চড়কের মেলা ও বছর পয়লা || ভাতের নেশা কি হাঁড়িয়ার চেয়ে কম?

খুব ভোরে আজ থমকে আছে চারদিক। নদী থেকে পাক খেয়ে আসে যে হাওয়াখান, তাও আজ শুনশান। এমন থমকে থাকা ভোরে মেঘশিরীষ গাছের ওপরে ভোরের আলো তার লাল আভাখানি বুলিয়ে দিয়েছে বুঝি সযতনে। কোন সূয্যিডোবা মেঘের পরশ এমন বিহানবেলায় তাই ছায়া বুলিয়েছে মেঘশিরীষের লালচে ফুলে। এমন গাছের নীচে দাঁড়ালে মৌতাত লেগে যায় ছেলে-বুড়ো সক্কলের। ফজরের আজান ফুরোলে বিনুনি বাঁধা তন্বী কিশোরী পাশ ফিরে শোয়। তার মায়ে এসব দেখলে গজরগজর করে। বচ্ছরকার দিনে এমন সূয্যি ওঠা বেলা অবধি শুয়ে থাকে কে! চৈতি সংক্রান্তি পেরনো ভোরে ঘরদোর ঝাটপাট দিয়ে তকতকে করে না তুললে কি চলে! আজ যে বছর পয়লা! দেওতারা এমন সকালে নরম রোদ্দুরের আভা বুলিয়ে দেন মানুষের গায়ে মাথায়। বেলা বাড়লে রোদ চড়চড়িয়ে উঠবে, সে উঠুক না! ভোরখান তো দেওতার ছোঁয়া পেয়েছে!

এমন ভোরে উঠোন নিকিয়ে বড় হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে দিতে হয় সক্কাল সক্কাল। আখা জ্বালিয়ে দিয়ে কিশোরীর মা তাই ব্যস্ত হাতে হাঁড়ি বসায়, মহুলের ফুল দিয়ে গম সেদ্ধ হবে আজ। সে হবে'খন ওবেলায়। মুরগা হবে। কুটুম আসলি কি আর শাকপাতা দিয়ে মেহেমানদারি পোষায়? না কি অমন করলে মান থাকে! এ গাঁয়ে চড়কে বিশান ধুম। বাহিরি, বাগানপাড়া, এ মুলুকের যত যত কুটুম আছে, আজ যে তারা এসে পড়বে না এমন গ্রান্টি কী! পোলট্রির দোকানে তাই সক্কাল থেকে মানুষের ভিড়। ঘরে ঘরে আজ কুটুমের গলার স্বর উঠবে আর পড়বে। চড়কের মেলা বসতে মাঝ দুপুর। কত লোক কত লোক। ঘরে ঘরে ভাতের গন্ধ, হাড়িয়ার গন্ধ আজ ভরে আছে বছর পয়লার গন্ধ মেখে। মহুলঝরানো সকালের মতো সেই গন্ধ নেশা লাগে। হাতে হাতে চটের থলি হাতে ছেলে-বুড়ো মহুল কুড়োয় ঝোপে-ঝাড়ে। মহুলের ডাল খেতে ভারি ভাল। মিঠে মিঠে গন্ধে ভরা।

চড়কের মেলা জমতে বিকেল গড়াবে। মেয়ে মরদ সক্কাল সক্কাল খেয়েদেয়ে দোরে দোরে পেলাস্টিক পেতে বসবে পসরা সাজিয়ে। সময় কী আর বসে আছে! সে তো কেবলই বয়ে চলেছে! তন্বী কিশোরী মেয়ে তাই আজ আটো করে চুল বেঁধেছে মাথার উপরে। ফুল ছাপের জামাখানি ওর শামলা শরীরে মানিয়েছে বেশ। মায়ের হাতে হাতে মেহেমানদারি সামলে মেয়ে এখন মেলায় যাবে সখীসঙ্গে। দোরে দোরে হাঁড়িয়ার কলসি সাজিয়ে ঘুগনি সাজিয়ে দকানদারির সুখ আজ চরম। এমন লু বওয়া দুপুরকে সে আজ বেবাক বুরবক বানিয়ে দিয়েছে বেমালুম। মানুষের হাতে হাতে লাল নীল পেলাস্টিকের গ্লাস ঘুরছে হরদম। রঙিন চোখের বুঢ়া মাথায় গামছা বেঁধে, চেক চেক গেঞ্জি পরে দুলে দুলে হাসছে মৌতাতের সুরে। সে সুর ওকে নিয়ে যাবে এই গাঁ-ঘর পেরিয়ে কোন সে ফেলে আসা ছেলেবেলায়!

আরও পড়ুন: চৈত্র শেষের হেঁশেল || ব্রতকথার মতো ফেলে আসা গ্রামের পথ

মেলাচলতি মেয়ের খোঁপায় পেলাস্টিকের এই এত্ত বড় ফুল দেখে ও তাই হাসবে। অকারণে হাসবে। দোকানদার এসব দেখেও দেখবে না, পেলাস্টিকের গেলাস ভরে দিতে দিতে কড়ায়গণ্ডায় লাভ-ক্ষতি বুঝে চাইবে কেবল। আমাদের তন্বী কিশোরী ততক্ষণে মেলা ঘুরে নিয়ে দু’পাক। মাটিতে মাটিতে ঢেলে বিকোচ্ছে তরমুজ আর আধবুড়ো শসা। এমন ধুলো ওড়ানো বৈশাখী দিনে মানষে মেলায় এসে এই খাবে না তো কী খাবে বলো! মায়ের কোল পোঁছা ছেলে তবু বায়না ধরে। লাল টুকটুকে আমিত্তি বিকোচ্ছে গরম গরম। গজা বিকোচ্ছে চূড়া করে। মায়ে কয়, আমিত্তি কত করে গো? রসিক দাসের বাড়ি এই আমাদের যাদবপুরেই। কত বচ্ছর ধরে যে চড়কের মেলা কচ্ছে রসিক দাস সে আর কী বলি! বলে, একশো কুড়ি টাকা কেজি। ক'কিলো নেবে গো? মড়মড়ে শাড়ি জড়ানো মায়ে কয়, দিন দুইখান। রসিক দাস লোক ভাল, কয় তিনখানই দিলাম ধরো, দুইখানের পয়সা দাও। এসব বলে একখান কড়া ভাজা আমিত্তি মায়ের হাতে গুঁজে দেয় সে।

মানুষ কি কেবল এমন চড়কের মেলায় লাভ করতি আসে গো! কার যে কীসে আনন্দ কথা কেমনে বোঝাই! এমন ধুলো ওড়ানো মেলায় লালটুকটুকে আমিত্তি বেঁচে খানিক খানিক পয়সা হয় বটেই তো! তবে কেবল পয়সা নয় গো, মানুষের কি সাধ্যি আছে! তিনি না টানলে কি আর রসিক দাস এমনি এসেছে! রসিক দাসের দোকান পেরোলে বাদাম ভাজা, কটকটি ভাজা, ঘুঙনি আর ফুচকার সারি। আমাদের কিশোরীকে ওই দ্যাখোনা কেমন ফুচকা খাচ্ছে টপাটপ। হলুদ আলোয় আর চাঁদ ঢাকার মেঘের তাপে ওর মুখখান চকচক করছে। ঘামতেল মাখানো দেবী প্রতিমে যেন! এস্টেজে এখন গান শুরু হবে, আসর গরম কচ্ছে জুড়ির দল। আমাদের মেয়ের সেদিকে ভুরুক্ষেপ থাকলে তো! মায়ে যে ক্যামনে এমন মেলা ফেলে কুটুমের মেহেমানদারি করে! আমাদের মেয়ে যখন মা হবে, ও কিন্তু তখন মোটেও অমন করবে না। হলুদ আলো আর রাঙা ধুলোয় মেলার মাঝখানে যেন থমকে আছে আস্ত একখান মেঘশিরীষের গাছ। সেই যে দেওতার ছোঁয়া বোলানো ভোরের মতো। মানুষের ভিড়ে মিশে আছে কল্লোরের কোলাহল। এ তো আর বাবুদের মেলা নয়, এ মেলা মানুষের। এ মেলায় তাই খয়েরি হয়ে যাওয়া বুড়ো বুড়ো শসা বিকোয় কত্ত! মানুষেরা বড় ভালবাসে এমন শসা। কঙ্কালীওতলার মোচ্ছবের চেয়েও এই মেলার মজা বেশি। পুজোর থানখান কেমন আলো দিয়ে সাজিয়েছে মানুষেরা। রাত-ভোর এই মেলা চলবে এখন। কুটুম আসা বাড়িতে পোল্ট্রি রান্না হয়ে গেছে এতক্ষণে। কুটুমরা টুল টুল করে হাড়িয়া খাবে আর মুরগা খাবে। খাওয়া ফুরোলে মাটির দাওয়া আছে না! এমন মেলা জাগা রাতে চাঁদ উঠবে গোল থালার মতো। আমাদের তন্বী শ্যামা কিশোরী চাঁদের আলো মেখে ঘরে ফিরবে। ওর চোখে-মুখে আশনাইয়ের রঙ ঝরে পড়ছে ওই। মেয়ে বলবে, মা ভাত দে। কড়কড়া ভাতে মুরগা মেখে চাঁদের মধ্যে ও ডুবে যাচ্ছে ওই।

বছর পয়লার দিনে মানুষে এর বেশি আর কী চায়! চায় না তো কিছু! চাইবে কেন! ভাতের পাতে নাড়াচাড়া করে যে আঙুল সে বুঝি আশনাইয়ে ডুবে যায়নি! সে নেশা কি হাঁড়িয়ার চেয়ে কম? বল না মা! বল না তুই!

More Articles