সাফল্য পেতে ছাড়েনি খেলাধুলা, কীভাবে JEE পরীক্ষায় ১০০ শতাংশ নম্বর পেল বাংলার ছেলেটি?
Success In JEE Exam : JEE পরীক্ষার ফলাফলে ১০০ শতাংশ নম্বর তুলে তাক লাগিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার এই ছেলেটি। সমাজের উদাহরণ হয়ে ওঠার জার্নিতে কীভাবে লড়াই করেছিল সোহম?
বয়স যখন সবে তিন ছুঁইছুঁই তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় যুদ্ধটা। একরত্তির পিঠে মস্ত একটা বোঝা চাপিয়ে দৌড় শুরু। নার্সারি, কেজি পার করে হাই স্কুলের গণ্ডিতে পা। হাই স্কুলের যাতায়াতও শেষ হয়ে যায় একদিন, তারপর শুরু হয় কলেজ, ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি নানা কিছু। একটা নিরন্তর প্রক্রিয়া, কেবল ধাপ বদল করে নতুন ধাপে উত্তীর্ণ হওয়া মাত্র। লক্ষ্য একটাই, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। কেবল মোটা মাইনের চাকরিটুকুই সব নয়, তার সঙ্গে এই এতদিনের যুদ্ধ জয়ের আনন্দ মিশে যায় নিমেষে। লেখাপড়া করে গাড়িঘোড়া চড়ার এই জার্নিতে আজকের প্রজন্মের কাছে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা প্রথম থেকেই চলে আসে। আর সেই ইঁদুর দৌড়ে সন্তানদের ঠেলে দিতে বাধ্য হন অভিভাবকরা।
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ‘চাকরি’ শব্দটাই যেন হ্যালির ধূমকেতু। চারিদিকে শুধু ছাঁটাইয়ের হিসেব। তবুও হাল ছাড়ার উপায় তো নেই, লড়তে হয়। রাত দিন এক করে লড়তে হয়। তবেই সাফল্য আসে। আর সেই সফলের দিকেই আঙুল দেখিয়ে অভিভাবকরা সন্তানদের এগিয়ে দিতে চান। কোচিং সেন্টারগুলো তাদের দেওয়ালে বড় করে ছবি টাঙায়। প্রশ্ন উত্তরের বই হাতে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য ডাক পড়ে। তবে এই সবের ব্যবসায়িক দিকটি বাদ দিলেও অন্য একটি সত্যি লুকিয়ে রয়েছে। যাতে আরও পাঁচজন ওই একই ভাবে সফলতা পেতে পারে সেই চেষ্টা রয়েছে।
বয়স সবে সতেরো। রুবি পার্কের ডিপিএস স্কুলের ছাত্র সোহম দাস। সম্প্রতি JEE পরীক্ষার ফলাফলে ১০০ শতাংশ নম্বর তুলে তাক লাগিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার এই ছেলেটি। সমাজের উদাহরণ হয়ে ওঠার জার্নিতে কীভাবে লড়াই করেছিল সোহম? কীভাবে বা সফলতার এসেছে, সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে সোহমই। সকাল থেকে রাত অবধি ঠিক কী কী করত সোহম? কোন পথে এগলে আপনার সন্তানও পেতে পারবে সাফল্য, জানুন সেসব...
আরও পড়ুন - জাতীয় রেকর্ডে নাম দুজনেরই, বাঁকুড়ার মা-মেয়ে এই জুটির ট্যালেন্ট জানলে অবাক হবেন আপনিও
পরীক্ষার প্রস্তুতি
প্রথম থেকেই পড়াশোনা নিয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং মনোযোগী সোহম। দিনে অন্তত ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পড়াশোনার মধ্যেই ডুবে থাকত সে। পরিশ্রমের যে কোনও বিকল্প নেই, সে কথাও মানে সে। তবে আজকের এই যে JEE পরীক্ষার সফলতা, তার পিছনে রয়েছে আরও অনেক কিছুই। জীবনে সবথেকে জরুরি হল ফোকাস। কী করতে চাই আমরা, কী হতে চাই আমরা, এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা জরুরী। তার পর নিজের দেখা সেই স্বপ্নের পিছনে নিরন্তর দৌড়। একাদশ শ্রেণীতে ওঠার সময় থেকেই সোহম তাই ঠিক করে নিয়েছিলেন JEE মেইনস-এ ফোকাস করার কথা। সেই মতো অঙ্ক, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি নিয়ে মনোযোগ দিতে শুরু করে সে। যেন একটা নিরলস জার্নি। যেহেতু JEE পরীক্ষার সিলেবাস, স্কুলের পরীক্ষার সিলেবাসের থেকে অনেকটাই আলাদা, এমন কিছু প্রশ্ন এই প্রবেশিকা পরীক্ষায় থাকে যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে আসা বিষয়গুলিও জরুরী হয়ে পড়ে, তাই দুটিকে পাশাপাশি রেখে এগিয়ে চলতে হয়েছে তাকে। যদিও এই বিষয়ে সহায়তা পেয়েছে স্কুলেরও। উপস্থিতির হিসেব নিয়ে কোনওদিনই বিশেষ কড়াকড়ির সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে।
দৈনন্দিন রুটিন
ঘড়িতে সকাল আটটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠত সোহম। তারপর টানা দু ঘন্টা পড়াশোনা করে মাঝে আধ ঘণ্টার বিরতি নিত। আবার দুপুর দুটো পর্যন্ত পড়াশোনা করত। এরপর আরও এক ঘণ্টা বিরতি নিয়ে বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত পড়াশোনা করত। তারপর আবার বিরতি, এরপর সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সারাদিনের পড়া বিষয়গুলি রিভিশন দিত সে। একটানা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওই বিরতিগুলোই আসল মূলধন ছিল সোহমের। পড়াশোনাকে তাই কোনও দিনই বদ্ধ মনে হয়নি তার। বিকেলের দিকে প্রায়দিনই ফুটবল খেলতে মাঠেও যেত সে, কখনও আবার কাছেপিঠে খানিক হাঁটতে যেত। এমনকী পরিবারের সঙ্গে সময়ও কাটাত সোহম। আর এইসবই ছিল তার কাছে মুক্ত বাতাসের মতো। এসব থেকে এনার্জি নিয়ে আবার পড়াশোনায় ফিরত সে। সোহমের পড়াশোনায় পারিপার্শ্বিক সমর্থন ছিল বলেই এই জয় সম্ভব হয়েছে।
ছোট থেকেই মেধাবী ছাত্র সোহম। দশম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষাতেও ৯৮.৬ শতাংশ নম্বর তুলেছিল সে। তবে আজকের প্রজন্মের ইঁদুর দৌড় থেকে খানিকটা দূরেই নিজেকে সরিয়ে রেখেছিল সোহম। প্রতিযোগিতামূলক প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালো ফলের আশায় নামজাদা কোনও কোচিং ইনস্টিটিউটে যোগ দেয়নি সে। পরিবর্তে বেছে নিয়েছিল ঘরোয়া টিউশন শিক্ষকদের।
আরও পড়ুন - মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়েছিলেন! মাত্র পঁচিশেই ১০০ কোটির মালিক এই যুবক
দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা সোহম। বাবা মায়ের একটিই ছেলে সে। তার বাবা কলকাতার একটি নামী হাসপাতালের একজন ডাক্তার এবং তার মা তার পড়াশোনার সাথে গভীরভাবে জড়িত, তাকে ক্লাসে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে তার পড়াশোনার বিষয়টা পুরোপুরি বোঝানো পর্যন্ত, পরিবারের কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন পেয়েছে সোহম। প্রবেশিকা পরীক্ষা ভালো হয়েছে, এমন আশা প্রথম থেকেই ছিল তার, তাই বলে ১০০ শতাংশ পার্সেন্টাইল, এমন আশা করেনি সেও। তাই স্বাভাবিক ভাবে এই ফলাফলে উচ্ছ্বসিত সে।
ভবিষ্যতের কী করতে চায় সোহম?
ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে সোহমের। সেই জন্যই JEE পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল সে। যদিও এই বিষয়ে বাবা মায়ের গাইডেন্স তাকে সবথেকে বেশি সাহায্য করেছে। তাঁরাই প্রথম সন্তানকে বিজ্ঞান বিষয় গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়, বিজ্ঞানকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে অধ্যয়ন করতে হয় তার প্রাথমিক ধাপটুকু চিনিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরাই। সোহমের কথায়, “আমার বাবা-মা কখনই আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং নেওয়ার জন্য চাপ দেননি, এটি সম্পূর্ণ আমার নিজের সিদ্ধান্ত। তাঁরা শুধু আমাকে বিজ্ঞান নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এবং বিজ্ঞানকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন।” সোহম আজকের এই সাফল্যে তার বন্ধুদের কথাও উল্লেখ করতে ভোলেনি সে। বন্ধুদের সমর্থন, তাদের পাশে থাকাগুলো যে সোহমের এই সাফল্যের অন্যতম অংশ সে কথাও স্বীকার করে সে। অর্থাৎ সাফল্যের অন্তরালের জীবনে পাশের মানুষগুলোর পাশে থাকাটা যে কতটা জরুরী, সে কথাও নিশ্চিত করে সোহম।
সোহম আপাতত তার JEE অ্যাডভান্সড এবং বোর্ড পরীক্ষায় মনোনিবেশ করছে এবং আইআইটি বম্বেতে কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার লক্ষ্য নিয়ে নিজেকে তৈরি করছে। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য তাই আপাতত নিজেকে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে সে। এমনকী নিজের কাছে নিদেনপক্ষে একটা ফোনও রাখেনি সে। তার একটাই কথা, জীবনে লক্ষ্যে স্থির থাকা আবশ্যক। বিভ্রান্তিতে বিচলিত হয়ে পা টলতে দিলে চলবে না, নিজের জায়গাটুকু তৈরি করতে নিজেকে ধরে রাখার থেকে বড় আর কিছুই নেই। সামনে একটাই গোল, তাই লক্ষ্যভেদ করতেই হবে। নিজেকে উজাড় করে দিতে হবে। সাফল্য পেতে কঠোর পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই।