পান্তা আর চুনো মাছের বাসি টক || জিভের হিসেব কলিজার হিসেব

আকাশে যেন সূয্যিদেব আগুন ঢালতে লেগেছেন। মাটির বুকের রসটুকু টেনে নেবেন, এই তাঁর ইচ্ছে? ডোবা, পুকুর, নয়ালজুলির মাটি ফেটে চৌচিক্কার। কাঁদড়ে ঘাসের আড়াল আছে বটে, তবু জলের পিত্যেশা কি তাতে মেটে! থিতিয়ে থাকা পাঁকে মোষেরা তাই সারাদিন গা এলিয়ে পড়ে থাকে। বেলা পড়ে গেলে জীবনখুড়ো ওদের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। তা সাধ্যি কি ওদের তোলে! রমজানের মাসে এমন আগুন জ্বলা দুপুরে তাই নির্জলা পড়ে থাকে মানুষের বিল, বিলান... নয়ানজুলি। রাতভোর শ্যালো চলে মাঠে মাঠে। খরার চাষের এই তো নিয়ম!

মানুষের পো তাই রাত জেগে জমি আগলায়, জল আগলায়। রাতের নরম হাওয়ায় তার চোখের পাতা লেগে আসে খানিক খানিক। তালের গাছে ঝটপটিয়ে ওঠে পাখির বাসা। এমন নিশ্চিন্তের ঘুমের মাঝে এসব শব্দ কানে আসে বটে, তবু মনে হয়, এ যেন জমির পাশটিতে নয়, এ যেন অনেক দূরে, অনেক। তিরতিরে হাওয়া ওঠে ধানের ক্ষেতে, চাঁদের আলোয় মায়ার পৃথিবী পড়ে থাকে একটেড়ে। আগুন জ্বলা দিনকে তখন মায়া বলে বিভ্রম হয় বুঝি বা। তবু তো মানষের মন! সে এমন মায়ায় ডুবে যেতে চেয়েও পারে না। মসজিদে ঘোষণা দেয়, সেহেরির সময় হয়েছে। নরম হয়ে আসা জোছনা পেরিয়ে, শ্যালোর আওয়াজ পেরিয়ে শ্যামল এখন ঘরে ফেরে তাই।

মা বসে আছে পান্তা নিয়ে। ছাতু দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে ওর পিঠ বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়তে চায় মায়াবী জোছনার মেদুরতা। আর খানিক পরেই তো আলোর বর্ণমালায় ভেসে উঠবে চরাচর। মাঠে মাঠে তখন ধানজমির ঘাস তোলার ব্যস্ততা। মেয়েদের ফুলহাতা জামা আর গামছাবাঁধা মাথা তখন কেবল উঠবে পড়বে। রোদ্দুরের মাঝখানে উবু হয়ে কাজ করছে ওই ঘাস নিড়ানিরা। ওদের কি আর ইচ্ছে করে এমন রোদ্দুরের মধ্যে ডুবে যেতে! কারই বা করে! ঘরে ঘরে মানুষ এখন কেবল ঘরে ফিরে বুক ভিজিয়ে জল খেতে চায়। মেটে কলসির গায়ে ভিজে ত্যানা জড়িয়ে রাখা দিনে মানুষের ইচ্ছে করে একদলা আখের গুড় ভিজিয়ে সরবৎ খেতে। চিনির পানায় কি আর তেষ্টা মেটে! সে তুমি যাই বলো, গুলুকন ডি না ছাই কী! আকের সরবতের মতো আর কিছু নাই বাপ। দানা দানা গুড় কিনে এনেছে তাই সংসারী মানুষ। এসব গুড়ের খোঁজ রাখতি হয় বাপু। অমুকের বাড়িতে আখশাল হচ্ছে জানলিই হাতে টিপিন ঝুলিয়ে সেদিকে দৌড় লাগায় হিসেবি মানুষ। এ হিসেব কি আর অঙ্কের হিসেব! এ হলো গে জিভের হিসেব, কলিজার হিসেব। মানুষেরে এমন হিসেব করতে হয় বইকি! নইলে জীবন টেকে ক্যামনে! বোশেখের দিনে মানুষ আকের সরবৎ খেয়ে খানিক দাওয়ায় হেলান দে বসবে, ওই দূরে রোদে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকবে ঝাঁকড়া মাথার গাছগাছালি, গরম হাওয়া পাক খেয়ে বেড়াবে কেবল এদিক থেকে ওদিক, তবে না মানুষ জানবে এখন ভিজে ভাত খাওয়ার দিন এল!

আরও পড়ুন: চড়কের মেলা ও বছর পয়লা || ভাতের নেশা কি হাঁড়িয়ার চেয়ে কম?

ভিজে ভাতে এখন কলিজা ডুবিয়ে দুপুর কাটানোর পালা। জংলা ছাপ ছাপ শাড়ি এখন তাই জুত করে কুর্তি কলাই বাটছে। কাঁচালঙ্কা দে কলাই বাটা হলে পাটা কাচিয়েকুচিয়ে তুলে রাখছে ব্যস্ত হাত। খাওয়ার আগে কাঁচা পেঁয়াজ কেটে নেবে'খন। এত আগে কাটলে কি আর পেঁয়াজের স্বাদ থাকে গো! বাপের পছন্দ ছাতু দে জলঢালা ভাত, ছেলে-মেয়ে খাবে কলাই বাটা দে। মায়ের অবশ্য ইচ্ছে করে মাখা মাখা চুনো মাছের টক খেতে। আহা, বাসি টকের স্বাদ যে কী! কলাইয়ের বাটিতে ভরে সে টক রেখে দাও না দু'দিন, তিন দিন! ফিরিজের টকে কি স্বাদ হয়! টক মজলে তবে না তার সোয়াদ!

এ তো গেল দোপোরবেলার কথা। সক্কাল সক্কাল টিউশনি যাওয়া মেয়ের বুঝি খিদে পায় না! মায়ে তাই গমের ছাতু বানায় ভারি যত্ন করে। ছেলে বলে, মা সময় নেই আর। তুমি গুড়-মুড়ি মেখে দাও শিগগির। মায়ে বলে, খানিক ছাতু দে দিই বাপ। শুধু গুড়-মুড়ি কি প্যাটে থাকে! খানিক পরেই প্যাটখান পড়ে যাবে। তখন অঙ্ক ভুল হবে ব্যাবাক। ছেলে মায়ের এমন সুর তোলা কথায় হাসে। মায়ে কয়, হাসোস ক্যান! আমার মায়ে এমন কথা কইত, সেই শিখসি ছেলেবেলায়। মায়ে এমন দিনে কাজির ভাত খাওয়াইতো। তরা কি আর খাইছিস সেসব! ছেলে বলে ওসব খেয়ে কাজ নেই মা, তুমি গুড়-মুড়ি দাও দিকিনি!

গুড়-মুড়ি এগিয়ে দিতে দিতে মায়ের খেয়াল যায়, বলে, আসার সময় নিমফুল পেড়ে আনিস তো ক'টা। আনবে না জেনেও মায়ের এই নিত্যদিনের ফরমায়েশ। এ আসলে নিজেকেই কাজ মনে পড়িয়ে দেবার ছলছুতো। ছেলে-মেয়ে বেরিয়ে গেলি'পর মায়ে আমের কুলো রোদে দেয়, আহিরি কলাইয়ের ধামা রোদে দেয়। তারপর হাঁটুর ওপর খানিক কাপড় তুলে দিয়ে বাজার থেকে আনা পাকা তেঁতুল কুটতে বসে। হাতে খানিক তেল মেখে বঁটি পেতে তেঁতুল কাটে, বিচি ছাড়ায়। এসব তেঁতুল বয়াম ভরে ভরে রোদ্দুর খাবে। এসব তেঁতুলে বছরের টক হবে, আচার হবে, হাত অম্বল হবে। কাজের কি শেষ আছে বাপু! মেয়েলোকের কাজ কি ফুরোয়!

এমন দুপুরে সাইকেলে সাইকেলে কুর্তি কলাই ফেরি করে বুড়া ফকির। না না, ফকির সে নয়। নাম তার ফকির। তেঁতুলের বঁটি ফেলে তাই কলাইয়ের দর করতে হয় এখন আবার। বুড়া ফকির বলে, খানিক পানি দ্যান মা। এউ গরমে রোজা রাখতে পারি নাই। বয়স তো কম না, কামকাজ না করলি খাব কী! কলাই কেনা মাথায় ওঠে। মেয়ের মা বলে, খাড়ায় আসেন ক্যান, বয়েন। এক দলা গুড় দে কলসি কাত করে জল ঢালে জংলা ছাপের শাড়ি। কলাই বেচতে বেচতে বুড়া ফকির চলে যাচ্ছে ওই। ওর তেষ্টা মেটানো ইস্টিলের গেলাস পড়ে আছে দাওয়ার এক ধারে। ঝেড়ে-বেছে কলাই তুলে রাখতে হবে এখন। এই গরমে কলাই বাটার মতো আর কিছু আছে! পোস্তয় হাতে ছ্যাঁক লাগে। মানুষে কি করবে আর, কলিজা জুড়িয়ে জল খাবে, গড় খাবে, আর ভিজে ভাতে কলাই বাটা খাবে। সেহেরির সকাল থেকে কুর্তি-কলাই বেচা দুপুর এখন গা ডুবিয়ে শুয়ে পড়তে চাইছে ভিতে ভাতের গামলায়। মোষেদের মতো, মেয়ে-মরদের বুঝি ইচ্ছে করে না, আমানির জলে ডুবে যেতে!

More Articles