তখন ছেলেমেয়েরা জানাল সবার জন্যে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের জন্যে আলাদা আয়োজন করার চেষ্টা করছিল, আমি তাদেরকে সেই সুযোগ দিলাম না। সবার সাথে সেন্ট্রাল অডিটরিয়ামের সিঁড়িতে বসে গেলাম। এরকম অনুষ্ঠানে যেরকম খাবার দেয়া হয়, সেরকমই আয়োজন, লাঞ্চ প্যাকেট! বয়স কম থাকলে শখ করে খেয়ে ফেলা যায়, আমাকে পরিশ্রম করে খেতে হয়। খাওয়া শেষ হলে আবার হাত ধুতে হয়, সে জন্যে আমি খাওয়াটা সহজ করে ফেলেছি। প্যাকেটের একটা অংশ ছিড়ে একটা চামচ তৈরি করেছি, সেটা দিয়ে যেটুকু খাওয়া যায় সেটুকুই খাই। 

খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম ছিন্নমূল কিছু শিশু একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে পলিথিনের ব্যাগ। বোঝাই যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের খাওয়া শেষ হবার পর তারা উচ্ছিষ্টগুলো নেবে। বিষয়টা আমাকে খুবই পীড়া দেয়। আমাদের দেশে এখন এমন কোনো খাবারের অভাব নেই যে দেশের ছেলেমেয়েদের অন্যের উচ্ছিষ্ট খেতে হবে। এই কমবয়সি ছেলেমেয়েরা এরকম অসম্মান এবং অমর্যাদার ব্যাপার কোথা থেকে শিখেছে কে জানে। আমি আয়োজকদের ডেকে জানতে চাইলাম তাদের কাছে বাড়তি খাবার প্যাকেট আছে কি না, যেগুলো এই ছেলেমেয়েদের দেয়া যাবে। তারা জানাল তাদের কাছে যথেষ্ট খাবার রয়ে গেছে। আমি তখন ছিন্নমূল ছেলেমেয়েগুলোকে ডেকে পাঠালাম, তারা খানিকটা ভয়ে ভয়ে আমার কাছে এলো। আমি তাদেরকে আমার কাছে বসিয়ে সবার হাতে একটা করে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে বললাম, "তোমরা কেউ খাবার বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে না। তোমাদেরকে এখানে বসে আমাদের সাথে খেতে হবে।”

সিঁড়িতে বসে আমাদের সাথে খেতে শুরু করল। পুরোটা খেয়ে শেষ করতে পারল না- বাকি খাবার পলিথিনের প্যাকেট করে বাড়ি নিয়ে গেল। আমি আগেও লক্ষ্য করেছি, এই বাচ্চাগুলো কখনোই একা একা খেতে চায় না, বাড়তি কিছু খাবার পেলেই সবাই মিলে খাওয়ার জন্যে বাড়ি নিয়ে যায়। 

বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের আইআইসিটি বিল্ডিংয়ে একটা সিম্পোজিয়াম হচ্ছে। বাংলা ভাষার ওপর সিম্পোজিয়াম; দেশের নানা জায়গা থেকে ভাষাবিদ, কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা এসেছেন; ইন্ডিয়া থেকেও একজন এসেছেন। তাদের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে এবং আমি লক্ষ্য করলাম, বাইরে ছিন্নমূল শিশুরা উচ্ছিষ্ট খাবারের জন্যে জড়ো হয়েছে। আমি আবার খোঁজ নিয়ে জানলাম আমাদের কাছে বাড়তি খাবার আছে। তখন সবগুলো বাচ্চাকে আমি ভেতরে ডেকে নিয়ে এসেছি। বড়ো বড়ো অতিথিরা যে চেয়ার এবং টেবিলে বসে খেয়েছেন তাদেরকেও সেই চেয়ারে বসিয়েছি। সবার সামনে সুদৃশ্য প্লেট, ন্যাপকিন এবং চামচ। আমার সহকর্মীরা ডিশে খাবার এনে তাদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে লাগল । বাচ্চাগুলো প্রথমে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, কারণ তারা সারা জীবনই দেখে এসেছে বড়ো জায়গায় কিংবা ভালো জায়গায় তাদের ঢোকার অধিকার নেই। গেটে দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে, যখনই কোনো বাচ্চা উঁকি-ঝুঁকি দেয় তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় (মহাখালী ডি.ও.এইচ.এস- এর গেটে পরিষ্কার করে লেখা আছে টোকাই প্রবেশ নিষেধ!) ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে গিয়ে প্রথমে তাদের একটু অস্বস্তি হলো কিন্তু কিছুক্ষণেই সেই অস্বস্তি কেটে গেল এবং যথেষ্ট গাম্ভীর্য এবং আনন্দ নিয়ে তারা খাবার শেষ করল। কাউকে সম্মান দেখালে সেও যে পাল্টা সম্মান দেখাতে শেখে, এই সহজ বিষয়টা অনেকেই সারা জীবনেও শিখতে পারে না।

লাঞ্চ শেষ করে আমরা আমাদের মুক্তমঞ্চের দিকে রওনা দিলাম। মুক্তমঞ্চ হচ্ছে হ্যান্ডবল গ্রাউন্ডের পাশে পাকাপাকিভাবে তৈরি করা একটা মঞ্চ, পিছনে সুদৃশ্য ম্যুরাল। ছাত্রছাত্রীরা যখন কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে যায় তাদের বড়ো একটা খরচ হয় মঞ্চ তৈরি করার পিছনে। এই মঞ্চটা পাকাপাকিভাবে থাকার কারণে এখন আর সেই যন্ত্রণা নেই। মুক্তমঞ্চের মাঠে রোবটদের 'মারামারি' প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এরকম যে একটা প্রতিযোগিতা আছে আমি সেটাও জানতাম না।

মুক্তমঞ্চে যাবার পথে বেশ কিছু টং রয়েছে। এই টংগুলো ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের খুব প্রিয় জায়গা। সবসময়েই ছেলেমেয়েরা সেখানে ভিড় করে আড্ডা দেয়। আমার সাথে যে কমবয়সি শিক্ষকেরা ছিল তারা আমাকে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, চা খাবেন?”

আমি আগ্রহের সাথে রাজি হলাম। কমবয়সে এরকম জায়গায় চা খেয়ে, আড্ডা মেরে জীবনের অনেক সময় কাটিয়েছি। এখন আর সেরকম সুযোগ খুব বেশি হয় না!

কাছাকাছি যে টংটা ছিল, আমরা সেখানে ঢুকে গিয়েছি। একটা বেঞ্চে বসে চায়ের অর্ডার দেয়া হলো। এইসব টংয়ের চায়ের একটা বিশেষ চরিত্র আছে, যেটা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। সবাই মিলে গল্পগুজব করে চা খাওয়া শেষ করেছি, কাছাকাছি একটা জায়গায় বসে পুলিশ বাহিনী আমার ওপর চোখ রাখছে ।

টং থেকে বের হয়ে আমি আবার আমার কমবয়সি শিক্ষকদের নিয়ে মুক্তমঞ্চের দিকে হাঁটতে থাকি। কাছাকাছি গিয়ে বুঝতে পারলাম মুক্তমঞ্চটা আসলে আমাদের বসার জায়গা। সেখানে সোফা রেখে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মুক্তমঞ্চের সামনে উঁচু একটা বেদি তৈরি করা হয়েছে। সেই বেদির ওপরে রোবটে-রোবটে মারামারি হবে। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ছাত্রছাত্রীরা নানারকম ভয়ংকর দর্শন রোবট নিয়ে এসেছে। দুটো করে রোবট দুই পাশ থেকে একটা ঢাল বেয়ে বেদির ওপরে উঠে একে অন্যের সাথে ধাক্কাধাক্কি-ঠেলাঠেলি করতে থাকে। যে রোবট অন্যটিকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিতে পারে সে বিজয়ী!

আমরা মঞ্চের উপর সোফায় আরাম করে বসেছি। নানা ধরনের প্রস্ততি নিয়ে শেষ পর্যন্ত রবোটে-রবোটে মারামারি প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আমি আগে কখনো এ ধরনের প্রতিযোগিতা দেখিনি, তাই বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রতিযোগিতাগুলো দেখছি। বিষয়টার মাঝে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা আছে, তবে নিষ্ঠুরতাটুকু যেহেতু রোবটের সাথে রোবটের, এটাকে মোটামুটি মজার একটা বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া যায়! মারামারিগুলো হয় রোবটের সাথে রোবটের, কিন্তু রোবটগুলো তৈরি করেছে ছাত্রছাত্রীরা। বিজয়ী কিংবা হেরে যাওয়া রোবটের মাঝে আনন্দ কিংবা দুঃখ না থাকলেও যারা তৈরি করেছে, সেই ছাত্রছাত্রীদের চোখে-মুখে আনন্দ কিংবা আশাভঙ্গের ছাপ খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

দু'টি রোবটের প্রতিযোগিতা শেষ হবার পর নূতন দুটোকে প্রস্তুত করে আনতে অনেক সময় লাগছিল, সেই সময়টুকু আমি বই পড়ে কাটিয়ে দিচ্ছি।

দেখতে দেখতে সূর্য ঢলে পড়তে শুরু করেছে। প্রতিযোগিতাগুলো শেষ হবার পর সেন্ট্রাল অডিটরিয়ামে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠান শেষ হলেই ছেলেমেয়েদের আয়োজন করা কার্নিভাল শেষ হবে। এটি এই ছেলেমেয়েদের আয়োজন করা প্রথম অনুষ্ঠান, আমিও চাইছি তারা সুন্দর করে শেষ করুক। তাহলে পরেরবার আরো অনেক উৎসাহ নিয়ে এরকম কিছুর আয়োজন করতে পারবে। আমি নিজে আমার বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে যতটুকু লেখাপড়া করেছি, তার থেকে অনেক বেশি করেছি এ ধরনের অনুষ্ঠান! এই সময়টুকু হচ্ছে ছেলেমেয়েদের জীবন উপভোগ করার সময়, বইয়ের পৃষ্ঠা আর ক্লাসরুমের চার দেওয়ালের ভিতর আটকা থেকে এই সময়টা শেষ করে দিলে তারা জীবনটা উপভোগ করবে কখন?

রোবটে-রোবটে সংঘাতের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আমি একবার পিছনে ফিরে তাকালাম। তিনজন পুলিশ আমার পিছনে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে স্মার্টফোন! সারাক্ষণ একটি মানুষকে চোখে চোখে রাখা নিশ্চয়ই খুব বিরক্তিকর কাজ। আমাদের এই ক্যাম্পাসটির প্রায় পুরোটুকুই আমরা ওয়াইফাইয়ের আওতায় এনে রেখেছি। একঘেয়ে নিরানন্দ ডিউটি করার ফাঁকে ফাঁকে পুলিশের সদস্যরা সেই ওয়াইফাই ব্যবহার করে স্মার্টফোনে সময় কাটাতেই পারে।

ধীরে ধীরে বিকেল হয়ে এসেছে। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছি। তখন হঠাৎ করে আমার মনে হলো আমার মাথার ওপর কিছু ভেঙে পড়েছে। কী হয়েছে বুঝতে না বুঝতেই আবার এবং আবার এবং আবার। মাথার ওপরে আঘাত এবং আঘাত, হতেই থাকল। পিছনে মানুষের হুটোপুটির শব্দ এবং চিৎকার। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবুদ্ধি, ঠিক কী করেছি মনে নেই। নিজেকে রক্ষা করার জৈবিক তাড়নায় নিশ্চয়ই মাথায় হাত দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছি, ডান হাতে বইটি ধরে রাখা ছিল, তাই বাম হাতে। পিছনে একধরনের হই-হল্লা শুনতে পেলাম। আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে মুক্তমঞ্চের সামনে কয়েক পা এগিয়ে গেলাম এবং তখন আমি বুঝতে পারলাম কেউ একজন আমাকে আক্রমণ করেছে। 

সেই মুহূর্তে আমার ভেতরকার অনুভূতিটি ছিল লজ্জার অনুভূতি। আমার মনে হলো, এই পৃথিবীতে এরকম মানুষ আছে যে আমাকে এত ঘৃণা করে যে সে আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে? এত মানুষের মাঝে প্রকাশ্যে সে আমাকে খুন করতে চায়? সত্যিই কি আমি এত ঘৃণিত একজন মানুষ? সবার কাছে না হলেও কারো কারো কাছে? মানুষটি কে? আমাদের কোনো ছাত্র?

ততক্ষণে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছি, যে মানুষটি আমাকে মারতে চেয়েছে তাকে ধরে সবাই মিলে পিটাতে শুরু করেছে। আমি পিছন ফিরে সেই দৃশ্যটি দেখার চেষ্টা করলাম না। মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকালাম। তারা অবর্ণনীয় আতঙ্কে চিৎকার করছে। কেন এই অবর্ণনীয় আতঙ্ক আমি বুঝতে পারলাম না। আমি তাদের শান্ত করার জন্য বললাম, “আমার কিছু হয় নাই। আমি ঠিক আছি। আমি ঠিক আছি!”

কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার কথায় কেউ শান্ত হলো না। আমার একটা ছাত্রীর দিকে আমার চোখ পড়েছে, সে দুই হাত মুখের সামনে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য আতঙ্কে চিৎকার করছে। আমি খানিকটা বিচলিত হয়ে নিজের মাথায় হাত দিলাম এবং রক্তের উষ্ণ একটি ধারা অনুভব করলাম। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া বলে একটা কথা আছে। মনে হয় সেই ব্যাপারটিই ঘটেছে। পরিচিত একজন মানুষ একটা মঞ্চে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে এবং তার মাথা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, দৃশ্যটি নিশ্চয়ই খুব ভয়ংকর একটি দৃশ্য। আমি বুঝতে পারলাম আমি আসলে 'ঠিক' নেই, আমাকে বাঁচাতে হলে এই মুহূর্তে হাসপাতালে নিতে হবে।

ততক্ষণে চারপাশ থেকে আমার ছাত্র আর সহকর্মীরা আমাকে ধরে ফেলেছে। আমি দেখলাম যে পুলিশের গাড়িটি সার্বক্ষণিকভাবে আমার পিছনে পিছনে যেতে থাকে এবং যে গাড়িটিকে আমি এতদিন অকারণে বিশাল একটি অপচয় হিসেবে দেখে এসেছি, সেটি মুক্তমঞ্চের পাশে চলে এসেছে। আমার কোনো অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে না। আমার ছাত্র এবং সহকর্মীরা আমাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। একজন তার শার্ট খুলে খালি গা হয়ে শার্টটি দলামোচা পাকিয়ে রক্ত বন্ধ করার জন্য আমার মাথায় চেপে ধরল। আমি হাঁটতে পারছিলাম, কিন্তু তারপরেও ছাত্ররা আমাকে পাঁজাকোলা করে সাদা মাইক্রোবাসের কাছে নিয়ে যেতে থাকে। যখন আমাকে মুক্তমঞ্চের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তখন এক ঝলকের জন্যে আমার চোখে একটা চাকু চোখে পড়ল। চাকুটি মঞ্চের ওপর পড়ে ছিল, কমান্ডোরা ব্যবহার করে সেরকম ভয়ংকর দর্শন একটা চাকু। আমি অনুমান করলাম এই চাকুটি দিয়েই সম্ভবত আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল।  

আরও পড়ুন- আজ যা দেখছেন, কাল সবই ভুল! বিজ্ঞানীদের কাছেও কেন বিস্ময় ‘ম্যান্ডেলা এফেক্ট’?

 আমি সরাসরি তাকাইনি কিন্তু তারপরও বুঝতে পারলাম, যে মানুষটি আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে, মুক্তমঞ্চের ওপর ফেলে তাকে সবাই মিলে অমানুষিকভাবে পেটাচ্ছে। যারা আমার আশেপাশে ছিল আমি তাদের বললাম, কেউ যেন তাকে না পিটায়।

সবাই মিলে একজন মানুষকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে যাচ্ছে দৃশ্যটি খুবই অমানবিক। শুধু তা-ই নয় - আমার মনে হলো, সবাই মিলে পিটিয়ে এই মানুষটিকে এখানে মেরেও ফেলতে পারে। 

আমাকে পাঁজাকোলা করে মাইক্রোবাসটির ভেতরে বসিয়েছে। আরো কয়েকজন ছাত্র উঠেছে, তার সাথে আমার এককালীন ছাত্র এবং বর্তমান সহকর্মী হৃতেশ্বর আছে। তার বসার অবস্থা নেই, কোনোভাবে দাঁড়িয়ে আমাকে ধরে রেখেছে এবং মিনিটের মাঝে গাড়িটি আমাকে নিয়ে হাসপাতাল রওনা দিয়ে দিল।

আমি বুঝতে পারলাম মুহূর্তের মাঝে খবর ছড়িয়ে যাবে। আমার স্ত্রী, কন্যা এবং ভাই-বোন তাদেরকে খবরটা আমার নিজের মুখে দিতে হবে। আমি আমার মোবাইল ফোনটা বের করে প্রথমে আমার স্ত্রীকে ফোন করলাম, কেউ ফোন ধরল না। আমি তখন আমার মেয়েকে ফোন করলাম, সে সাথে সাথে ফোনটি ধরল, আমি বললাম, 'ইয়েশিম, আমাকে একজন আ্যাটাক করেছে। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক ব্লিডিং হচ্ছে। ইয়াসমিনকে বলে দিও।” আমার মেয়ে খুব শান্তভাবে খবরটি নিল, তারপর বলল, “ঠিক আছে আব্বু।” সে নিশ্চয়ই গাড়ি করে কোথাও যাচ্ছিল, শুনলাম, ড্রাইভারকে বলছে, “গাড়ি ঘোরাও। বাসায় চলো।”

প্রায় সাথে সাথে ইয়াসমিন ফোন করল। বুঝলাম আমার মেয়ে ইয়েশিম তাকে খবর দিয়ে দিয়েছে। আমি বললাম, “আমাকে একজন আ্যাটাক করেছে। দেখতেই পাচ্ছ আমার জ্ঞান আছে, আমি কথাও বলতে পারছি। কিন্তু প্রফিউজলি ব্লিডিং হচ্ছে। কী হবে জানি না। হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। তুমি সবাইকে জানাও, নাবিলকেও জানাও, কেউ যেন টেলিভিশন থেকে খবরটা না পায়। যেন সরাসরি তোমার কাছ থেকে শুনে।”

ইয়াসমিনও আমার মেয়ের মতন খুবই শান্তভাবে খবরটা গ্রহণ করল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “ব্যথা করছে?” 

আমি তখন বুঝতে পারলাম আমার কোনো ব্যথা নেই। “না, কোনো ব্যথা নেই ।”

ইয়াসমিন বলল, “ঠিক আছে। আমি দেখছি।”

পরে জানতে পেরেছি, আমার সাথে কথা বলার পর মুহূর্ত থেকে তার টেলিফোনে এত ফোন আসতে শুরু করল যে সে তার ফোন আর ব্যবহার করতে পারেনি! 

আমি বুঝতে পারছিলাম গলগল করে আমার শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছে। সারা শরীর উষ্ণ রক্তে ভিজে গেছে। কালো টি-শার্ট পরে আছি, তাই দেখে কেউ বুঝতে পারবে না! একজন মানুষের শরীরে কত রক্ত থাকে এবং কত রক্ত বের হয়ে গেলে তার জীবন সংশয় হয় আমার জানা নেই। আপাতত সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই । আমি আমার হাতে ধরে রাখা টেলিফোনটা একটা ছাত্রের হাতে ধরিয়ে দিলাম, সেটাও তখন বাজতে শুরু করেছে। এখন আর টেলিফোনে কথা বলার অবস্থা নেই।

আমি আমার ছাত্রের শার্টটি মাথায় চেপে বৃথাই রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার মনে হলো আমার একমাত্র সম্বল হচ্ছে আমার এই মস্তিষ্কটি। আমি বেঁচে আছি এই মস্তিষ্কটির জন্যে! যদি আমার মস্তিষ্কের কিছু হয়ে থাকে তাহলে আমার বেঁচে থাকার অর্থ কী? আমার মনে হলো আমি একটু পরীক্ষা করে দেখি আমার মস্তিষ্কটি কাজ করছে কি না। ফিবোনাচি সিকোয়েন্স গণিতের একটা পরিচিত সিকোয়েন্স, এর প্রথম পদ শূন্য, পরেরটি হচ্ছে এক। আগের দু'টি যোগ করলে পরেরটি বের হয়। আমি ফিবোনাচি সিকোয়েস বের করতে শুরু করলাম, এক, এক, দুই, তিন, পাঁচ, আট. তেরো, একুশ, চৌত্রিশ, পঞ্চান্ন - দেখলাম মোটামুটি বের করতে পারছি। তার মানে মস্তিষ্ক এখনো গাণিতিক হিসাব করতে পারছে। এবারে আমি মনে মনে একটা কবিতা আবৃত্তি করার চেষ্টা করলাম, প্রিয় কবিতা, জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন- 

হাজার বছর ধ'রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, 
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে 
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে 
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর কোনো এক বিদর্ভ  নগরে; 
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন

দেখলাম পুরো কবিতাটাই মনে আছে। যদি স্মৃতিশক্তি থেকে থাকে এবং গণিতের হিসাব করতে পারি তাহলে মস্তিষ্কটা নিশ্চয়ই কাজ করছে। আমি নিজের ভেতরে একধরনের ভরসা পেলাম । তাহলে বেঁচে থাকার জন্যে চেষ্টা করা যেতে পারে!

 

মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনুমতিক্রমে তাঁর উপর নেমে আসা আক্রমণের উত্তরে লেখা গ্রন্থ 'অবিশ্বাস্য সুন্দর পৃথিবীর অংশ বিশেষ প্রকাশিত হলো।

More Articles