আমেরিকাকে আমূল বদলে দেবে ‘অ্যাজেন্ডা-৪৭’? কী পরিকল্পনা আঁটছেন ট্রাম্প?
‘Agenda 47’ by Trump: হোয়াইট হাউজে ফিরতে পারলে, কোন রূপরেখা মেনে আমেরিকাকে জগৎসভায় ফের শ্রেষ্ঠ আসন ফিরিয়ে দেবেন ট্রাম্প, তার সমস্ত পরিকল্পনা তিনি কষে রেখেছেন আগে থেকেই।
আরও একবার আমেরিকার মসনদে ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৬ সালে প্রথমবার ভোটে জিতে হোয়াইট হাউজ দখল করেছিলেন ট্রাম্প। ২০২০ সালের ভোটে ফের ক্ষমতা যায় ডেমোক্র্যাটসদের হাতে। সেইবার ভোটে লড়েও হালে পানি পাননি সেসময় ট্রাম্প। বাজি ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন জো বাইডেন। তবে ২০২৪-এর ভোটে চেষ্টার ত্রুটি করেননি কোনও রকম। শারীরিক অক্ষমতা ও অসুস্থতার জেরে ডেমোক্র্যট নেতা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রার্থী হওয়া থেকে সরে আসায় তাঁর সুযোগ বেড়ে গিয়েছিল বেশ কয়েক গুণ। কারণ এখনও পর্যন্ত ঘটনাচক্রে একবারও আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল ভোটে কোনও মহিলা প্রার্থী জেতেননি। তার পিছনে যে কারণই থাকুক না কেন! ফলে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিসের জেতার সম্ভাবনা গোড়া থেকেই কম ছিল। তার উপর ডেমোক্র্যাটদের অন্দরে কমলাকে প্রার্থী করা নিয়ে প্রচুর মতানৈক্য ছিল। যদিও পরবর্তীতে সে সব সরিয়ে কমলার দিকেই গিয়েছিল গোটা দলের সমর্থন। সে যা-ই হোক, আগামী চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজে তাঁর আস্তানা নিশ্চিত করে ফেলেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই সঙ্গে আগামী চার বছরের জন্য প্রস্তুত তাঁর হাতে মাস্টারপ্ল্যান 'অ্যাজেন্ডা ৪৭'-ও। কী এই অ্যাজেন্ডা-৪৭?
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দ্বিতীয় দফার ব্লু-প্রিন্ট বা নীল নকশা বলা যেতে পারে এই অ্যাজেন্ডা-৪৭-কে। সত্যি সত্যি হোয়াইট হাউজে ফিরতে পারলে, কোন রূপরেখা মেনে আমেরিকাকে জগৎসভায় ফের শ্রেষ্ঠ আসন ফিরিয়ে দেবেন ট্রাম্প, তার সমস্ত পরিকল্পনা তিনি কষে রেখেছেন আগে থেকেই। ভোটে জেতার আভাস পেতেই তড়িঘড়ি ফ্লোরিডার পাম বিচে বিজয়ভাষণ সেরে ফেলেছিলেন বুধবার ট্রাম্প। সেখানেই তাঁকে বলতে শোনা যায়, আমেরিকাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে নিয়ে যাওয়ার কথা। অভিবাসন নীতিতে সংস্কার থেকে আমেরিকার সীমান্তে অনুপ্রবেশ বন্ধ করার মতো একাধিক প্রতিশ্রুতি শোনা গিয়েছে তাঁর বক্তৃতায়। সেসব অস্ত্র অবশ্য প্রচারের সময় থেকেই ব্যবহার করে আসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রচারের সময় থেকেই তিনি তাঁর 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতির উপরে জোর দিয়ে আসছেন। যার আওতায় শিক্ষা, শক্তি থেকে শুরু করে বিদেশনীতি-সহ একাধিক সেক্টর জুড়ে একাধিক পরিবর্তনের কথা বলেছেন ট্রাম্প।
আরও পড়ুন: আমেরিকায় ফের ক্ষমতায় ট্রাম্প! ভিসা নিয়ে বিপদ বাড়তে চলেছে ভারতীয়দের?
এক কথায় বলতে গেলে ট্রাম্পের এই অ্যাজেন্ডা ৪৭-কে নির্বাচনী ইস্তেহার বললেও খুব ভুল হয় না। কার্যত মার্কিন শাসনব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য সংস্কারের উদ্দেশ্য নিয়েই পরিকল্পনা করা হয়েছে এই অ্যাজেন্ডার। যদিও এর মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তনের জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন। কী কী রয়েছে ট্রামের এই অ্য়াজেন্ডা-৪৭-এ দেখে নেওয়া যাক এক ঝলকে।
শিক্ষায় সংস্কার:
মার্কিন স্কুলগুলিতে আমূল পরিবর্তন আনতে বেশ কিছু বদল চান ট্রাম্প। একাধিক বিষয়ে ক্ষমতা তুলে দিতে চান অভিভাবকদের হাতে। কী কী রয়েছে তার মধ্যে। রয়েছে স্কুলের অধ্যক্ষ নির্বাচন, প্রয়োজনে শিক্ষকদের মেয়াদ শেষ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং পাঠ্যক্রম থেকে বর্ণবৈষম্যমূলক বিষয়আশয় সরিয়ে নেওয়ার মতো বিষয়গুলিও।
এর পাশাপাশি স্কুলের শৃঙ্খলার উপরেও জোর দেওয়া হয়েছে সেই অ্যাজেন্ডায়। যেখানে রোজের প্রেয়ার বা প্রার্থনাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা হয়েছে। তার সঙ্গে শিক্ষকদের আগ্নেয়াস্ত্র বহন করার অনুমতি এবং বখে যাওয়া পড়ুয়াদের বহিষ্কার করার অধিকারও দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
টিউশন-ফ্রি আমেরিকান অ্য়াকাডেমি গড়ার প্রস্তাবের পাশাপাশি কলেজের শিক্ষায় মূল্যবোধের পাঠ দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে সেই অ্যাজেন্ডায়।
জলবায়ু ও শক্তি সংরক্ষণ
প্যারিস ক্লাইমেট অ্য়াকর্ড থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন ট্রাম্প সেই অ্যাজেন্ডায়। ২০২১ সালে গৃহীত এই প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মূল লক্ষ্যই হল পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্প-যুগের পূর্বের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা, এবং যদি সম্ভব হয় তাহলে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হবে (জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ), পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দেশগুলোকে সাহায্য করা (অভিযোজন) এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আর্থিক ভাবে সহায়তা করবে উন্নত দেশগুলি, সে কথাও বলা রয়েছে এই চুক্তিতে। প্রায় ১৯৬টি দেশ এই চুক্তিতে সাক্ষর করেছিল, যার মধ্যে একটি ছিল বাইডেনের নেতৃত্বাধীন আমেরিকা। ২০২০ সালে একবার এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল আমেরিকা, ২০২১ সালে ফের যোগ দেয় তারা। ট্রাম্পের অ্যাজেন্ডা-৪৭-এর আওতায় ফের সেই চুক্তি থেকে বেরোতে চান ট্রাম্প। পাশাপাশি ফসিল ফুয়েল প্রোডাকশন নিয়ে বাইডেন জমানার যে বিধিনিষেধ ছিল, তা থেকেও মুক্তি চায় ট্রাম্পের আমেরিকা।
অপরাধদমন ও অভিবাসন:
অপরাধ দমনে কড়া পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে ট্রাম্পের নয়া এই ইস্তেহারে। পুলিশকে আরও আক্রমণাত্মক করে তোলা, পুলিশের ক্ষমতা বাড়ানো, ড্রাগ সমস্যার সমাধানে মৃত্যুদণ্ডের মতো বিধানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সেখানে।
অভিবাসন নীতি নিয়ে বরাবরই কড়া অবস্থানের কথা জানিয়ে এসেছেন ট্রাম্প। নথিপত্রহীন অভিবাসীদের বিরুদ্ধ কড়া ব্যবস্থা, ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যাপারে কড়াকড়ির কথাও বলা হয়েছে সেখানে। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ডিপোর্টেশন অভিযান শুরু করাও অন্যতম লক্ষ্য হতে চলেছে ট্রাম্প প্রশাসনের।
বিদেশনীতি
বাইডেন জমানায় ইউক্রেনের অন্যতম বন্ধু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল আমেরিকা। রাশিয়াকে প্রতিহত করতে বারবার আমেরিকার দ্বারস্থ হতে দেখা গিয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনেস্কিকে। তবে ক্ষমতায় এসে সেই ইউক্রেনকে দেওয়া সেনাসমর্থন কমিয়ে ফেলতে চান ট্রাম্প। পাশাপাশি ন্যাটো সদস্যরাও যাতে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যায় কমায়, তা নিয়ে চাপ বাড়ানোও রয়েছে ট্রাম্পের অ্যাজেন্ডায়। একই সঙ্গে চিনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কও যাতে তাঁদের কমিয়ে আনা যায়, সেই চেষ্টাও করবে ট্রাম্প প্রশাসন।
আমেরিকার ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড উইলসন রেগনের আমলে আমেরিকায় স্টার ওয়ারস নামে মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম বসানো হয়েছিল। তেমনই উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে ট্রাম্পের অ্য়াজেন্ডা-৪৭-এ।
অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যপরিষেবা
দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে আমদানির উপর শুল্ক চাপানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে নয়া ইস্তেহারে। একই সঙ্গে কর্পোরেট কর ১৫ শতাংশ কমানো এবং কর্মীদের করছাড়ের জন্য টিপস ও ওভারটাইম মজুরি ছাড়ের কথাও রয়েছে সেখানে
আমেরিকায় তৈরি ওষুধে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার পাশাপাশি মার্কিনিদের জন্য বিশেষ দ্রব্যমূল্যছাড়ের ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়েছে।
ফেডারেল সিভিল সার্ভিস
ফেডারেল কর্মীদের জন্য সিভিল সার্ভিস প্রোটেকশন সরিয়ে নেওয়া এবং ফেডারেল এজেন্সিগুলোকে নতুন করে সাজানোর কথাও বলা হয়েছে অ্যাজেন্ডা ৪৭-এ।
আরও পড়ুন: ম্যাজিক সংখ্যা পেরিয়ে হোয়াইট হাউজের পথে ট্রাম্প, যা যা বললেন বিজয়ভাষণে
পাশাপাশি এলজিবিটিকিউদের অধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অভিবাসননীতি নিয়ে আরও আক্রমণাত্মক নীতি নেওয়ার পক্ষেই যেতে চাইছে ট্রাম্পের আমেরিকা। মার্কিন মুলুকের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট হলেন দেশের সর্বেসর্বা। অ্য়াজেন্ডা-৪৭ নামক এই ইস্তেহার সঙ্গে নিয়েই ট্রাম্প মন দিতে চাইছেন তাঁর স্বপ্নের আমেরিকা গড়তে। তবে মোটামুটি যে ছক কষেছেন ট্রাম্প দেশকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পাইয়ে দিতে, সেই পথ সহজ নয়। যে মার্কিনিদের প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলে ক্ষমতায় ফিরেছেন ট্রাম্প, সত্যিই তাদের অগ্রাধিকার থাকবে তো ট্রাম্পের এই নীতিতে। পাশাপাশি বিশ্বের বাকি দেশগুলির সঙ্গে কোথায় গিয়ে ঠেকবে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক। আপাতত সবটাই ভাবাচ্ছে ওয়াকিবহাল মহলকে।