নতুন অশোক স্তম্ভ ঘিরে দেশজুড়ে বিতর্ক, যে শিল্পী বানালেন এই মূর্তি

নতুন অশোক স্তম্ভ, যা জাতীয় প্রতীক হিসেবে পরিচিত, তার নকশা, ভাস্কর্য এবং ইনস্টলেশনের দায়িত্বে ছিলেন লক্ষ্মণ এবং তাঁর দল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংসদ ভবনে জাতীয় প্রতীক উন্মোচনের সময় শিল্পী লক্ষ্মণকে অভিনন্দন জানান...

দেশের নতুন সংসদ ভবনে নয় হাজার কেজির সুবিশাল অশোক স্তম্ভ উন্মোচন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই স্তম্ভ ঘিরে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিরোধীদের অভিযোগ, অশোক স্তম্ভের অবয়ব বদলে দিয়েছে মোদি সরকার, শৌর্য ও দম্ভের মধ্যে সামান্য যে ফারাক রয়েছে, তা বুঝতে ভুল করেছেন শিল্পী। নতুন অশোক স্তম্ভে সিংহের যে রূপ তুলে ধরা হয়েছে, তাতে আগ্রাসন ফুটে উঠেছে বলে দাবি বিরোধীদের। মূর্তিটি যিনি গড়েছেন, তিনি অবশ্য এই দাবি মানতে নারাজ।এই মূর্তির রূপকার শিল্পী লক্ষ্মণ ভিয়াস এবং তাঁর দল।

পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি লক্ষ্মণের জন্ম রাজস্থানের হনুমানগড় জেলার নোহারে। ছোট থেকেই বর্ষাকালে স্কুল-শেষে মাটি দিয়ে ঘর বানাতেন লক্ষ্মণ ভিয়াস। তিনি কখনও কল্পনাও করেননি যে, একদিন জাতীয় প্রতীকের ধাতব মূর্তি করবেন নিজের হাতে। যদিও তাঁর বাবা-মা কখনওই তাঁকে মাটি দিয়ে খেলতে বাধা দেননি বরং ছেলেকে ফাইন আর্টস ক্লাসে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভিয়াসের বাবা পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক। ভিয়াস বড় হয়ে রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্য শিল্পে ডিগ্রি লাভ করেন। আজ লক্ষ্মণ ভিয়াস একজন পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্যশিল্পী। গত ২০ বছরে লক্ষ্মণ জয়পুরের গোলাপি নগরীতে মূর্তি, স্তম্ভ এবং সরকারি বিল্ডিংয়ের মাথায় থাকা বিভিন্ন প্রতীক-সহ প্রায় ৩০০টিরও বেশি ভাস্কর্য বানিয়েছেন।

লক্ষ্মণের কথায়, "ওয়াঘা বর্ডারে স্থাপন করা শ্যাম সিং আটারির মূর্তি দিয়ে কাজ করা শুরু করি। এরপর উদয়পুরের ৫৭ ফুট লম্বা মহারানা রানা প্রতাপের মূর্তি, দিল্লি বিমানবন্দরে হাতির মূর্তি, জওহরলাল নেহরু, পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় এবং ইন্দিরা গান্ধীর মূর্তিগুলি আমার হাতেই তৈরি।"

আরও পড়ুন: অশোক স্তম্ভ: ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল

নতুন অশোক স্তম্ভ, যা জাতীয় প্রতীক হিসেবে পরিচিত, তার নকশা, ভাস্কর্য এবং ইনস্টলেশনের দায়িত্বে ছিলেন লক্ষ্মণ এবং তাঁর দল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংসদ ভবনে জাতীয় প্রতীক উন্মোচনের সময় শিল্পী লক্ষ্মণকে অভিনন্দন জানান। দিল্লির এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্মণের উদ্দেশ্যে বলেন যে মাত্র পাঁচ মাস সময় এই দুর্দান্ত মূর্তি সৃষ্টির জন্য ধন্যবাদ শিল্পীকে।

সংবাদমাধ্যমকে লক্ষ্মণ জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তাঁকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং বলেছেন যে, অপূর্ব কাজ হয়েছে। শিল্পীর মতে, "ব্রোঞ্জের তৈরি নতুন এই অশোক স্তম্ভ ৬.৫ মিটার লম্বা ওজনে প্রায় ৯৬২০ কেজি। যে ইস্পাতের কাঠামোর ওপর বসানো হয়েছে তাঁর জন্য প্রায় সাড়ে ছ'হাজার কেজি। একটা হাতি, একটা ঘোড়া, একটি ষাঁড় এবং ধর্মচক্র দ্বারা স্তম্ভের ভাস্কর্যটি সজ্জিত।"

"২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই কাজের জন্য আমার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আমার তত্ত্বাবধানে প্রায় ৪০ জন জুনিয়র শিল্পীর কঠোর পরিশ্রমে স্তম্ভের জন্য ১৫০টি টুকরো তৈরি করা হয়। একটি ট্রাকে করে সমস্ত টুকরো সাইটে পৌঁছলে গ্যাস ওয়েল্ডিং করে টুকরোগুলো জোড়া লাগানো হয়," এমনটাই জানিয়েছেন ভাস্কর্য শিল্পী। যদিও এই মূর্তি-বাবদ তাঁকে কত টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে, তা তিনি জানাতে নারাজ। লক্ষ্মণের মতে, এই কথা বলা যাবে না। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না এই মূর্তি তৈরিতে কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তাঁর বড় ছেলেও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে কাজ শুরু করেছেন।

সংবিধানে জাতীয় প্রতীক হিসেবে যে অশোক স্তম্ভের মূর্তি হয়েছিল, তার নকশা তৈরি করেছিলেন বিশ্বভারতীর শিল্পী নন্দলাল বসু। যদিও তাঁর তৈরি নকশার সঙ্গে নতুন মূর্তির মিল নেই বলেই আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন বিশ্বভারতীর কলাভবনের অধ্যাপক এবং শিল্পীরা। যদিও নতুন এই বিতর্ককে আমল দিতে নারাজ শিল্পী এবং তাঁর দল। শিল্পীর মতে, "মূল স্তম্ভ থেকে কোথাও আলাদা নয় নতুন তৈরি অশোক স্তম্ভ। আমরা স্তম্ভ ভালো করে খতিয়ে দেখেছি। সেভাবে কোনও বড় পার্থক্য নেই। তবে ছোটখাটো কোনও ফারাক থাকতে পারে। এটি বড় মূর্তি, ফলে নিচ থেকে দেখলে আলাদা মনে হতেই পারে।" তিনি আরও বলেছেন, "এই মূর্তি ১০০ মিটার দূর থেকে দেখার কথা। তাহলে এর সব বৈশিষ্ট্যগুলি সঠিকভাবে বোঝা যাবে‌।" স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকার এবং নির্মাণ শিল্পীরা একদিকে এবং বিরোধীদের অন্য মত। তবে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমেছেন মোদীর সভার মন্ত্রীরা। কেন্দ্রীয় বিজেপির মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরি টুইট করে জানান, "সারনাথের মূল স্তম্ভটি ১.৬ মিটার উঁচু। আর সংসদ ভবনে যেটি রয়েছে তার উচ্চতা প্রায় সাড়ে ছয় মিটার।মূর্তির আকার এবং উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও বদল হয়নি।"

 

 

 

More Articles