কাবাবের গন্ধ নয়, ইফতারের সন্ধে নামে মুড়ি-চপ-বেগুনিতে

এমন চাঁদি ফাটা রোদ্দুরে ঘুরে বেড়াসনি বাপ! কথা শোন বাপজান! কলিজা ভিজিয়ে পানি দিব, ছাওয়ায় পাটি পেতে দিব, আয় বাছা, ঘরে আয়!

মায়ের এমন ডাকখান ওই গরম হাওয়ার ঘূর্ণি হয়ে ঘুরে ঘুরে পাক খেয়ে ফিরছে মাঠে মাঠে। সে ডাক, মায়ের কোলপোছা ছেলেদের, গভ্ভো আগলানো মেয়েদের কেবলই কি ঘরে ফেরাতে চাইছে? সে ডাক কি ফুরিয়ে আসা রমজানের দুপুরে মানুষকে দু'-দণ্ড জিরেন দিতে চাইছে না! চাইছে তো। নিয‍্যস চাইছে। সে ডাক কি শুনতে পায়নি আমাদের নাইরুল? পেয়েছে তো। পেলেই বা কী করবে বলো সে! পরব পেরোলে বড় বুইনের সাদি। দু'-বাড়ির কথা হয়েই আছে। এখন পরব ফুরোলেই হয়। রমজানের আগুনঢালা বোশেখ দুপুরে নাইরুল তাই বসে বসে খোয়া ভাঙছে আর খোয়া ভাঙছে। ওর মায়ে কি ওরে ডাকে? নাহ্! ডাকলে কি আর সংসারী মানুষের চলে! সাদি-র বাজার-হাট করবে যারা, যাদের বড় বুইনের সাদি, তাদের কি এমন আগুনে কলিজা ভেজানোর সাধ হতে আছে! নেই তো। নাইরুল তাই বসে বসে ওই দূরের আকাশখানা দেখে আর ভাবে, ইদগাহ-র পাশটিতে সেই যে একখান সাদা সাদা ফুলের গাছ আছে, সে গাছে কুঁড়ি এলে মানুষ বোঝে, আজ-কাইল করে জল হবে। সে গাছের কাছে আপনাদের হাওয়া আপিস ফেল মেরে গেছে। নাইরুল যদি সে গাছের নাম জানত! আহা রে, পোলাপাইন!


সে গাছের ফুল তো টেকে না মোটে। সে ফুল ঝরে যাবে বলেই তো ফোটে! এসবই ভাবে আমাদের নাইরুল। ভাবতে ভাবতে বড় পিপাসা লাগে ওর। বড় চাচি বলে, এক খাবলা গুড় দিব? পানি খাবি? দানা দানা গুড় দিয়ে পানি খাইতে যা সুখ, সে কেবল জানে আমাদের খোয়া ভাঙা নাইরুল। এই তো আম্মার মোট সাতাইশ রোজা হইল। আর ক'খান পেরোলেই এক ফালি কাস্তের পারা চাঁদ উঠব আশমানে। এই মাঠের ধারে দাঁড়ালে তখন মরা আলোয় দেখা যাবে সোনালি ধানের ক্ষেত। সে কি সোনালি ফসলের ভারে নুয়ে পড়তে চাইছে? না কি মাজরা পোকায় ফুটিফাটা করে দিয়েছে সোনালি ফসলের বুক! নাইরুল জানে এসব। এসব জেনেও রেডিও-র নব ঘোরাবে ও, যেমন ঘোরায়। রেডিও-র ঘোষণা দিলে পাড়ায় পাড়ায় ইদের তোড়জোর শুরু হবে। হালুয়া হবে, চেলে রুটি হবে, মাংস হবে। এমন কাস্তেচেরা আলোয় নাইরুল ওর গেঁজে থেকে কড়কড়া নোট দু'খান মায়েরে দিবে। মায়ে বলবে, নারু, এত দিস ক্যান! নারু তখন হাসবে।

আরও পড়ুন: পান্তা আর চুনো মাছের বাসি টক || জিভের হিসেব কলিজার হিসেব

এসব ভাবতে ভাবতে নারু ইট ভাঙে, খোয়া ভাঙে। কেউ তো নারুরে বেলের পানা এগিয়ে দেয় না, দেবেই বা কেন! নারু কি আর তেমন ছেলে! নারুর অবিশ্যি দুঃখু নেই। মায়ে রজা রাখছে, বুইনে বিকেল বিকেল ডালের বড়া ভাজবে, ফালি ফালি তরবুজ কাটবে। নুরু তো জানেই এসব। নুরুর তাই দুঃখ নেই। দুঃখ বলো, শোক বলো, সে একটাই। বড় বুইনের পারা কেউ কি পারে অমন ফিনফিনা রুটি বেলতে! পারে না। কেউ পারে না। কেউ কি পারে সাকিনার মতো মুরগির সালন রানতে? কেউ না। মোটে না। মায়ের করা সালন ফিকা লাগে, বড় ফিকা। অবিশ্যি মায়ে কেমন নারকেল দে, পোলাওয়ের চাল দে পায়েস রান্ধে! সে বড় চমৎকার!

বাব্বা! কেনডাঙালের বিশু কিছু ব্যবসা করে নেবে এই ইদের দিনে। লোকে মেঠাই কিনে বোঝাই করবে। তা আর না করবে কেন বলো! গেরামের মোড়ে এক একখান বলে দোকান! সে দোকানে ভিড় হবে না! ছেলেরা ইদি দিয়ে বুঝি মেঠাই খাবে না! নুরুও খাবে, গরমাগরম সিঙাড়া। নুরুর মা বলবে, নুরু ইদগাহ থেকে বেরিয়ে আগে ঘর আসবি। নুরু কোনওরকমে এক বাটি পায়েস খাবে কি খাবে না, দে দৌড়। পাড়ায় এখন বক্স বাজবে জোরে। ছেলেরা নাচবে, দলে দলে ঘুরবে ফিরবে। নুরু নাকি এসব ফেলে মায়ের কোল ঘেঁষে বসে চেলে রুটি খাবে! খাবে নুরু, খাবেই তো। দুকুর-দুকুর যখন চোঁ চোঁ খিদে পাবে, তখন সে গুটি গুটি পায়ে ঘর আসবে। বড় আপার কাছটিতে ঘুরঘুর করবে। বলবে, খেতে দে। খিদা লাগছে। রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে সালন দে রুটি খাচ্ছে ওই আমাদের খোয়া ভাঙা নুরু। নুরুর হাতখান আজ বিশ্রাম পেয়েছে গো। বড় বুইনের সাদি বলেই না এত চাপ! বাপের রোজকারের হালহদিশ নাই বলেই না নুরুর মায়ে এমন দুধের বাছা নুরুরে কাজে দেছে! নুরু নিজেও তো জানে এসব। নুরু তাই মনখারাপ করে না। হাসতে হাসতে খোয়া ভাঙে কেবল। ওর হাসিখান ইদের খুশির পারা ঝলমল করতিছে। সে হাসির কাছে বাজার উপচানো হাল আমলের জামা-প্যান সব ফিকা। তবু ফুপার সাইকেলের পিছনে চেপে নুরু ইস্টিশনের কাছে বাজারে যায়। নাইলনের প্যান কেটে, কলার দেওয়া গেঞ্জি কেনে, মায়ের জন্য একখান ছাপা শাড়ি কেনে। বুইনে বলে, আমার জন্য কিছু আনিস নাই তুই! বলে, আনছি ত! দুলাভাইরে আনছি না? এমন উত্তরে নুরুর বড় বোন যে খুব লজ্জা পায়, তা মনে হয় না। মুখ নীচু করে ডাল ফেটায় সাকিনা। ওদের দাদি গুণগুণ সুরে গাইতে গাইতে দালের বড়া ভাজতেন ইফতারির বিকেলে। সে বড়া মুচমুচে কত! মাংসের সামুচা ভাজতেন কেমন! আহা! সে যে না খেয়েছে, তাকে ক্যামনে বোঝাই! বিকেল ফুরোলে রাতের তোড়জোড়।

ভাতের জাল আরও খানিক ঠেলে দিতে দিতে দাদি বলে, আয় নুরু একখান কিস্‌সা বলি তোরে। দাদির সেসব কিস্‌সায় গল্পের লাটাই গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। দাদি কি আসলেই গল্প বলতে ভালবাসে? না কি ওর নিদালি মন্তরে বুজে আসা চোখের পাতা খুলে রাখার এ এক চিরন্তন খেলা! নুরু সেসবের উত্তর পায়নি কোনওদিন। এ গাঁয়ে আর কে কবে ইফাতারিতে বাজার সাজিয়ে বসেছে বলো! এ গাঁয়ের লোকে হালিম-টালিম রাঁধতে শেখেনি। মুড়ি, ভাজা চপ, বেঙনি আর লাল টুকটুকে তরবুজে এখানে ইফতারির সন্ধে নামে। সেসব সন্ধেয় বাড়িতে বাড়িতে রোজা ভাঙার ব্যস্ততা। পেট ভরে পান্তা খাওয়ার নীরবতা। নুরুদের বিকেলগুলো কাঠকয়লায় ধোঁয়া ওড়ানো কাবাবের গন্ধে ভরা, এমন ভেবেছিলেন বুঝি আপনেরা? কোথায় পাবে এসব নুরু! খোয়া ভাঙা নুরুর মায়ে কলাই সেদ্ধ দে মুড়ি মেখেছে জম্পেস করে। নাকে ঝঁজ তুলতে তুলতে নুরু খাচ্ছে সেসব গোগ্রাসে। খাক খাক। রোজা নেই ওর, নাই বা থাকল। তবু ত খোয়া ভাঙা আছে! সে কি কম হলো!

মুড়ির সঙ্গে খানিক রঙ চা খাবি নুরু? শুবি খানিক? পাটি পেতে দেব?

More Articles