সংবিধানের নকশা থেকে অশোক স্তম্ভর সিংহ, যে শিল্পীর হাতে প্রথম রূপ পেয়েছিল জাতীয় প্রতীক

ভার্গবের তৈরি অশোক স্তম্ভের নকশা দেখে নন্দলাল বসু বলেছিলেন, "এই চার সিংহের মূর্তি ভারতকে শৌর্য, শান্ত, শক্তিশালী, দৃঢ়তা এবং পরাক্রমের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরবে।"

 

সংসদ ভবনে নতুন অশোক স্তম্ভ উন্মোচনের পর থেকেই তা ঘিরে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিরোধীদের দাবি, এই অশোক স্তম্ভের সিংহগুলি আগের তুলনায় অনেক বেশি হিংস্র। সারনাথের মন্দিরের যে অশোক স্তম্ভকে ভারতের জাতীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল, তাতে সিংহগুলি শান্ত স্বভাবের। বিরোধীরা বলছিল, তাঁদের মত, এই স্তম্ভ মোদির নতুন ভারতের স্বরূপ। সাবেক জাতীয় প্রতীক তৈরির নেপথ্যে অন্যতম ছিলেন দীননাথ ভার্গব। নকশা তৈরির আগে তিন মাস ধরে প্রতিনিয়ত কলকাতার চিড়িয়াখানায় ঘুরে বেড়াতেন তিনি। চিড়িয়াখানার সিংহদের বৈশিষ্ট্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চিড়িয়াখানায় ঢুঁ মারতেন দীননাথ।

মধ্যপ্রদেশের বেতুল শহরের বাসিন্দা দীননাথ ভার্গব। তাঁর বয়স তখন ২১। সদ্য-স্বাধীন ভারতে জওহরলাল নেহরু, আম্বেদকরের তত্ত্বাবধানে সংবিধান তৈরির কাজ চলছে জোরকদমে। ১৯৪০ সালের শেষের দিকে ভার্গব শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীর কলাভবনে ভর্তি হন। তখন কলাভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন নন্দলাল বসু। ভারতীয় সংবিধানের মূল পান্ডুলিপির নকশা করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী তথা অধ্যক্ষ নন্দলাল বসু। তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্য থেকে পাঁচ জনকে বেছে নেন এই কাজের জন্য। এঁদের মধ্যে ছিলেন কৃপাল সিং শেখাওয়াত, দীননাথ ভার্গব, জগদীশ মিত্তল এবং নন্দলাল বসুর মেয়ে গৌরী ভঞ্জ। নন্দলাল বসুই অশোক স্তম্ভের নকশা তৈরির দায়িত্ব তুলে দেন দীননাথকে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে এমনই জানিয়েছেন দীননাথের স্ত্রী প্রভা ভার্গব। তিনি জানিয়েছেন, "গুরু নন্দলালের নির্দেশের পরই আমার স্বামী টানা তিন মাস ধরে কলকাতার চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করেন এবং সিংহদের হাবভাব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেন।"

ভার্গবের তৈরি অশোক স্তম্ভের নকশা দেখে নন্দলাল বসু বলেছিলেন, "এই চার সিংহের মূর্তি ভারতকে শৌর্য, শান্ত, শক্তিশালী, দৃঢ়তা এবং পরাক্রমের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরবে।" ভার্গবের নকশা করা অশোক স্তম্ভের মূর্তিতে সিংহের মুখগুলি একটু খোলা এবং দাঁত দৃশ্যমান। স্তম্ভের নিচে সোনালি রঙে লেখা 'সত্যমেব জয়তে', (সত্যের জয় হোক) যা সারনাথে রাখা মূল স্তম্ভে দেখা যায় না । ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে ভার্গব সংবিধানের প্রথম ৩০ পাতা তৈরি করেন। সংবিধানের প্রতিটি পৃষ্ঠা শান্তিনিকেতনে পেনসিল ও ব্রাশ দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছিল। পরে তাতে সোনা দিয়ে স্পর্শ করা হয়েছে। সেই নথিই ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ সালে জাতীয় সংবিধান হিসেবে গৃহীত হয়েছিল এবং ভার্গবের তৈরি অশোক স্তম্ভের নকশাই হয়ে উঠেছিল দেশের জাতীয় প্রতীক।

আরও পড়ুন: নতুন অশোক স্তম্ভ ঘিরে দেশজুড়ে বিতর্ক, যে শিল্পী বানালেন এই মূর্তি

হায়দরাবাদের অধিবাসী জগদীশ মিত্তালের কথায়, "সে এক দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ কাজ ছিল। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের জন্য আমরা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি তৈরি করেছিলাম। নন্দলাল বসু নিজেই অনেকটা তৈরি করেছিলেন এবং সাহায্যের জন্য ভার্গব-সহ আমাদের সকলকে নিয়েছিলেন।" ভারতীয় সংবিধান প্রেমবিহারী সিং রায়জাদা সম্পূর্ণ নিজে হাতে লেখেন এবং নকশা তৈরি করেন নন্দলাল বসু ও তাঁর ছাত্ররা। ২০১৬ সালে ইনদৌরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভার্গব। ভার্গবের স্ত্রী প্রভা জানিয়েছেন যে, পুরনো অশোক স্তম্ভের মূল শিল্পকর্মের একটি প্রতিরূপ আজও তাঁদের বাড়িতে রয়েছে।

যদিও ভার্গবের পুত্রবধূ নতুন অশোক স্তম্ভ এবং তাঁর শ্বশুরের তৈরি অশোক স্তম্ভের নকশার ফারাকের ব্যাপারে কথা বলতে চাননি। তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, "এই বিতর্কে কোনওরকম মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু ছবি এবং নতুন স্তম্ভের মধ্যে পার্থক্য সম্ভবত চোখে পড়ছে।" তিনি আরও বলেন, মধ্যপ্রদেশ সরকারের উচিত সংবিধানের নকশা তৈরিতে ভার্গবের কাজ নিয়ে কোন আর্ট গ্যালারি বা মিউজিয়াম তৈরি করা। বহু নেতা-মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পরেও এই কাজ এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়নি।

বিশ্বভারতীর নন্দন আর্ট গ্যালারির প্রাক্তন আধিকারিক তথা শিল্পী সুশোভন অধিকারী এই প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, "নন্দলাল বসু অন্য মাত্রার শিল্পী ছিলেন। জাতীয় প্রতীকে ব্যবহৃত সিংহগুলিকে তিনি শৌর্য এবং সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। এখন যে অশোক স্তম্ভ নির্মাণ হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সিংহের হিংসাত্মক রূপ। এমনকী, কারুকার্যগুলিও খুবই আধুনিক মানের হয়ে গেছে, যা সমীচীন নয়।"

 

 

 

More Articles