ব্যাড বয় না কি রাজপুত্র? মারাদোনাকে ছাড়া আজীবন ফিকে বিশ্বকাপের ময়দান!
Diego Maradona: বিতর্ককে সঙ্গে নিয়ে উল্কার গতিতে পেরোনো মারাদোনার ৬০ বছর
উচ্চতায় প্রায় ১৪৮ ফুট, এবং প্রস্থে প্রায় ১৩১ ফুট, আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেস শহরে ১৪ তলা বিল্ডিংয়ের এক পাশে আঁকা হয়েছে মারাদোনার বিশালাকার এক মুরাল চিত্র। পরণে সেই চিরাচরিত নীল-সাদা জার্সি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, এ যেন স্বয়ং রাজপুত্র! মাঠে নামার শেষ প্রস্তুতি সেরে নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষা করছেন। অথচ এ যে নিছক কল্পনা, তা আর কে না জানে! বাস্তবের ময়দানে আর নামবেন না মারাদোনা। কিন্তু খেলা তো থেমে নেই, বিশ্বকাপ চলছে নিজের নিয়মেই। মারাদোনাকে ছাড়াই খেলতে নেমেছে আর্জেন্টিনা। কিন্তু সত্যিই কি তিনি নেই দলের সঙ্গে? ভ্রম কাটতে সময় লাগেনা। সম্প্রতি তাঁর মেয়ে দলমা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে লেখেন, আর্জেন্টিনা টিমের বারো নম্বর খেলোয়াড় হিসেবে অলিখিত নামটি আজও রয়েছে মারাদোনারই।
দেখতে ছোটোখাটো হলেও বরাবরই ডাকাবুকো মারাদোনা। মাঠ হোক কিংবা মাঠের বাইরে, সবেতেই নিজের দাপুটে অস্তিত্ব জানান দিয়েছেন সবসময়। দিয়েগো ছিলেন একরোখা, হয়তো সে কারণেই তিনি ঠিক যতটা বিখ্যাত ছিলেন, পাশাপাশি ততটাই ছিলেন বিতর্কিতও। কেবল খেলার মাঠই নয়, তার বাইরেও বরাবর চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন দিয়াগো মারাদোনা। হাতের ট্যাটু থেকে শুরু করে মাফিয়া কানেকশন, সবকিছুই নিয়েই চলেছে জোর তরজা। পাশাপাশি একাধিক মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কিংবা ড্রাগ আসক্তির প্রসঙ্গেও বারবার শিরোনামে উঠে এসেছিলেন তিনি। এমনকী মৃত্যু নিয়েও রয়ে যায় সেই বিতর্কের রেশ। অনেকেই মনে করেন তাঁর চলে যাওয়াটা নাকি ঠিক স্বাভাবিক নয়। যদিও মারাদোনার মতো একজনকে নিয়ে মানুষের আবেগ এতটাই গভীর যে তাঁর হঠাৎ মৃত্যু নিয়ে জল্পনা থাকাটাই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন : এই বিশ্বকাপটা মেসির চাই-ই, কিন্তু…
১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর, আর্জেন্টিনার বুয়েনাস আইরেস প্রদেশের লানুসের গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম হয় দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার। আট ভাইবোনের পরিবারে পঞ্চম সন্তান ছিলেন তিনি। টানাটানির সংসারে থেকেই একটু অন্যরকম হওয়ার তাগিদ তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। ছোট থেকেই তাক লাগানোর মতো ছিল ফুটবল স্কিল। দিয়েগোর বয়স যখন মাত্র ১০ বছর, তখনই বুয়েনাস আইরেসের বিখ্যাত ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স সই করিয়ে ফেলল তাঁকে। আবার বয়স ১৬ পূর্ণ হওয়ার আগেই ক্লাবের সিনিয়র দলের দরজাও অচিরেই খুলে গেল তাঁর সামনে। সিনিয়র দলে দিয়েগোর প্রথম মরসুমেই স্থানীয় লিগে চ্যাম্পিয়ন হল ক্লাব। দিয়াগোর পায়ে যেন সোনা ঝরছে তখন। ঈশ্বর প্রদত্ত দক্ষতায় তখন মাঠময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। ‘ফিওরিতো’ অর্থাৎ বাংলায় যার অর্থ ‘ফুলের মতো সুন্দর’, সেই নামে ডাকতে শুরু করেন সকলে।
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭, দেশের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে সুযোগ পেলেন দিয়েগো। নীল-সাদা জার্সিতে 'অ্যালবিসেলেস্তে'-এর হয়ে অভিষেক ম্যাচ হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে। বয়স তখন ১৬ বছর ১২০ দিন। ৫-১ গোলে দল জিতল ঠিকই কিন্তু পরের বছর বড়দের বিশ্বকাপে জায়গা হল না মারাদোনার। বয়স আর অভিজ্ঞতার নিরিখে তখনও তিনি বেশ ছোট। সে বছর গ্যালারি থেকেই দলের জয় দেখলেন তিনি। বলা ভালো আত্মস্থ করলেন। যার প্রমাণ মিলল পরের বছর জাপানে অনুষ্ঠিত যুব বিশ্বকাপে। মারাদোনার নেতৃত্বেই অনুর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা। বিশ্ব ফুটবলে উজ্জ্বল মহিমায় পা রাখলেন ফুটবলের রাজপুত্র। সিনিয়র দলের হয়ে প্রথম গোলটাও করলেন সে বছরই। স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩-১ গোলে ম্যাচ জিতল আর্জেন্টিনা। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই দক্ষিণ আমেরিকার সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হলেন মারাদোনা। এরপর ১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপের দলে সুযোগ এল, খেলতেও লাগলেন ভালোই। কিন্তু হঠাৎ ছন্দপতন, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিরুদ্ধে মেজাজ হারিয়ে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হল মারাদোনাকে। মারাদোনার এই মেজাজের সাক্ষী অবশ্য পরে বারবার থাকতে হয়েছে দলকে। কথায় বলে, ‘মেজাজটাই আসল রাজা’। দিয়েগো ছিলেন ঠিক তাই। এরপর কখনও বোকা জুনিয়রস, বার্সেলোনা, আবার কখনও ইতালির ক্লাব নাপোলি, চলতে লাগলো দাপুটে ফুটবল।
হাতে-পায়ে চে, ফিদেলের ট্যাটু। গেরিলাদের জলপাই রঙা টুপির উপর লাল তারা। মুখে কামড়ে ধরা থাকা সিগার। আলাদাই স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করেছিলেন মারাদোনা। খেলার সময়, গ্যালারির দর্শকদের সবটুকু নজর আটকে রাখতেন নিজের দিকেই। জীবনকে তিনি উপভোগ করেছেন প্রতি চুমুকে। একের পর এক চ্যালেঞ্জ সাজিয়েছেন, ঝুঁকি নিতেও ভয় পাননি কখনও। তথাকথিত আটপৌরে জীবনের বাইরে বেরোতে চেয়েছেন আমৃত্যু।
অতিমানব থেকে সাধারণ, চূড়া থেকে অতল, বন্ধুর অথচ অন্তরে কোমল— সবটুকু নিয়েই দিয়েগো মারাদোনা। একদিকে পার্টি-ড্রাগ-অবাধ নারীসঙ্গ-বিতর্ক-বিপ্লব, অন্যদিকে বাঁ পায়ের জাদু। একদিকে তাঁর খেলায় জাদুতে তিনি তখন ঈশ্বরসম, অন্যদিকে তাঁকে ঘিরে চলছে নানান জল্পনা। উচ্ছৃঙ্খল জীবন ইতিমধ্যে গ্রাস করতে শুরু করেছে তাঁকে। বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠল মারাদোনার মাদক আসক্তি নিয়ে। গ্রহণ লাগল তাঁর ফুটবলেও। ১৯৯০ বিশ্বকাপেও ফাইনালে গেলেও চেনা ফর্মের ধারে-কাছেও দেখা গেল না মারাদোনাকে। যে ইতালিতে ফুটবল খেলতে গিয়ে একদিন বিশ্বসেরা হয়েছিলেন দিয়েগো, সেই ইতালিতেই সেবার তিনি নিন্দিত। ডোপ পরীক্ষার নিরিখে ইতালির ফুটবলে ১৫ মাসের নির্বাসন হল তাঁর। ইতালি ছাড়লেন মারাদোনা। দেশে ফিরে গ্রেফতার হলেন কোকেন নেওয়ার অপরাধে। আবার টানা দু’বছরের নির্বাসন। অপরদিকে ব্যক্তিগত জীবনেও চলছে বিতর্ক। বিয়ে করেছেন ক্লদিয়া ভিলাফেনকে, অথচ তারই মধ্যে ক্রিস্টানা সিনাগ্রা মামলা করে দাবি করলেন তাঁর সন্তানের বাবাও নাকি মারাদোনাই।
সত্যি বলতে, এমন জীবনকে তুলনা করা যায় মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের সঙ্গে। যার এক পাশে আনন্দ, আরেক পাশে ব্যাখ্যাতীত সব বিতর্ক, অপরিণামদর্শিতা। যেমন ধরা যাক, ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মারাদোনার দু'টি গোল— প্রথমটি যদি হয় শঠতার চূড়ান্ত উদাহরণ তবে, পরেরটি প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। মিডফিল্ড থেকে একক প্রচেষ্টায় গোল। খারাপটুকুকে কেউ যদি বলেন হাত দিয়ে গোল, ভক্তরাও তাকে চাঁদের কলঙ্কের সঙ্গে তুলনা টানতেই পারেন। জীবন তো আর একমুখী স্রোতের বহতা নদী নয়, সে খরস্রোতা। তাই সবাই রে রে করে উঠলেও, মারাদোনা সেই গোলটিকে ‘হ্যান্ড অব গড’ বলেই সূচিত করেছিলেন। এ তাঁর স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, জীবনকে তিনি কখনও পাত্তা দেননি। সে কারণেই সেদিনের সেই বিতর্কিত গোলটা যেন তাঁর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি— দেশকে জেতাতে যেভাবেই হোক গোল করতে চেয়েছিলেন! এটুকু আবেগ ছিল বলেই তো তাঁর জাদুকরি বাঁ পা-ও কথা বলেছে সবসময়। অমরত্ব পাওয়ার অন্যতম শর্তই যে আবেগ। মারাদোনাও কি তেমনই এক কিংবদন্তি নন?
আরও পড়ুন : ‘ছোটো’ টিমের কাছে হেরে ভূত মেসির আর্জেন্টিনা! এই বিশ্বকাপেও ট্র্যাজিক পরিণতি?
দিয়েগো মারাদোনা নিজেকে কোনোদিন বামপন্থী বলে দাবি করেননি। বরং বলেছেন, তিনি ফিদেল কাস্ত্রোর ভক্ত। বলেছেন, তিনি কমিউনিস্ট নন, মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ফিদেলিস্তা। একেবারে দরিদ্র ঘর থেকে রীতিমত লড়াই করে বিশ্ব ফুটবলকে শাসন করেছেন মারাদোনা। আর্জেন্টিনার পরবর্তী একটা প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ফুটবল খেলেও জীবনে ঘুরে দাঁড়ানো যায়। আবার রাজনীতিবিদ অথবা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের মতো গরিবের পেটে লাথি মেরে তাঁদের কাছ থেকে চুরি করে যে তিনি ধনী হতে চাননি, সেকথাও অকপটে স্বীকার করেছেন বরাবর।
হাজার উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যেও এই মানবিক রূপটিই তাঁকে কেবল ফুটবলের ‘ব্যাড বয়’ হয়ে থাকতে দেয়নি কোনওদিনই, পাশাপাশি তিনি থেকে গিয়েছেন আবেগ হয়ে। কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় বাঁধা যেত না ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার এই মানুষটাকে। বিতর্ককে সঙ্গে নিয়ে উল্কার গতিতে পেরোনো ৬০টা বছর শেষেও বিশ্বজুড়ে একটাই রব ‘গুডবাই কমানদান্তে’। তাই আজও বিশ্বকাপের মাঠ যেন প্রতি পলকে খুঁজছে সেই রাজপুত্রকেই।