সম্পূর্ণ নতুন মানুষ প্রজাতির সন্ধান এনে দিল নোবেল! যে রহস্যর সমাধান করল বিজ্ঞান
Nobel in Physiology: তৈরি হয়েছে নতুন এক বিজ্ঞান, নাম প্যালিওজেনোমিক্স। স্বান্তে পাবো ও তাঁর সহকর্মীদের জন্যই সম্ভব হয়েছে এটা।
অক্টোবরের তিন তারিখেই আমরা জেনে গেছি, এই বছর মেডিসিন/ফিজিওলজির নোবেল প্রাইজ পেলেন স্বান্তে পাবো (Svante Paabo)। সুইডেনের লোক স্বান্তে পাবো কাজ করেন জার্মানিতে, লিপজিগের ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর এভোলিউশনারি অ্যানথ্রোপলজি নামের এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে।কিন্তু প্রথমেই সোজাসুজি স্বান্তে পাবো-র কাজকম্মের হদিশে না গিয়ে চলুন না, নিজেদেরই কয়েকটা প্রশ্ন করা যাক।
আচ্ছা, আমরা তো বেশ ছোটবেলা থেকেই জানি যে পৃথিবীতে বেশ কয়েক রকমের বাঘ-জাতীয় প্রাণীর দেখা মেলে। জীবনবিজ্ঞানের বইতেও আমরা জেনে ফেলেছি এদের সকলের বিজ্ঞানসম্মত নামের প্রথম অংশটি, অর্থাৎ যাকে বলে জেনাস (Genus), হলো প্যানথেরা। এদের মধ্যে আছে আমাদের সোঁদরবনের রাজকীয় বাঙালি বাঘ (প্যানথেরা টাইগ্রিস) থেকে আরম্ভ করে আফ্রিকা বা আমাদের দেশেই গুজরাতে বিচরণ করা সিংহ (প্যানথেরা লিও), প্রায় গোটা আমেরিকার জঙ্গলে দেখা মেলা জাগুয়ার (প্যানথেরা অংকা), এমনকী, এশিয়াজুড়ে তুষারাবৃত পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী তুষার-চিতাবাঘরাও (প্যানথেরা আনসিয়া)। যদি এই মুহূর্তে সৌরমণ্ডলের এই তৃতীয় গ্রহে দেখা মেলে এতগুলো বাঘ প্রজাতির, তাহলে মানুষ নামক প্রাণীটির এই ধরনের রকমফের কেন দেখা যায় না? পৃথিবীজুড়ে প্রায় আটশো কোটির কাছাকাছি সংখ্যায় এই মানুষ নামক প্রাণীটির দেখা মেলে, অথচ তারা সবাই হোমো সেপিয়েন্স। ব্যাপারখানা কী?
আরও পড়ুন: নতুন ধাঁধার খেলা ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’! রোগ নির্ণয়ে কীভাবে বাজিমাত করবে নোবেলজয়ী এই আবিষ্কার?
আমরা জানি যে, পূর্ব আফ্রিকা থেকে আধুনিক মানুষের সৃষ্টি, প্রায় তিনশো হাজার বছর আগে। এবং একটা সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে সত্যিই বেশ কয়েকটা মানবপ্রজাতির বসবাস ছিল। মোটামুটিভাবে ধরা হয় যে, অস্ট্রালোপিথেকাস নামের এক শিম্পাঞ্জি-গোত্রীয় প্রাণী মানুষ নামের প্রাণীটির বেশ কাছের সম্পর্কের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষ। আফ্রিকা থেকে আধুনিক মানুষ যখন আস্তে আস্তে উত্তরে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে গিয়ে পৌঁছল, তখন সেখানে ইতোমধ্যে বসবাস করত নিয়ান্ডারথাল নামের আরেক মানুষ প্রজাতি। আধুনিক বিজ্ঞান মনে করে হোমো সেপিয়েন্সের সঙ্গে নিয়েন্ডারথালদের মোলাকাত শুধু ভূখণ্ডের অধিকার আর জীবননির্বাহর রসদ-সংগ্রহ সংক্রান্ত প্রতিযোগিতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। হয়তো বা তাদের মধ্যে আরও গভীর সম্পর্কও গড়ে ওঠে কোথাও কোথাও। প্রায় হাজারদশেক বছর হয়তো এই একসঙ্গে চলা থেকে গিয়েছিল নিয়ান্ডারথাল আর হোমো সেপিয়েন্সদের মধ্যে। এরপর আরও পূর্বদিকে হোমো সেপিয়েন্সদের ছড়িয়ে পড়া শুরু হলে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে আরেক মানুষ প্রজাতির, নাম ডেনিসোভান।
নিয়ান্ডারথালদের ব্যাপারে আমরা জানি ঊনবিংশ শতকে। ১৮৫৬ সালে জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরের কাছেই নিয়ান্ডারথাল গ্রামের এক গুহায় পাওয়া গেল এই ততদিন পর্যন্ত অজানা মানব-ফসিল। আর ডেনিসোভানদের সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি এই কয়েক বছর আগে, ২০০৮ সালে। ডেনিসোভানদের আবিষ্কারের কৃতিত্বে স্বান্তে একজন বড় দাবিদার। এখনও পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, তাতে মনে করা হয় নিয়ান্ডারথাল আর ডেনিসোভানদের শেষ কয়েকজন এই গ্রহে ছিল হাজার চল্লিশেক বছর আগে পর্যন্ত। কিন্তু এতসব জানা গেল কী করে? এইখানেই আসে আধুনিক জেনেটিক্সের বিজ্ঞান এবং স্বান্তে পাবো-দের মতো বিজ্ঞানীদের অবদান।
নিয়ান্ডারথালদের সম্পর্কে প্রথম অনুমান করেন প্যালিওলজিস্টরা, যাঁদের কাজকম্মের মূল লক্ষ্যই হলো হাজার হাজার বছরের পুরনো ফসিল খুঁড়ে বের করে তাদের আনুমানিক সময়কাল আর শারীরবৃত্ত সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা। অন্যদিকে ডেনিসোভানদের একদম নতুন আরেক মানব-প্রজাতি হিসেবে আবিষ্কারের মূলে ছিল এই ধরনের ফসিল থেকে পাওয়া প্রাগৈতিহাসিক ডিএনএ অণুর চুলচেরা বিশ্লেষণ। এই যে ফসিল খুঁড়ে বের করে তার দেহের গঠনচরিত্র আর শারীরবৃত্ত সম্পর্কে জানা আর সেইসব হাড়গোড় থেকে পাওয়া ডিএনএ অণু বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করা- এই দুইয়ে মিলে তৈরি হয়ে গেছে নতুন এক বিজ্ঞান, নাম প্যালিওজেনোমিক্স। স্বান্তে পাবো ও তাঁর সহকর্মীদের জন্যই সম্ভব হয়েছে এটা। তবে কাজটি খুব সহজ নয় তাঁদের জন্য। কাজটা ঠিক কতটা জটিল, বুঝতে চলুন একটু জানা যাক, এই ডিএনএ অণুর ব্যাপারে।
যে কোনও প্রাণীদেহ (বা উদ্ভিদ দেহ) তৈরি অসংখ্য কোশ দিয়ে, এই কোশগুলো কাজ করে বিভিন্নভাবে আর তার ফলে দেহেরে এক-এক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজকম্ম হয় ভিন্ন ভিন্ন। এদিকে সব কোশের কেন্দ্রে আছে নিউক্লিয়াস আর সেই নিউক্লিয়াসে আছে বেশ কয়েকটি ডিএনএ অণু (মানুষের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৪৬)। একইরকমভাবে কোশের মধ্যে থাকা মাইটোকনড্রিয়া নামের অংশেও থাকে আরেক দল ডিএনএ অণু। আমরা আমাদের নিউক্লিয়াসে থাকা ডিএনএ অণুগুলোর অর্ধেক পাই আমাদের মায়ের থেকে, বাকি অর্ধেক বাবার থেকে। আর মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ অণু আসে একমাত্র মায়ের থেকেই।
ডিএনএ আর কিছুই না, একটা লম্বা সুতোর মতো অণু, যা তৈরি হয়েছে এ (এডেনিন), টি (থাইমিন), সি (সাইটোসিন) আর জি (গুয়ানিন)- এই চারটি অণু বিভিন্ন ক্রমে পরপর সাজিয়ে। আর এই ভিন্ন ক্রমে সাজানো ডিএনএ অণুর বিভিন্ন অংশের এটিসিজি প্রতিটি কোশকে হদিশ দেয় বিভিন্ন প্রোটিন তৈরির কলাকুশলীর। আর এইসব প্রোটিন এক-একেকটি কোশকে তার নিজের নিজের কাজ ঠিকমতো করতে সাহায্য করে। একটি প্রাণীর প্রতিটি কোশের মধ্যে থাকা ডিএনএ অণুগুলি একরকম আর তাতেই সেই প্রাণীর আসল পরিচয় রাখা থাকে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, মাটি খুঁড়ে পাওয়া মানব-ফসিলের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জানা সম্ভব প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের সম্পর্কেও।
কিস্তু এখানে একটা গোলমাল হলো এই যে, ডিএনএ বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন একটা অখণ্ড সুতোর মতো অণু, কারণ তার এটিসিজি-র ক্রমান্বয়ের মধ্যে নিহিত থাকে আসল খবর। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে মাটির মধ্যে পড়ে থাকা ফসিল থেকে এরকম অখণ্ড সুতোর মতো গোটা ডিএনএ অণুগুলোকে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। পাওয়া যেটা যায়, তা হলো এইসব অণুর অসংখ্য ছোট ছোট খণ্ড। এবার সেইসব ছোট ছোট ডিএনএ খণ্ড আলাদা আলাদাভাবে পড়ে, গোটা ডিএনএ অণুটাকে না হলেও, তার অন্তত একটু বেশ লম্বা অংশের হদিশ বের করতে হয় স্বান্তে-র মতো বিজ্ঞানীদের। এ যেন একটা বই নিয়ে পেপার-শ্রেডারে ফেলে কুচি কুচি করে কেটে ফেলে তারপর সেই কুচিগুলোকে নিয়ে বইটার কয়েকটা অন্তত পরিচ্ছেদকে আবার পাঠযোগ্য করে তোলার প্রয়াস। স্বান্তে-রা ঠিক সেটাই করে দেখিয়েছেন, আর যাতে অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও এই ধরনের কাজ করতে পারেন সেই দিশা দেখিয়েছেন। আর তারই ফল হলো এই নোবেল প্রাইজ।
প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে যে, এইসব ব্যাপারে জেনে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোনও উপকার হয় কি? কারণ স্বান্তেকে দেওয়া হলো মেডিসিনের নোবেল প্রাইজ আর আলফ্রেড নোবেল তো বলেই গিয়েছেন শুধু যুগান্তকারী আবিষ্কার করলেই চলবে না, নোবেল পুরস্কার-প্রাপকদের আর তাদের চর্চিত বিজ্ঞানের অবদান থাকতে হবে মানবকল্যাণে। এবার সেই ব্যাপারে একটু আলোকপাত করা যাক।
একটু আগে আমরা জানলাম না যে, বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে হোমো সেপিয়েন্সের সঙ্গে নিয়ান্ডারথালদের (বা ডেনিসোভানদের) মোলাকাত গড়িয়েছিল বেশ গভীর সম্পর্কর দিকে, এবং মনে করা হয় কিছু ক্ষেত্রে কয়েক প্রজন্মের হোমো সেপিয়েন্সের ডিএনএ অণুর মধ্যে মিশেল ঘটে নিয়ান্ডারথালদের আর ডেনিসোভানদের ডিএনএ-রও। এই ২০২২ সালে এসেও যদি মানুষের দেহের কোশে থাকা ডিএনএ অণু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, বোঝা যায় নিয়ান্ডারথালদের বা ডেনিসোভানদের থেকে আসা ডিএনএ-র অংশবিশেষ। এই বিষয়ে জানা কিন্তু সম্ভব হয়েছে স্বান্তে পাবো আর তাঁর সহকর্মীদের, বা এককথায় বলতে গেলে প্যালিওজিনোমিক্সের গবেষকদের কাজকম্মের ফলেই। দেখা গেছে যে, আধুনিক মানুষের দেহের কিছু গঠনচরিত্র আর শারীরবৃত্ত সম্ভব হয়েছে এইসব প্রাগৈতিহাসিক মানব-প্রজাতি থেকে পাওয়া ডিএনএ অণুর ফলে। এমনকী, আধুনিক মানবদেহের বেশ কিছু রোগের ক্ষেত্রেও এই প্রাগৈতিহাসিক ডিএনএ-র প্রভাব ধরা পড়েছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, স্বান্তে পাবো আর তাঁর সহকর্মীদের কাজ শুধুমাত্র মানুষের নিজের ইতিহাস জানার অপরিসীম অনুসন্ধিৎসার ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে আধুনিক মানুষের চিকিৎসা-বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়েও।
তবে একটা বিষয় ধরিয়ে দেওয়া যাক এইখানে। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে উপমা, তা ব্যবহার করেই বলা যায় যে সেই পেপার-শ্রেডারে কুচি কুচি করা বইয়ের কাগজ-কুচিগুলোকে সাজিয়ে বুঝে নেওয়া গেছে কয়েকটি পরিচ্ছেদমাত্র। সম্পূর্ণ বইটি আয়ত্ত করতে লাগবে স্বান্তে পাবো-দের মতো গবেষকদের নিরন্তর প্রচেষ্টা। এই নোবেল প্রাইজের স্বীকৃতি আশা করা যায়, সুনিশ্চিত করবে তাঁদের গবেষণা নিয়ে পৃথিবী-ব্যাপী আগ্রহ ও অর্থনৈতিক সমর্থন। এরকম হলে মানুষের নিজেদের জানার এই প্রকল্প আরও সম্পূর্ণতা পাবে, আবিষ্কার ঘটবে আরও অনেক অজানা দিকের।
এই আলোচনা শেষ করা যাক স্বান্তে পাবো-দের এই গবেষণার আরেকটা সম্ভাব্য দিকের কথা বলে। এই ব্যাপারে স্বান্তে নিজে লিখেছিলেন ২০১৫ সালের প্রখ্যাত জার্নাল নেচার রিভিউ জেনেটিক্স-এ প্রকাশিত তাঁর একটি 'মতামত'-প্রবন্ধে। তাঁর কথায়, "আমরা যত মূলত এশিয়া আর আফ্রিকা থেকে, নিয়ান্ডারথাল, ডেনিসোভান ও আরও অন্যান্য অধুনা-লুপ্ত মানব-প্রজাতির ডিএনএ-র উচ্চমানের তথ্য সংগ্রহ করতে থাকব, তত আমরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব, কীভাবে এইসব প্রজাতির জিনের (ডিএনএ-র) মিশেলে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হলো ও তারা ওইসব প্রাগৈতিহাসিক মানব-প্রজাতিদের থেকে আলাদা হলো (আরও দীর্ঘজীবী হয়ে ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবী-জুড়ে)।" স্বান্তের বক্তব্যর মাঝে ব্র্যাকেটের মধ্যের মন্তব্য বর্তমান লেখকের। আরও সহজ ভাষায় বলা যায় যে, প্যালিওজিনোমিক্সে উত্তরোত্তর গবেষণার ফলে আমাদের এই একমাত্র মানব-প্রজাতি হিসেবে এই গ্রহে টিকে থাকার রহস্যের যুক্তিগ্রাহ্য উন্মোচন হবে। এই গবেষণার ধারায় নিরন্তর সমর্থন প্রাপ্য আমাদের দেশের এই বিষয়ের গবেষকদেরও।
লেখক পেশায় একজন চিকিৎসা-বিজ্ঞানী,গবেষণার বিষয় ইমিউনোলজি