কলকাতার দুর্গাপুজোর আমেজ পেতে আসতেই হবে উত্তর কলকাতার এই মণ্ডপগুলিতে
সাবেকি এবং থিম মিলিয়ে উত্তর কলকাতার বেশ কিছু পুজো নিজেদের জায়গা পাকা করে নিয়েছে।
দুর্গাপুজোর অন্যতম বড় আকর্ষণ ঘুরে ঘুরে প্রতিমা এবং মণ্ডপ দেখতে যাওয়া। সকালবেলা মণ্ডপে মানুষের ভিড় একটু কম হলেও বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামার সঙ্গেই মণ্ডপে বিভিন্ন বয়সি মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। অতিমারীর ফলে মণ্ডপে প্রবেশের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এই বছর দুর্গাপুজো ইউনেসকো-র ইনট্যানজিবল হেরিটেজ আখ্যা পাওয়া ও অতিমারী দূর হওয়ার ফলে মণ্ডপে হয়তো আবার মানুষের ভিড় ফিরতে চলেছে। উত্তর কলকাতার পুজো মানেই এখন আর শুধু সাবেকিয়ানা নেই। বিভিন্ন স্থাপত্য, চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম, ট্রেন, প্লেন- সবকিছুর আদলে মণ্ডপ তৈরি হয়। এই ধরনের মণ্ডপ মানুষের কাছে থিম পুজো বলেই পরিচিত। সাবেকি এবং থিম মিলিয়ে উত্তর কলকাতায় শ্যামবাজার, বাগবাজার এবং শোভাবাজার এলাকায় আয়োজিত বেশ কিছু পুজো সাধারণ মানুষের মণ্ডপ এবং প্রতিমা দেখার তালিকায় বেশ কিছু বছর নিজেদের জায়গা পাকা করে নিয়েছে।
টালা বারোয়ারি
উত্তর কলকাতায় টালা ব্রিজের খুব কাছেই টালা বারোয়ারি পুজোর আয়োজন হয়। শতবর্ষ ছুঁয়ে ফেলা এই পুজো ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক চিন্তাভাবনা মণ্ডপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে শুরু করেছিল। আজ অবধি বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে টালা বারোয়ারি প্রায় দুশোর বেশি পুরস্কার অর্জন করেছে। 'কই পাখি আকাশে', 'হাইব্রিডাসুরমর্দিনী' অথবা কাচের উপর লেখা 'আমি আমার মায়ের মতো' ইত্যাদি থিম মানুষের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। এই মণ্ডপে শহর এবং শহরতলির বিভিন্ন এলাকা থেকে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায়। নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশন শ্যামবাজারের এক অথবা দুই নম্বর গেট থেকে অথবা চক্ররেলের টালা স্টেশন থেকে হাঁটা পথেই এই মণ্ডপে পৌঁছনো সম্ভব । এছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্যামবাজারগামী বাসে চড়ে টালা পোস্ট অফিস অথবা আর. জি. কর বাস স্টপেজে নেমে হেঁটে টালা বারোয়ারির মণ্ডপে পৌঁছে যাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন: কলকাতার দুর্গাপুজোয় বিশেষ আকর্ষণ অষ্টধাতুর প্রতিমা! দৈর্ঘ্য থেকে ওজন, সবেতেই চমক
বাগবাজার সর্বজনীন
উত্তর কলকাতার দুর্গাপুজোর নাম উঠলে বারোয়ারি পুজোর মধ্যে বাগবাজার সর্বজনীনের দুর্গাপুজোর নাম আসতে বাধ্য। ১৯১৯ সালে এই পুজোর সূচনা হয়। ১৯৩৮-১৯৩৯ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। থিম পুজোর পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও এই পুজো আজও মানুষের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়। প্রতি বছর বাগবাজার সর্বজনীনের আয়োজিত দুর্গাপুজোর প্রতিমার মুখ এবং মণ্ডপ সেই সাবেকি আমেজ মানুষকে ফিরিয়ে দেয়। বাগবাজার স্ট্রিট ধরে হেঁটে গিরিশ মঞ্চ থেকে গঙ্গার দিকে কিছু দূর গেলেই বাগবাজার সর্বজনীন পুজোমণ্ডপে পৌঁছে যাওয়া যাবে। শহর এবং শহরতলির বিভিন্ন এলাকা থেকে বাসে চেপে রাজবল্লভ পাড়া অথবা বাগবাজার স্টপেজে নেমে এই মণ্ডপে পৌঁছনো যায়। এছাড়া চক্ররেলের বাগবাজার স্টেশন থেকেও ২-৩ মিনিটের হাঁটা পথে খুব সহজেই এই মণ্ডপে পৌঁছনো সম্ভব।
জগৎ মুখার্জি পার্ক
গত দশকে কখনও তীর্থস্থান, কখনও লোকাল ট্রেনের আদলে মণ্ডপ তৈরি করে এই বারোয়ারি পুজো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। শ্যামবাজার এবং বাগবাজারের খুব কাছেই রাজবল্লভ পাড়া বাস স্ট্যান্ডের কাছেই জগৎ মুখার্জি পার্কে এই পুজোর আয়োজন করা হয়। নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশন শ্যামবাজারের তিন অথবা চার নম্বর গেট থেকে হাঁটা পথেও এই মণ্ডপে পৌঁছনো সম্ভব।
কুমোরটুলি সর্বজনীন এবং কুমোরটুলি পার্ক সর্বজনীন
কুমোরটুলি এলাকায় দু'টি জনপ্রিয় পুজো রয়েছে। বাগবাজারের বিচালি ঘাট এবং চিৎপুর রোডের (বর্তমানে রবীন্দ্র সরণি) মাঝামাঝি কুমারটুলির পাশেই মৃৎশিল্পীদের দ্বারা আয়োজিত কুমোরটুলি সর্বজনীন এবং কুমোরটুলি থেকে শোভাবাজার, আহিরিটোলার দিকে এগোলে কুমারটুলি পার্ক সর্বজনীন। দু'টি পুজোর মণ্ডপ এবং প্রতিমা সাবেকিয়ানা ছেড়ে থিমের হাত ধরেছে। বহু পুরস্কার পাওয়া দু'টি পুজো মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয়। বাগবাজার সর্বজনীন পুজো মণ্ডপের থেকে হাঁটা পথেই কুমোরটুলি সর্বজনীন পুজো মণ্ডপে পৌঁছে যাওয়া যাবে । নিকটবর্তী চক্ররেলের বাগবাজার স্টেশন থেকেও হেঁটে এই মণ্ডপে পৌঁছনো সম্ভব। এছাড়া বাসে করে রাজবল্লভ পাড়া স্টপেজে নেমে বেশ কিছুটা হেঁটে এই মণ্ডপে পৌঁছনো সম্ভব।
শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো
কলকাতার অন্যতম প্রাচীন পুজোর তালিকায় থাকা এই পুজোর মধ্যে রয়েছে সাবেকিয়ানার গন্ধ। উত্তর কলকাতায় অন্যতম জনপ্রিয় পুজো শোভাবাজারের পুরনো এবং নতুন রাজবাড়ির পুজো। যদিও মানুষের মধ্যে পুরনো রাজবাড়ির পুজোর জনপ্রিয়তা একটু বেশি। পুরোনো রীতি মেনেই আজও ঠাকুরদালানে পুজোর আয়োজন করা হয়। পুরনো রাজবাড়ির প্রবেশের পথে কিছুটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। সেই ফাঁকা জায়গা থেকেই প্রতিমা দেখতে পাওয়া যায়। যদিও সামনে থেকে প্রতিমা দেখতে হলে জুতো খুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রতিমার সামনে যাওয়া যায়। সারাদিন বহু মানুষের ভিড় থাকলেও রাতের বেলা নির্দিষ্ট সময়ের পরে বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুরনো রাজবাড়ির পুজোর এবং প্রতিমার ছবি তোলার ক্ষেত্রে কোনও নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও নতুন রাজবাড়ির কিছু অংশে ছবি তোলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশন শোভাবাজার সুতানুটি থেকে হাঁটা পথেই রাজবাড়ি পৌঁছনো যায়। এছাড়া বাসে চেপে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে লালমন্দির অথবা বিধান সরণির হাতিবাগান থেকে সহজেই শোভাবাজার রাজবাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে। রাস্তার দুই পাশে দু'টি রাজবাড়িতে আগত বহু মানুষের ভিড় এই বাড়িদুটো চেনাতে সাহায্য করে।
আহিরিটোলা সর্বজনীন
শোভাবাজার থেকে চিৎপুর রোড (বর্তমানে রবীন্দ্র সরণি) ধরে কিছুটা হেঁটে আহিরিটোলা সর্বজনীন পুজো মণ্ডপে পৌঁছে যাওয়া যাবে। থিমের হাত ধরে এই পুজোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। আহিরিটোলা সর্বজনীনে পুরনো বনেদি বাড়ির আদলে তৈরি মণ্ডপ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। বাসে অথবা অটো করে আহিরিটোলা বাস স্ট্যান্ডে নেমে কয়েক মিনিট হাঁটা পথে এই মণ্ডপে পৌঁছনো সম্ভব।
এইসব বনেদি বাড়ির এবং বারোয়ারি পুজো ছাড়াও বেনিয়াটোলা সর্বজনীনের আয়োজিত পুজো মানুষের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়। এবছর সেখানে বিশেষ আকর্ষণ অষ্টধাতুর দুর্গাপ্রতিমা। এইসব বড় এবং জনপ্রিয় পুজোর মধ্যে বহু ছোট কিন্তু পুরনো পুজো এই এলাকাগুলিতে আয়োজিত হয়। বিভিন্ন ধরনের মানুষ সারাদিন ঘুরে ঘুরে উৎসবের আমেজ গায়ে মেখে মণ্ডপ এবং প্রতিমা দর্শন করে।